'মেঘমল্লার' গল্পের প্রধান চরিত্র কে? 'মেঘমল্লার গল্পের প্রদ্যুম্ন চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করো।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় পুরুষ চরিত্রগুলির মধ্যে একটি মিল সবার মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় তা হল প্রত্যেকেই আদ্যস্ত এক প্রকৃতিপ্রেমিক ও কৌতূহলী। অজানাকে জানার নেশা তাদের মধ্যে প্রবল ভাবে বহমান। বিভূতিভূষণের সাহিত্যে আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো তা হল কিশোর কিংবা তরুণ চরিত্রের আধিক্য। 'পথের পাঁচালী'-র অপু, 'চাঁদের পাহাড়' উপন্যাসের শঙ্কর, আলোচ্য গল্পটির ('মেঘমল্লার') প্রদুম্ন প্রায় সবাই কিশোর কিংবা তরুণ। এই বয়সেই অজানা, অচেনার রহস্যভেদ করার প্রতি তীব্র কৌতূহল থাকে। আর ‘আরণ্যক' উপন্যাসের সত্যচরণ তো নিজে জঙ্গল নিলাম করার কাজে এসে অরণ্যপ্রকৃতি ও সেখানকার মানুষদের ভালোবেসে ফেলে এবং নিজের কাজের জন্য প্রকৃতির দেবতাদের উদ্দেশ্যে ক্ষমাও চেয়ে নেয়। সবথেকে বড় কথা হল বিভূতিভূষণ নিজে একজন প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন এবং অজানাকে জানার ও অচেনাকে চেনার তীব্র অদম্য কৌতূহল যে তাঁর মধ্যে কীরকম পরিমাণে ছিল তা তাঁর দিনলিপি, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকেন্দ্রিক লেখাগুলি এবং অন্যান্য পরিচিত ব্যক্তিদের রচনায় তার প্রমাণ মেলে। 'চাঁদের পাহাড়' রচনা করেছেন, আফ্রিকা না গিয়ে। একটা দেশ সম্পর্কে কত খুঁটিনাটি জ্ঞান থাকলে তবে এ ধরনের রচনা সম্ভব। তাঁর এ ধরনের মানসিকতাই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে প্রস্ফুটিত হয়।


বিভূতিভূষণের বিখ্যাত ছোটগল্প 'মেঘমল্লার'। এই গল্পটি তিনি প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বুনে তুলেছেন। বৌদ্ধযুগের শেষ পাদে যখন তন্ত্র-মন্ত্র হীন পূজার্চনা ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মকে প্রভাবিত করতে শুরু করে ঠিক সেই সময়ইটিই আশ্চর্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই গল্পে। এই গল্পের নায়ক চরিত্র এক তরুণ প্রাণ। নাম প্রদ্যুম্ন। অপুর মতোই সে কল্পনাবিলাসী এবং শঙ্করের মতোই অজানাকে জানার আর্তি তার মধ্যে প্রবল।


গল্পে দেখি প্রদ্যুম্ন, কাশীর বিখ্যাত গায়ক ইন্দ্রদ্যুম্নর পুত্র। সে বৌদ্ধ ধর্মমত গ্রহণ করে। প্রব্রজ্যা নিয়ে মধ্যভারতের বিদিশার কাছে এক বৌদ্ধ বিহারে পাঠগ্রহণ করতে আসে। সে পিতার মতোই সুরসাধক ছিল। বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলতে সে পারদর্শী ছিল।


গল্পের শুরুতেই আমরা তাকে দেখি দশপারমিতার মন্দিরে উৎসবের সময়ে সে একজন ভাল বীণ-বাজিয়ের সন্ধানে রত। সৃষ্টিশীল মানুষেরা একদিকে যেমন সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকেন অপরদিকে নিজেরা অপরের সৃষ্টি, অন্যান্য জ্ঞান ও নিজের সৃষ্টিকে আরও কিভাবে সমৃদ্ধ করে তোলা যায় তার জন্য নিরন্তর সাধনা করে যেতে থাকেন। সর্বদাই তাদের মধ্যে অপূর্ণতার জ্বালা লক্ষণীয় এই জ্বালাটাই নতুন কিছুকে আবার তৈরি করতে সক্ষম হয়। পূর্ণতা এসে গেলে সৃষ্টিকর্তার আর কিছু দেওয়ার থাকে না। প্রদ্যুম্ন ভালো বাঁশি বাজাতে পারে কিন্তু তার ইচ্ছা বীণ বাজানোটাও শিখে নেওয়া, তাই দশপারমিতার মন্দিরে সাপুড়েদের মাঝে সে ভালো বীণ বাজিয়েকে খুঁজছিল।


