'বাগবাজার এমেচার থিয়েটার' কিভাবে গঠিত হয়? এঁদের অভিনীত নাটক কি এবং প্রধান অভিনেতা কে? এই দলের নামান্তর কি হয়েছিল? এদের নাটক কোথায় কিভাবে মঞ্চস্থ হয়েছিল এবং জাতীয় নাট্যশালা স্থাপনের পশ্চাতে এঁদের অবদান নির্ণয়

“সাধারণ রঙ্গালয়ের উৎপত্তি ঘটনাচক্রে একটি সখের দল হইতেই হয়।” এই সখের দলটির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। সেখানে 'সধবার একাদশী'র অভিনয় দেখতে নাট্যকার কোন্ নটের অভিনয় দেখে স্বরচিত নাটকে কিছু সংযোজন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন?
কয়েকজন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী তরুণের নাট্যপ্রয়াস কিভাবে বাগবাজার এমেচার থিয়েটারের পূর্বসূচনা করেছিল তারই ইতিবৃত্ত লেখ।


'বাগবাজার এমেচার থিয়েটার' বাংলা নাট্যশালা ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম। পরবর্তী সময়ে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে 'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ' হয়। এই নাট্যশালাই পরবর্তীকালে কলকাতায় 'সাধারণ রঙ্গালয়ে পরিণত হয়।


ঊনবিংশ শতকের ছয়-এর দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন ধনীর গৃহে সৌখিন নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছিল এবং সেইসব নাট্যশালায় মাঝে মাঝে দুচারটি নাটকের অভিনয়ও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঠিক একই সময়ে বাগবাজারের কয়েকজন যুবকের মনেও নাট্যাভিনয়ের ইচ্ছা জাগে। এঁদের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রাধামাধব কর, ধর্মদাস এবং অর্ধেন্দুশেখর মুস্থাফির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে এঁরা সকলেই বিখ্যাত অভিনেতারূপে পরিচিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। থিয়েটার করার ইচ্ছে ও আগ্রহ থাকলেও মঞ্চনির্মাণ, দৃশ্যপট ও সাজসজ্জা সংগ্রহের প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় যাত্রা করবেন স্থির করেন। অভিনয়ের জন্য মধুসূদনের 'শর্মিষ্ঠা' নাটক নির্বাচন করা হল, প্রস্তুতিও চলছিল। কিছুদিন পর তাঁদের থিয়েটারের আগ্রহ প্রবল হয়ে উঠায় নূতন অভিনয়ের জন্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের ইচ্ছায় নির্বাচিত হল দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' নাটক।


বাগবাজার এমেচার থিয়েটার 'সধবার একাদশী' নাটকের প্রথম অভিনয় করে ১৮৬৮ সালের সপ্তমী পূজার রাত্রিতে বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জি পাড়ায় প্রাণকৃষ্ণ হালদারের বাড়িতে। নিমচাদের ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র এবং জীবনচন্দ্রের ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি অভিনয় করেন। যে গিরিশচন্দ্র পরবর্তী সময়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং নাট্যাচার্যরূপে বন্দিত হয়েছিলেন, তিনি এই ‘সধবার একাদশী’তে প্রথম অভিনয়েই দেশবাসীর অন্তরে স্থান করে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালের খ্যাতিমান অভিনেতা অমৃতলাল বসু এ সম্পর্কে লিখেছেন :

“মদমত্ত পদে টলে    নিমে দত্ত রঙ্গস্থলে,

প্রথমে দেখিল–নবনটগুরু তার।”


অল্পদিনের মধ্যেই আরও কয়েকবার অভিনয় হয় ‘সধবার একাদশী'। এই নাটকের চতুর্থ বার অভিনয় হয় পর বৎসর শ্রীপঞ্চমী রাত্রিতে রায় রামপ্রসাদ মিত্র বাহাদুরের বাড়িতে। নাট্যকার দীলবন্ধু মিত্র স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। এ সম্পর্কে ‘নটচূড়ামণি’ অর্ধেন্দুশেখর সম্পর্কে লিখেছেন : “ অর্ধেন্দুর জীবনচন্দ্রের ভূমিকা। জীবনচন্দ্রের অভিনয় দর্শনে সকলেই মুগ্ধ। স্বয়ং গ্রন্থকার অর্ধেন্দুকে বলেন, আপনি অটলকে যে লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন, ইহা improvement on the author –আমি এবার সধবার একাদশীর নূতন সংস্করণে অটলকে লাথি মারিয়া গমন লিখিয়া দিব'।” ‘সধবার একাদশী'র সপ্তম বা শেষ অভিনয় হয়েছিল ১৮৭২ সালে চোরবাগানে লক্ষ্মীনারায়ণ দত্তের বাড়িতে।


এই অভিনয়ের পর এক বৎসরের অধিক কাল বাগবাজার এমেচার থিয়েটার সংস্থা আর কোন নাটক অভিনয় করেনি। তবে অনেকদিন থেকেই দীনবন্ধু মিত্রের 'লীলাবতী' নাটকের রিহার্সাল চলছিল। 'লীলাবতী'র অভিনয় হয় ১৮৭২ সালের ১১ই মে তারিখে। পরবর্তী দুই শনিবারও এই নাটকের অভিনয় হয়। এই সময়েই বাগবাজার এমেচার থিয়েটার নাম পরিবর্তিত হয়ে 'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ' নাম হয়। শ্যামবাজারের রাজেন্দ্রনাথ পালের বাড়ির প্রাঙ্গণে রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল। অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিল: হরবিলাস–অর্ধেন্দু মুস্তাফি, ললিতমোহন— গিরিশচন্দ্র ঘোষ, হেমচাঁদ-নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লীলাবতী – সুরেশচন্দ্র মিত্র প্রভৃতি। এ সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র লিখেছেন : “দৃশ্যপটগুলি ধর্মদাসবাবুর তুলিতে অঙ্কিত, সামান্য চাঁদার অর্থে কার্য সম্পন্ন হইয়াছে, কিন্তু অভিনয়ের সুখ্যাতি এত বিস্তৃত যে দলে দলে লোক টিকিটের জন্য উমেদার।”


