নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'অবতরণিকা' গল্পের আরতি চরিত্রটি আত্মস্বাতন্ত্র্যে ও আত্মমর্যাদাবোধে উজ্জ্বল- আলোচনা করো।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'অবতরণিকা' গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র আরতি। গল্পে বর্ণিত মধ্যবিত্ত পরিবারটির স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে মূলত আরতির চাকরি করাকে কেন্দ্র করে। সেদিক থেকে আরতিই এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আর ‘অবতরণিকা' গল্পের যে মূল প্রতিপাদ্য, অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে আপাত আধুনিকতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরোনো সংস্কার, অন্তঃসারহীন বংশমর্যাদাবোধ, সুবিধাবাদ, দোলাচল, মানসিক সংকীর্ণতা, সামস্ততান্ত্রিক মানসিকতা এবং নারীর প্রতি সেই সামন্ততান্ত্রিক কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রবণতা, এ সবের বিপরীতে একা দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়েছে আরতিকে। অতএব একদিকে আরতি একা, নিঃসঙ্গ, অন্যদিকে সে আত্মস্বাতন্ত্র্যে ও আত্মমর্যাদ বোধে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বময়ী। এ গল্পের নায়িকা তাই আরতিই।


গল্পের বিন্যাসে কিছুটা জটিলতা আছে। গল্প শুরু হয় আরতির চাকরি করা নিয়ে উদ্ভূত পারিবারিক বিরূপতা দিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে দেখানো হয় অতীতের ঘটনা। সেখানে দেখা যায়, সংসারের চাপ সামলাতে না পেরে স্বামী, সুব্রতই তাকে চাকরি করতে প্ররোচিত করেছিল একসময়। পরবর্তীকালে আরতির অফিসের চাপ বাড়তে থাকলে স্ত্রীর উপর স্বামীর কর্তৃত্বের সুযোগ ও অধিকার কমতে থাকলে প্রিয়গোপাল ও সরোজিনীর প্রাচীন পন্থার দোহাই দিয়ে এবং পারিবারিক শান্তির কথা বলে সুব্রত আরতিকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছে। গল্পটি ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়েছে। এর পরের আখ্যানবিস্তারে দেখি সাংসারিক বিপর্যয়। সুব্রতর চাকরি চলে যায় এবং সংসারটি আরতির আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু আত্মম প্রশ্নে তখন আরতি চাকরি ছেড়ে দিলে সুব্রতই আরতির এই মর্যাদাবোধকে সেন্টিমেন্টাল মনোভাব বলে ইঙ্গিত করে। শ্বশুর-শাশুড়ি স্বামীর এই সামস্ততান্ত্রিক ও সুবিধাবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে আরতির একার লড়াই এই গল্পের মূল বিষয়। গল্পের বিন্যাসটিকে যদি সরল করে নেওয়া যায়, তাহলে আরতি চরিত্রের অসাধারণত্ব কিছুটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ে কীভাবে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিত্বে স্বাতন্ত্র্যময়ী হয়ে ওঠে, যেন তারই আখ্যান রচিত হয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'অবতরণিকা' গল্পে।


আরতি এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা। তার বাবা নিবারণ ব্যানার্জী কোর্টে প্র্যাকটিস করেন। আরতি ম্যাট্রিকের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে বছরখানেক পড়েছিল। কিন্তু তারপরেই সুব্রতর সঙ্গে তার বিবাহ হয়ে যায়। সুব্রতর সঙ্গে আরতির এই বিবাহ বুঝিয়ে দেয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের একান্ত সাধারণ মেয়ে আরতি। মধ্যবিত্ত পিতার কথা ভেবেই বিবাহের পূর্বে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার বা স্বনির্ভর হয়ে ওঠার দাবি সে করেনি আধুনিকাদের মতো।