এইভাবে সে সুরদাসের সাক্ষাৎ পায় এবং মনে করে সেই ভাল বাজিয়ে। এই যে গল্পের শুরুতেই সুরদাসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে গেল এই প্রৌঢ়ই তার জীবনকে অন্য খাতে বইয়ে দেবে আমরা বিশ্লেষণ করতে করতে সেইদিকে এগোব।


প্রদ্যুম্ন সদ্য তরুণ। তার মধ্যে প্রাণচঞ্চলতা, কৌতুকপ্রিয়তা এই সমস্ত গুণ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিহারের অভ্যন্তরের শাসন অত্যন্ত কড়া তাইজন্য আচার্যদের কাছে প্রদ্যুম্নকে ভর্ৎসনাও শুনতে হয়— “আচার্য শীলব্রত অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ, একেই তিনি প্রদুম্নের মধ্যে অন্যান্য ছাত্রদের চেয়ে বেশি চঞ্চলতা ও কৌতুকপ্রিয়তা লক্ষ্য করে তাকে একটু বেশি শাসনের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করেন....."


বিভূতিভূষণ প্রদ্যুম্নর প্রেমিক সত্তারও উন্মোচন ঘটান গল্পে। প্রদ্যুম্ন সুরসাধক, প্রাণচঞ্চল কৌতুকপ্রিয় আবার স্থানীয় শ্রেষ্ঠী স্যমত্তদাসের কন্যা সুনন্দা তার প্রিয়া। বিহারে পঠন পাঠনের সঙ্গে সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়ার খেলাতেও পটু প্রদ্যুম্ন। এবং তাদের এই ভালোবাসার মাধ্যম হয়ে ওঠে বাঁশির সুর। সুনন্দা প্রদ্যুম্নর বাঁশির সুরে মুগ্ধ। প্রদ্যুম্নর সঙ্গীতে অনুরাগ, প্রেমের স্ফূরণ এবং প্রকৃতি প্রেম সব যেন মিলে যায়। গল্পের একটি জায়গায় বিভূতিভূষণ প্রদ্যুম্নর এই রোমান্টিক চেতনাকে মূর্ত করে তোলেন— “তখন পূর্ণিমার শুভ্রোজ্জ্বল জ্যোৎস্না পথ-ঘাট ধুইয়ে দিচ্ছিল। দুর মাঠের গাছপালা জ্যোৎস্নায় ঝাপসা দেখাচ্ছিল। পড়াশুনা তার হয় কি করে? আচার্য পূর্ণবর্ধন ত্রিপিটকের পাঠ অনায়ত্ত দেখে তাকে ভর্ৎসনা করলেই বা কি করা যাবে? এ রকম রাত্রে যে যুগে যুগের বিরহীদের মনোবেদনা তার প্রাণের মধ্যে জমে ওঠে, তার অবাধ্য মন যে এইসব পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নারাত্রে মহাকোটটি বিহারের পাষাণ অলিন্দে মানস সুন্দরীদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়, এর জন্য সে-ই-কি দায়ী!"


এই অত্যুজ্জ্বল অংশটিতে সৃষ্টিশীল মানবাত্মার ও প্রেমিক সত্তার চিরকালীন বিরহ বিধুরতা মূর্ত হয়ে ওঠে।


দশপারমিতার মন্দিরে সুরদাসকে দেখার পর থেকে প্রদ্যুম্নর মনে তার কথাই বার বার মনে পড়তে থাকে। সুরদাসের বহিরঙ্গের পরিচ্ছদ তার কথা বলার সম্মোহিত কায়দা সবকিছূই প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে থাকে প্রদ্যুম্নকে। তাই সুনন্দার সান্নিধ্যে এসে বাঁশি বাজাতে বসেও সে কেমন উদাস থাকে এবং বারবার সুরদাসের কথাই ভাবতে থাকে। সুনন্দার চোখে তার এই বিহ্বল ভাব ধরা পড়ে— “প্রদ্যুম্নর বাঁশীর অলস স্বপ্নময় সুরের মধ্যে দিয়ে কতদিন উভয়ের অজ্ঞাতে রোদভরা মধ্যাহ্ন গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু দুজনে এক হলে প্রদ্যুম্নর এ রকম নিরুৎসাহ ভাব তো সুনন্দা আর কখনো লক্ষ্য করেনি।”


