'ফসিল' গল্পে লেখকের বক্তব্য নিজের ভাষায় যুক্তি ও তথ্যসহযোগে প্রতিষ্ঠিত করো।

সুবোধ ঘোষ বাংলাসাহিত্যে একটি স্মরণীয় নাম। সাহিত্যক্ষেত্রে সুবোধ ঘোষের প্রবেশ ১৯৪০ সালে। 'অযান্ত্রিক' ছোটগল্প নিয়ে এবং এই প্রথম সৃষ্টিতেই তিনি সাহিত্য পাঠকদের ও সমালোচকদের প্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। গল্পের মধ্যে বাস্তবতা এবং জীবন সম্বন্ধে নির্মোহ দৃষ্টি 'ফসিল' গল্পে পাওয়া যায়। বাংলা ছোটগল্পে এই বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলিতে লক্ষণীয়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রভৃতি গল্পকারদের গল্পে জীবনচিত্রণে বাস্তবতাবোধ ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। গল্পে এই বাস্তবতাবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার মিশ্রণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাওয়া যায়। ফলে বাংলা সাহিত্যে সাধারণভাবে এবং বাংলা ছোটগল্প বিশেষভাবে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিসঙ্গাত জীবনচিত্রণের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ লেখক মনেরও পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রণী ভূমিকার কথা সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।


বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সুবোধ ঘোষের প্রথম রচনা 'অযান্ত্রিক'-এর পর তাঁর দ্বিতীয় গল্প 'ফসিল'। 'ফসিল' গল্পে একটি কাহিনী অবশ্যই আছে এবং সে কাহিনী লেখকের মুন্সিয়ানায় বিশেষ আকর্ষণীয়ও বটে, কিন্তু সেই কাহিনীকে আশ্রয় করে যে সামাজিক সত্য প্রকাশিত হয়েছে তার উপলব্ধিতে লেখক বাংলা আধুনিক বাস্তববাদী গল্পকারদের পুরোধা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।


'ফসিল' গল্পের একদিকে আছে অল্ড্রনগড়ের রাজা, প্রাচীন ঐশ্বর্যকে হারিয়েও যিনি প্রাচীনকালের ঐতিহ্য গৌরবে গর্বিত। এই সামন্ত রাজা বর্তমানে প্রাচীনকালে সকল মহিমা ও সামর্থ্য হারালেও তার দোর্দণ্ডপ্রতাপে দরিদ্র কুর্মী প্রজারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে না। এই সামন্তরাজার কাছে তার রাজত্বের অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মতো এই কুর্মী প্রজারাও সম্পত্তি বলেই গণ্য। অঞ্জনগড়ের অপর কোণে রয়েছে উদীয়মান ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি খনি-মালিকরা। এরাও খনি পরিচালনার স্বার্থে ঠিক যতটুকু তার বেশি এই সামন্ত রাজাকে পরোয়া করে না। কাঞ্চনমূল্যেই এর সবকিছু কিনে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করে এবং সর্বক্ষেত্রে সেই প্রচেষ্টা চালায়। অর্থের জোরেই তারা কুর্মী প্রভৃতি রাজ্যের আদিবাসী মানুষদের ছিনিয়ে আনতে চায় জমি থেকে, পরিণত করতে চায় খনি শ্রমিকে। খনির জন্য শ্রমের চাহিদার সমস্যার সমাধান তারা এইভাবেই করতে চায়।


সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি রাজা এবং ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধি খনি-মালিকরা দুই প্রান্তে অবস্থিত আর মাঝখানে রয়েছে কুর্মী, ভীল প্রভৃতি অন্ত্যজনেরা। এরা একদিকে নীরস মাটির বুকে ফসল ফলাতে গিয়ে সাধারণভাবে প্রকৃতির কার্পণ্যে এবং বিশেষভাবে অনগড়ের রাজার লুব্ধহস্তে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। সামন্ততান্ত্রিক শোষণের নিষ্করুণ রূপই অঞ্জনগড়ের রাজার সঙ্গে কুর্মী ও ভীল চাষীদের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজার অত্যাচারে ভীলরা দেশ থেকে পলাতক, আর কুর্মীরা জীবস্মৃত হয়ে সেখানে কোনক্রমে অস্তিত্ব বজায় রাখে।