বিবাহের পর আরতির শ্বশুর বা শাশুড়ি চাননি তাদের পুত্রবধূ কলেজ শিক্ষা সম্পূর্ণ করুক। কন্যার উচ্চশিক্ষার ইচ্ছাকে তার পিতা পূর্ণ করতে চাইলেও শ্বশুর প্রিয়গোপাল সেই ইচ্ছাকে অস্বীকার করে বলেছিলেন—“বেয়াই মেয়েকে যা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন, আগে তাই হজম করতে পারি কিনা দেখি...।” অর্থাৎ শিক্ষিত পুত্রবধূর সঙ্গে সংসারে মানিয়ে চলার ব্যাপারে তিনি তির্যক মন্তব্য করে তাঁর প্রাচীনপন্থী মানসিকতাকেই প্রকাশ করেছিলেন। সরোজিনীও সংসারের সব দায়িত্ব আরতিকে বুঝিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, সংসারের চেয়ে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয় আর নেই। অতএব সুব্রতর সংসারে এসে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল আরতির। কিন্তু সেজন্য আরতির কোনো আক্ষেপ বা মানসিক অবসাদের পরিচয় গল্পে নেই। সাধারণ মেয়ে হিসাবেই সে মেনে নিয়েছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীর এই ভবিতব্য।


সুব্রতর সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতাও আরতির মনোবেদনার কারণ হয়নি কখনও। ঢাকা থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি ও তাঁদের তিন সন্তান তাদের সংসারের স্থায়ী সদস্য হয়ে উঠলেও আরতির কোনো অনুযোগ ছিল না। সংসারের খরচ কমাতে আরতি ধোবাকে না দিয়ে কাচাকাচি করেছে নিজে। তিনদিন নিরামিষের ব্যবস্থা করেছে। কয়লার খরচ বাঁচাতে গুল দিয়েছে নিজের হাতে। এ ব্যাপারে সুব্রতর সংসারকে সে যোগ্য গৃহিণীর মতোই বুক দিয়ে আগলেছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে প্রিয়গোপাল আবার দেশে ফিরে যাবার কথা প্রসঙ্গ ক্রমে তুললে আরতিই তাঁকে তাদের কাছে থেকে যেতে বলে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই। অতএব মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের উচ্চাকাঙাক্ষাহীন গৃহবদ্ধ সংসারসর্বস্ব বধূর সঙ্গে চরিত্রগত কোনো তফাত ছিল না আরতির।


এমনকি চাকরি করার স্বপ্নও সে কখনও দেখেনি। সরোজিনী বা প্রিয়গোপালের মতো সনাতনী প্রাচীন ধারণার বশবর্তী হয়ে নয়, আত্মবিশ্বাসের অভাবেই সে চাকরির ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু তখন সংসারের আর্থিক চাপ সামাল দেবার জন্য সুব্রতই তাকে চাকরির জন্য প্ররোচিত করেছিল। বলেছিল—“পুরুষ হোক, মেয়ে হোক আজকাল বসে খাওয়ার কি জো আছে কারো?” নিজে হাতে দরখাস্ত লিখে দিত সুব্রত, অফিসে সেই দরখাস্ত জমা দিয়ে আসত। মুখার্জী অ্যান্ড মুখার্জী ফার্মে নিজে আরতির সঙ্গে গিয়েছিল সুব্রত। চাকরি পাবার পরে কিছুদিন একসঙ্গে অফিসেও বেরোতো। প্রিয়গোপালের সঙ্গে এ নিয়ে মনোমালিন্যও করেছে সুব্রত আরতিক চাকরি করার প্রস্তাব নিয়ে।


কিন্তু সংসারে যেমন মনের যোগ ও নিষ্ঠা ছিল আরতির, অফিসের কাজেও সেই নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা দেখাতে গিয়েই সংসারের স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হল। এ জন্য আরতির কোনো দায় ছিল না। সে শুধু সাংসারিক সম্পর্ক ও সম্মানবোধকে ক্ষুণ্ন না করে কর্মজীবনের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে চেয়েছিল। চাকরির কাজে এই মনোযোগ ঈর্ষান্বিত করে তুলল সুব্রতকে। উভয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে লাগল দ্রুত। সুব্রতর ব্যবহারে প্রতিফলিত হতে লাগল তার বাবা প্রিয়গোপালের মানসিকতা। কিন্তু এবার সুব্রতর উপরোধ তীব্র প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করল আরতি। সে কখনোই চাকরি ছাড়বে না। তবু প্রথমটায় আরতিকে চাকরি ছাড়ার জন্য সুব্রতর বারবার চাপকে হালকা পরিহাসে উপেক্ষা করতে চাইত আরতি। কিন্তু সুব্রত চাপ বাড়াতে থাকলে আরতির মধ্যে বেড়ে গেল জেদ। তার এই জেদ ও সুব্রতর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তার পরিচয় ফুটে ওঠে।