প্রদ্যুম্ন এরপরে সুরদাসের কথামত তার পরদিন ভাঙা মন্দিরে গিয়ে দেখা করে। সুরদাস প্রদ্যুম্নর বাঁশি বাজানো শুনতে চাইল। প্রদ্যুম্ন আকাশ বাতাস মথিত করে মেঘমল্লারের তান ধরে— “তার পিতা তাকে বাল্যকালে যত্ন করে রাগ-রাগিনী শেখাতেন, তা ছাড়া সঙ্গীতে প্রদ্যুম্নের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতাও ছিল।.....লতাপাতা ফুলফলের মাঝখান বেয়ে উদার নীল আকাশ আর জ্যোৎস্না রাতের মর্ম ফেটে যে রসধারা বিশ্বে সবসময় ঝরে পড়ছে, তার বাঁশীর গানে সে রস যেন মূর্ত হয়ে উঠল........।"


এরপরে যখন সুরদাস তার বাঁশি বাজানোর তারিফ করলেন তখন—'নিজের প্রশংসাবাদে প্রদ্যুম্নের তরুণ সুন্দর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।


এরপরেই সুরদাস দেবী সরস্বতীর সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মর্ত্য্যভূমিতে পদার্পণ করার গোপন কাহিনীটি তাকে জানায় কিন্তু প্রদ্যুম্ন শিক্ষিত তরুণ সব কিছুকেই যুক্তি দিয়ে বিচার না করে মেনে নিতে পারে না তাছাড়া সে বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শন পাঠরত তাই তার মনে হিন্দুধর্মের দেবী বাণী সম্পর্কে প্রশ্নচিহ্ন ওঠা স্বাভাবিক— “আচার্য বসুব্রত কলাবিদ্যা সম্বন্ধে উপদেশ দিতে দিতে অনেকবার যে বলেছেন কলা-অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর যে মূর্তি হিন্দুরা কল্পনা করেন, সেটা নিছক কল্পনাই, তার সঙ্গে বাস্তবের কোন সম্পর্ক নেই। সত্য সত্য তাঁকে দেখতে পাওয়া—এ কি সম্ভব?”


কিন্তু প্রদ্যুম্নর এই সংশয় টেকে নি, সুরদাস বা গুণাঢ্যের প্রবল প্রতাপপূর্ণ কথা ও সম্মোহিত বাকবিভূতিতে আকৃষ্ট হয়ে এবং সর্বোপরি নিজের কৌতূহল বৃত্তি চরিতার্থ করতেই দেবী সরস্বতীকে সঙ্গীতে মুগ্ধ করতে সুরদাসের সঙ্গে যেতে রাজি হয়।


ভদ্রাবতী নদীর তীরে উঁচু ঢিবিতে বসে মেঘমল্লারের আলাপের পর দেবী সরস্বতী আবির্ভূতা হওয়ার সময় প্রদ্যুম্ন সত্যিই বিস্মিত হয়ে যায়। সে নিজে সঙ্গীতসাধক। তার সম্মুখে সঙ্গীতের দেবী বাণীর আবির্ভাব তাকে চমকিত করে বই কি।