‘লীলাবতী'র অভিনয়ে জনসাধারণ প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছিল। এই অভিনয়ের পূর্বে চুঁচুড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রও বন্ধুবান্ধবদের উদ্যোগে 'লীলাবতী' অভিনয় হয়েছিল, দীনবন্ধু সেই অভিনয় দেখেছিলেন। কিন্তু পরে বাগবাজার এমেচার থিয়েটারের এই অভিনয় দেখে বলেছিলেন, “ তোমাদের অভিনয়ের সহিত চুঁচুড়া দলের তুলনাই হয় না, আমি পত্র লিখিব—দুয়ো বঙ্কিম।” পর পর তিনটি শনিবার ‘'লীলাবতী'র অভিনয় হওয়া সত্ত্বেও টিকিট না পাওয়ায় বহু লোক ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই থেকেই বোঝা যায় যে 'লীলাবতী'র অভিনয় কতটা জনপ্রিয় এবং জনসাধারণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।


সাধারণ রঙ্গালয় ন্যাশনাল থিয়েটারের জন্ম এই বাগবাজার এমেচার থিয়েটার নামে সখের দল এবং তাঁদের নাট্যানুষ্ঠানের প্রয়াসের মধ্য দিয়েই। সখের দল হলেও বাগবাজার এমেচার থিয়েটার দলের কার্যপ্রণালীর সঙ্গে পূর্ববর্তী সখের দলগুলির একটা মৌলিক পার্থক্য ছিল। 'হিন্দু থিয়েটার' থেকে সুরু করে জোড়াসাঁকো থিয়েটার বা মেট্রোপলিটান থিয়েটার পর্যন্ত বিভিন্ন নাট্যশালাগুলির প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল এক একজন অভিজাত ধনী ব্যক্তির উৎসাহে ও আর্থিক সাহায্য ও অনুকূল্যে। নাট্যশালাগুলি স্থাপিত হয়েছিল ঐসব ধনীদের নিজ নিজ বাড়িতে। এইসব নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত নাটকাভিনয়ে জনসাধারণের প্রবেশাধিাির ছিল না। কেবলমাত্র সম্ভ্রান্ত অভিজাত মানুষই সেখানে আমন্ত্রিত হতেন। তাছাড়া এই সব নাট্যশালা ও অভিনয় ধনীদের খেয়াল বা হুজুকের ফলেই হত বলে এই জাতীয় অনুষ্ঠানগুলির ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তির মৃত্যু বা উৎসাহে ভাটা পড়লে এগুলি বন্ধ হয়ে যেত এবং পরবর্তী অপর কোন ঐ রকম আগ্রহী উৎসাহী ধনী ব্যক্তির আগমন না হওয়া পর্যন্ত নাট্যানুষ্ঠান বন্ধ থাকত। তাই 'শকুন্তলা' থেকে শুরু করে জোড়াসাঁকে থিয়েটারের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ বা ‘নবনাটক' পর্যন্ত বিভিন্ন নাটকের অভিনয় যতই ভাল ও সার্থক হোক না কেন, ঐসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণের যোগ না থাকার সমকালীন পত্র-পত্রিকায় এদেশে একটি সাধারণ রঙ্গালয়ের অভাব সম্পর্কে অভিযোগ এবং ব্যাকুলতার প্রকাশ দেখা যায়।


এই অভাব পূরণ ও ব্যাকুলতার দূরীকরণ সম্ভব করেছিল বাগবাজার এমেচার থিয়েটারের সথের দল। অবশ্য এদের পূর্বে ১৮৬০ সালের প্রথমদিকে আহিরীটোলার রাধামাধব হালদার এবং যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় “দি ক্যালকাটা পাবলিক থিয়েটার' নামে জনসাধারণের জন্য একটি সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। বাগবাজারের এই সখের দলই ‘ন্যাশনাল থিয়েটার' নাম দিয়ে কলকাতায় প্রথম পেশাদারি সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপন করে। এই দলের আর্থিক সঙ্গতি কম ছিল তাই এঁরা ঠিক করেছিলেন টিকিট বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ দিয়েই পরবর্তী নাট্যানুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করবেন। অভিনেতা ও কলাকুশলীদের ব্যক্তিগত উপার্জন বা অভিনয়কে পেশারূপে গ্রহণ তখনও দলের সদস্যদের মাথায় আসেনি। কিন্তু ‘লীলাবতী’ নাটকের আশাতীত সাফল্যে এবং টিকিট বিক্রয়ের ফলে সংগৃহীত অর্থ প্রচুর হওয়ায় এদের মধ্যে প্রধান উদ্যোক্তা নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের পরিকল্পনা জাগে—যেখানে অভিনয় অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা থাকবে, অর্থাৎ নিয়মিত অভিনয় হবে। আর টিকিট বিক্রয়ের অর্থ থেকে অভিনয় অনুষ্ঠানের ব্যয়নির্বাহ এবং নিজেদের অর্থ উপার্জনও হবে। এই পরিকল্পনাই পরিশেষে সাধারণ রঙ্গালয় তথা ন্যাশন্যাল থিয়েটারের জন্ম দিয়েছিল ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাট্যাভিনয় দিয়ে আপার চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের বাড়িতে।