কিন্তু এসব সত্ত্বেও সে সুব্রত বা শ্বশুর-শাশুড়িকে অসম্মান করতে চায়নি কখনও। মাথায় ঘোমটা দেবার ব্যাপারটিও বজায় রাখতে চেয়েছে সাধ্যমতো। কিন্তু চাকরি না ছাড়ায় সাংসারিক অশান্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাড়া-প্রতিবেশীর কু-ইঙ্গিত। কোন্ অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আরতিকে চা খেতে দেখা গেছে, তা নিয়েও প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আরতিকে। সুব্রত যখন ভদ্রতার মাত্রা অতিক্রম করে আরতির বাবার কাছে অভিযোগ করে আরতির পৃথক থাকার প্রস্তাব দিয়েছে, তখনও ধৈর্য না হারিয়ে আরতি অত্যন্ত সুবিবেচক ও বুদ্ধিমতীর মতো নিজের বাবাকে তাদের দাম্পত্য সমস্যা থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেছে।


কিন্তু এই নিবারণ-অযোগ্য সমস্যার সমাধান এল অবাঞ্ছিতভাবে। সুব্রতদের জয়লক্ষ্মী ব্যাংকে তালা পড়ল। চাকরি গেল সুব্রতর। আর আশ্চর্যজনকভাবে এরপরই সুব্রতর আচরণে তথা সুব্রত-আরতির সম্পর্কের উন্নতি ঘটে গেল। কেননা সংসার চালাতে এরপর আরতির উপার্জনটুকুই ভরসা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আত্মমর্যাদার প্রশ্নে চাকরি ছেড়ে দিল আরতি। এখানেও উন্মোচিত হল আরতির চরিত্রের আর এক উজ্জ্বল দিক। হিমাংশুবাবুর সঙ্গে তার কোনো গোলমাল না হলেও কোম্পানির এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্মচারী এডিথকে অসংগতভাবে অপমানিত করলে তার প্রতিবাদে মুখর হয় আরতি। অর্থাৎ আরতির আত্মসম্মানবোধ একদিকে যেমন প্রিয়গোপালের বংশমর্যাদাবোধের থেকে গুণগতভাবে অন্য মেরুর, তেমনি তার আর্থিক প্রতিষ্ঠা আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক নয়।


কিন্তু আরতির এই সম্মানবোধকে বুঝতে চায় না সুব্রতও। এডিথের অপমান যে তারও অপমান, সমস্ত নারীজাতির অপমান, সে ব্যাপারে স্বার্থকেন্দ্রিকতার জন্যই সচেতন হয় না পরিবারের কেউ। সাংসারিক স্বার্থবশতই সুব্রত চাকরিস্থলে যাবতীয় অসম্মান ও দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে আরতিকে মালিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পরামর্শ দিতে। আরতি আত্মমর্যাদার প্রশ্নে চাকরি ছেড়ে দিলে সাংসারিক প্রয়োজনের কথা ভেবেই সরোজিনী বিস্মিত হন। শেষ পর্যন্ত সরোজিনীর সঙ্গে সঙ্গে সুব্রতও যখন এডিথের চরিত্রের প্রতি কু-ইঙ্গিত করে বা নারীর এই আত্মমর্যাদার প্রশ্নকে আরতির বঙ্গনারীর সেন্টিমেন্ট বলে ব্যাখ্যা করে, তখন আরতি আশ্চর্য হয়ে যায়। অন্তত সুব্রতর এই সুবিধাবাদী ও স্বার্থসর্বস্ব সংকীর্ণ মানসিকতা তাকে বেদনার্ত করে তোলে।


অতএব সমগ্র গল্পে আরতি চরিত্রটি আসলে সম্পূর্ণ প্রতিকূল ও স্বার্থসর্বস্বতার আবহাওয়ায় একটি সাধারণ ব্যক্তিত্বহীন মধ্যবিত্ত নারীর আত্মনির্ভরতায় ও ব্যক্তিত্বে আত্মমর্যাদায় ও সংগ্রামী চেতনায় পূর্ণ বিকশিত হয়ে ওঠার কাহিনি। প্রতিকূলতার মাঝখানে সে সঙ্গীহীনা, একা। তবু সে অনমনীয়, অপরাহত।