সে সময় সুরদাসের আচার আচরণ, কথা বলার অসংলগ্নতা, বিহারে ফেরার সময় পিপ্পল বনের মধ্যে দেবী সরস্বতীর বিপন্ন অবস্থার দিশাহীনভাবে ঘোরা সব কিছুই প্রদ্যুম্নর কাছে অত্যন্ত রহস্যময় ঠেকে। বিহারে ফিরে এসে রাতে নিদ্রাভিভূত অবস্থায় সে যে স্বপ্ন দেখে তাও পরে অনেকটা সত্যি হয়। কারণ পরদিন সকালে আচার্য পূর্ণবর্ধনের কাছে সুরদাসের আসল পরিচয় (সে তান্ত্রিক, হীন তন্ত্র চর্চা ও সুযোগসন্ধানই তার উদ্দেশ্য) ও দেবী সরস্বতীকে বন্দিনী করাই তার মূল উদ্দেশ্য ছিল এগুলো জানার পর দেবীর বিপন্ন (স্বপ্নদৃশ্য) অবস্থার জন্য যে সুরদাস কিংবা গুণাঢ্যই দায়ী সেটা প্রদ্যুম্ন ধরতে পারে এবং নিজে যে এই হীন কাজে সাহায্য করেছে বলে অনুতপ্তও হয় এবং দেবী ও গুণাঢ্যের সন্ধানে বিহার পরিত্যাগ করে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করে।


বিপন্নের প্রতি সহমর্মী হওয়া মানবতার লক্ষণ, প্রদ্যুম্নর মধ্যে এই গুণ সুন্দরভাবে প্রযুক্ত করে দেন গল্পকার বিভূতিভূষণ। এরপরে প্রদ্যুম্ন বহু দেশ অতিক্রম করে ঊরুবিধ গ্রামের কাছে এসে দেবী সরস্বতীর সন্ধান পায়। ‘ঘটকক্ষে নেমে আসা স্ত্রীলোক’-ই যে দেবী সেটা সে বুঝতে পারে এবং তাঁর 'অঙ্গের সে জ্যোতির এক কণাও আর নেই, পরনে অতি মলিন একবস্ত্র’ দেখে প্রদ্যুম্নর হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে।


পর্ণকুটিরে অতি অসহায়ভাবে সাধারণ দরিদ্র গৃহবধূর মত দেবীকে বাস করতে দেখে প্রদ্যুম্নর খুব কষ্ট হয়— “প্রদ্যুম্নের চোখে জল আসছিল।.....ওগো বিশ্বের আত্মবিস্মৃতা সৌন্দর্যলক্ষ্মী। বিদিশার মহারাজের আর মহাশ্রেষ্ঠীর সমবেত রত্নভাণ্ডার তোমার পায়ের এক কণা ধুলোরও যোগ্য নয়, সে দেশের পথের ধুলো এমন কি পুণ্য করেছে মা, যে তুমি সেখানে প'ড়ে থাকতে যাবে?”


প্রদ্যুম্ন মনে মনে ভাবতে থাকে দেবীর এই বন্দিনী দশা থেকে তাঁকে মুক্তি দিতেই হবে এর জন্য তাঁর গুণাঢ্যের সন্ধান পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।


এরপরে সত্যিই একদিন প্রদ্যুম্ন গুণাঢ্যের সন্ধান পায়। কিন্তু কপট ও ক্রুর তান্ত্রিক ছলনা করে প্রদ্যুম্নর সঙ্গে। গুণাঢ্য বলে সে সরস্বতীকে বন্দী করার জন্য অনুতপ্ত তাই সে তার গুরুর কাছ থেকে পূর্বের মন্ত্রের বিরোধী শক্তি সম্পন্ন আর একটি মন্ত্রপূত জল এনেছেন সেটা দেবীর গায়ে ছেটালেই দেবী মুক্তি পাবেন কিন্তু যে ছেটাবে সে পাথর হয়ে যাবে। এটা বলে গুণাঢ্য কৌশল বা ছলনার আশ্রয় নেয়, কারণ প্রদ্যুম্ন তরুণ তায় আবার দেবীর বন্দিনী অবস্থা দেখে দুঃখী সুতরাং দেবীর জন্য সে পাথর হয়ে যেতেও পিছপা হবে না কারণ এ বয়সে আবেগ এবং আত্মোৎসর্গের প্রেরণাই থাকে সবচেয়ে বেশি। এবং ঘটেও তাই—প্রদ্যুম্ন দেবীকে মুক্ত করতে নিজের জীবন বিপন্ন করতে এগিয়ে আসে।