এই অবস্থা অঞ্জনগড়ের নবাগত ল’ এজেণ্ট মুখার্জীর উদ্যোগে নতুন খনি খনন এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ঘটে। খনি ইজারা নিয়ে নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে রাজ্যে। গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন খনি-অঞ্চল, সামস্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও অভ্যুদয় ও বিকাশ ঘটতে থাকে। প্রথমদিকে অঞ্জনগড়ের রাজার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে খনিমালিকদের প্রদত্ত অর্থের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব নয় বলে এবং উভয়ের মধ্যে মৌলিক দ্বন্দ্ব অনিবার্য বলে বিরোধ ক্রমেই ঘনিয়ে উঠতে থাকে। জমি থেকে মুক্ত করে উৎপাদনের জন্য শ্রমিক সৃষ্টির যে প্রয়োজনীয়তা এবং তার ফলে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে যে সংঘাত ইউরোপীয় ধনতন্ত্রের বিকাশকালে লক্ষ্য করা যায় অনগড়ের ক্ষেত্রেও সেই সামাজিক সত্যের প্রকাশ অলক্ষ্যগোচর থাকে না। 'ফসিল' গল্পে অঞ্জনগড়ের রাজা ও খনিমালিকের যে সংঘর্ষ দেখা যায় বস্তুত তা অল্ড্রনগড়ের সাধারণ প্রজা কুর্মিদের নিয়েই। রাজা চান কুর্মি কৃষকদের জমির সঙ্গে বেঁধে রাখতে, বেগার খাটিয়ে বিনামূল্যে তাদের শ্রম আত্মসাৎ করতে। কিন্তু ঐ একই শ্রমশক্তি প্রয়োজন খনিমালিকদের, নগদ মজুরি দিয়ে তারা সেই শ্রম কিনতে চায়। তাই জমি থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে ঐ কুর্মিদের খনিশ্রমিকরূপে তারা পেতে চায়। ঠিক এই একই বিরোধের চিত্র শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড তথ্য ইউরোপে দেখা গিয়েছিল। এই সর্বজনীন সামাজিক সত্যেরই রূপটি 'ফসিল' গল্পের লেখক অঞ্চনগড়ের পটভূমিতে রূপায়িত করে তুলেছেন।


এটা হচ্ছে সামস্ততন্ত্র বনাম ধনতন্ত্রের বিরোধের একটা রূপ এবং প্রধানত সেই বিরোধ ঐ শ্রমশক্তি করায়ত্ত করার ব্যাপার নিয়ে। গল্প কিন্তু সেখানে শেষ হয়নি, আরও এক ধাপ এগিয়ে গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।


গল্পের প্রথমে পাওয়া যায়, অঞ্জনগড়ের রাজা নিজের প্রয়োজনেই ধনী খনি মালিকদের ডেকে নিয়ে এসেছিল। প্রাথমিক সৌহার্দ্য শীতের সকালের নরম রোদের মতো কিছুকালের মধ্যেই উবে যায় এবং উভয়ের মধ্যে অনিবার্য সংঘাত শুরু হয়। উভয়ের সম্পর্ক দাঁড়াল অহি-নকুল সম্পর্ক। কিন্তু আবার স্বার্থের প্রণোদনে, অস্তিত্ব রক্ষা ও বাণিজ্য রক্ষার প্রয়োজন শত্রুতাকে সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে পরস্পরে হাত মেলান। রাজার প্রহরীর গুলিতে কাঠসংগ্রহরত কুর্মি কৃষকদের মৃত্যু এবং খনি ধসে নিহত কুর্মি শ্রমিকের দল রাজা এবং বণিকগোষ্ঠীকে বিপদের আশঙ্কায় চিন্তিত করে তুলল। এই বিপদের দিনে সামত্ততন্ত্র ধনিকতন্ত্র সাময়িক সন্ধি করে ফেলল এবং কুর্মিদের দলনেতা দুলাল মাহাতোকে নির্মমভাবে হত্যা করে জঙ্গলে নিহত কুর্মিদের দেহ নিয়ে এসে খনির অন্যান্য মৃতদেহগুলির সঙ্গে খনি গর্ভে সমাধি দেওয়া হল এবং খনিমুখ চাপা দিয়ে দেওয়া হল চিরদিনের মতো। মহারাজা মুখার্জীকে বললেন, “মাহাতো ধরা পড়েছে মুখার্জী। ভাগ্যিস সময় থাকতে বুদ্ধিটা দিয়েছিলে।”


গিবসন সায় দিয়ে বলে, “নিশ্চয়, অনেক ক্লামজি ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচা গেল। আমাদের উভয়ের ভাগ্য ভাল বলতে হবে।”


‘ফসিল' গল্পে মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি মুখার্জী চরিত্রের মধ্য দিয়ে পেটিবুর্জোয়ার আদর্শবাদ, দোলাচলবৃত্তি, বিবেকের দংশন এবং শেষপর্যন্ত শক্তিমানের কাছে আত্মসমর্পণের একটি অত্যন্ত বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণি শক্তিমত্তার পরিচয় দিলে মুখার্জী হয়তো তাদের সঙ্গেই যোগ দিত, কিন্তু এ গল্পে তা ঘটেনি। সুতরাং মুখার্জী তার উদারনৈতিক দার্শনিক মনোভঙ্গি নিয়ে নিজে বিবেকের দংশন থেকে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছে ফেনিল মদের রঙিন নেশাকে ভর করে।