বিপন্নকে মুক্তি দেওয়াই মানবতার লক্ষণ। প্রদ্যুম্ন এই আদর্শে বলীয়ান হয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। নিজের প্রাণের থেকেও অসহায় বিপথু দেবী বীণা-যিনি সঙ্গীত বিদ্যাচর্চা কলাবিদ্যার দেবী তাঁকে মুক্তি দেওয়াটা বেশি প্রাসঙ্গিক— ‘‘আত্মবিস্মৃতা বন্দিনী দেবীর চোখ দুটির করুণ অসহায় দৃষ্টি প্রদ্যুম্নের মনে এল।”


তরুণ প্রাণের আত্মবলিদান যে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে ঘটে আসছে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করান গল্পকার— “যুগে যুগে যে উদার উচ্চপ্রেরণা আগে এসে তরুণদের নির্মল প্রাণে পৌঁছায়, আজও প্রদ্যুম্নের বেলায় তার ঢেউ এসে লাগল। সে ভাবলে, একটা জীবন তুচ্ছ। তাঁর রাঙা পা-দুখানিতে একটা কাঁটা ফুটলে তা তুলে দেবার জন্যে আমি শতবার জীবন দিতে প্রস্তুত।”


এখানেই প্রদ্যুম্ন হয়ে ওঠে মহৎ। এতক্ষণ তার রোমান্টিক সঙ্গীতময় সত্তা, প্রেমিকসত্তা এবং প্রকৃতিপ্রেম প্রভৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি কিন্তু গল্পের এই পর্বে এসে প্রদ্যুম্নর এই আত্মবলিদানের সিদ্ধান্তে আমাদের পাঠকচিত্ত রসার্দ্র হয়ে ওঠে। মেঘমল্লারে সিদ্ধ এক সফলকাম যুবকের এভাবে জীবনের পরিসমাপ্তি কিছুতেই মানতে পারি না। আমরা ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে উত্তীয়-র আত্মত্যাগ দেখি সে মৃত্যু শ্যামার প্রতি ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা হিসেবে। আর প্রদ্যুম্নর মৃত্যু বিদ্যাচর্চার দেবীকে তান্ত্রিকতার মোহপাশ থেকে মুক্তি দেওয়া। এই দুই যুবকের আত্মত্যাগই মহৎ।


আর একটা ভাবনা আমাদের মাথায় আসে। গল্পটি বিশের দশকে রচিত। তার আগেই ভারতে বিশেষ করে বাংলায় স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ব্রিটিশ শক্তির অপশাসনের নাগপাশ থেকে ভারতকে উদ্ধারের জন্য বাংলা মায়ের তরুণ প্রাণেরা দলে দলে আত্মবিসর্জন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ শক্তির উদ্ধত বুলেটের সামনে। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে অমর হয়ে যান ক্ষুদিরাম। আত্মহত্যার পথ বেছে নেন প্রফুল্ল চাকী। এই সমস্ত তরুণের প্রাণ বিসর্জন বিভূতিভূষণের মানসে কোথাও হয়তো রেখাপাত করে থাকতে পারে তাই এই গল্পে এক তরুণ প্রাণের আত্মবলিদান সেটাও আবার বন্দিনী দেবীকে (গল্পে সরস্বতীকে প্রদ্যুম্ন ‘মা' বলেও সম্বোধন করে) আমাদের সেই দিকেরই ইঙ্গিত দেয়।


কিন্তু প্রদ্যুম্ন মানুষ, যতই সে মহৎ আদর্শের বশবর্তী হয়ে দেবীকে মুক্ত করতে এগিয়ে যাক নিজে জড়তা প্রাপ্ত হবে এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেও এটা বলা যায় তার নিজের অবস্থার কথা ভেবে তার মায়ের কথা ও বাড়ির কথা মনে পড়ে। যে তরুণ আর কোনোদিনও নিজের গৃহে ফিরতে পারবে না এটা ভেবে আমাদেরও চোখের কোণ ভিজে ওঠে। গল্পকাব প্রদ্যুম্নর এই দিকটি দেখিয়ে চরিত্রটিকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছেন— “প্রদ্যুম্ন চারিদিকে চেয়ে বসে বসে ভাবলে, ঐ নীল আকাশের তলে বিশ বৎসর আগে সে মায়ের কোলে জন্মেছিল, তার সে মা বারাণসীতে তাদের গৃহটিতে বসে বাতায়ন-পথে সন্ধ্যার আকাশের দিকে চেয়ে হয়তো প্রবাসী পুত্রের কথাই ভাবছেন—মায়ের মুখখানি একবারটি শেষবারের জন্য দেখতে তার প্রাণ আকুল হয়ে উঠল। ঐ পূর্ব আকাশের নবমীর চাঁদ কেমন উজ্জ্বল হয়েছে। মগধ যাবার রাজপথে গাছের সারির মাথায় একটা তারা ফুটে উঠল। বেতবনের বেতর্ডাটাগুলো তরল অন্ধকারে আর ভালো দেখা যায় না।”


মৃত্যুর পূর্বে মমতাময়ী মা ও স্নেহোজ্জ্বল প্রকৃতির কথা তো ভাবতেই পারে মাতৃস্নেহবঙ্খিত প্রবাসী পুত্র। আর জীবন তো মাত্র একবারই—সেই জীবনের প্রতি লালিত্যবোধ প্রদ্যুম্ন চরিত্রকে উজ্জ্বলতা দান করেছে।


সে যে ক্রুর গুণাঢ্যের সঙ্গ দিয়েছিল দেবীকে মর্ত্যে আনানোর জন্য তা একেবারেই প্রদ্যুম্ন জানত না তাতে তার কোনো দোষ নেই কিন্তু তবুও সে দেবীর কাছে ক্ষমা স্বীকার করে নেয়— “মা, না জেনে তোমার ওপর অত্যন্ত অন্যায় আমি করেছিলাম, আজ তারই শাস্তি আমাকে নিতে হবে। কিন্তু আমি তার জন্য এতটুকু দুঃখিত নই। যতক্ষণ জ্ঞান লুপ্ত না হয়ে যায়, ততক্ষণ এই ভেবে আমার সুখ যে, বিশ্বের সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে অন্যায় বাঁধন থেকে মুক্ত করার অধিকার আমি পেয়েছি।”


এরপর প্রদ্যুম্ন দেবীর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিলেই দেবী মুক্ত হয়ে যান ‘আত্মবিস্মৃতা' অবস্থা থেকে ‘সদ্যোনিস্রোর্থিতার মত দেবী যেন চমকে উঠলেন। এবং প্রদ্যুম্নর মনে শেষবারের জন্য নিজের জননীর কথা মনে পড়ে— “সঙ্গে সঙ্গে তার মনে এল- বারাণসীতে তাদের গৃহে সন্ধ্যার আকাশে বদ্ধ আঁখি বাতায়ন পথবর্তিনী তার মা।”


প্রদ্যুম্ন এরপরে জড়তাপ্রাপ্ত হয়ে যায়। এক প্রাণচঞ্চল, প্রেমিক, সৎ তরুণের এই পরিণতিতে আমাদের চিত্ত আকুল হয়ে ওঠে। এদিকে গল্পের একেবারে শেষে সুনন্দা তার প্রিয়তমার জন্য প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বিহারে থাকে। প্রিয়তম প্রদ্যুম্নর পথ চেয়ে দিন কাটে তার এবং মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে—অর্ধভগ্ন এক পাষাণ মূর্তি এক জঙ্গলে রয়েছে। সেখানে বাঁশের বনে সিসিরে হাওয়ায় মেঘমল্লারের তান উঠছে। এই স্বপ্ন কি একেবারেই অলীক? তার প্রেমাস্পদ এখন পাষাণমূর্তি। এবং প্রদ্যুম্ন বাঁশি বাজাতে পারদর্শী এবং মেঘমল্লার রাগে সিদ্ধহস্ত তাই বাঁশের বনে হাওয়া এসে সেই মেঘমল্লারেরই ধ্বনি তুলছে তার প্রিয়াকে স্বপ্নে জানান দেওয়ার জন্য যে প্রদ্যুম্ন যে তার প্রিয়তম সে আর কোনোদিনও কুমারশ্রেণির বিহারে ফিরবে না।


রোমান্টিক প্রেম চেতনায়, সঙ্গীতসাধনায় সর্বোপরি সৎ এবং বিপন্নকে রক্ষা করতে নিজের প্রাণকেও তুচ্ছ করতে পারে যে তরুণ সেই প্রদ্যুম্ন বিভূতিভূষণের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে প্রদ্যুম্নর মত এমন কোমলপ্রাণ চরিত্র বিরল।