'স্টীলের চঞ্চু' গল্পের নামকরণ যথার্থ হয়েছে কি না আলোচনা কর।

গল্প বা উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় যে, উপন্যাস বা গল্পের কোনো চরিত্র বা আলম্বন বিভাব কিম্বা মূল বক্তব্য বা সংশ্লিষ্ট মুখ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে রচয়িতারা তার নামকরণ করে থাকেন। কিন্তু সাধন চট্টোপাধ্যায়ের 'স্টীলের চঞ্চু' গল্পটির নামকরণ সেই ভাবে হয় নি। এখানে গল্পের চরিত্র বা ঘটনার সঙ্গে তার নামকরণের কোনো সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। কেবল গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুনুর অসুস্থ আশংকা অবলম্বনে গৃহীত হয়েছে গল্পের নাম।


ভূপতি বাঁড়ুজ্জের ছেলে রুনু, পড়াশোনায় বেশ ভালো ছেলে ছিল। স্কুলে উল্লেখযোগ্য নম্বর সহযোগে পাশ করার পর যখন কলেজে ভর্তি হয়েছিল, তখনও সে বই আর পড়াশোনা ছাড়া কিছু বুঝতো না। এমনকি কমনরুমে আড্ডাও মারতো না। বি.এস.সি. পাশ করার পর নিজেই রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে রেলের অ্যাকাউন্ট ক্লার্ক হিসেবে চাকরি পেয়েছিল সে। তারপর কোনো কারণে সে মানসিক রোগগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তখন থেকে সে সমাজের উপকারের কথা ভাবতে শুরু করে। তখন থেকে সে তার পিতা ভূপতি কে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করতে থাকে। এবং ভূপতিকে নানা ভাবে অপদস্থ করেই সে 'মড়া আগলে বসে থাকা সমাজকে শাস্তি দিতে চায়।


রুনুর পিতা ভূপতি ছা-পোষা মধ্যবিত্ত মানুষ। স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি সংসারে অর্থ উপার্জনের জন্যে সেচ ইঞ্জিনিয়ারের হকারী থেকে শুরু করে ট্রামের কণ্ডাকটরি পর্যন্ত বিভিন্ন জীবিকায় ঘুরেছেন। অধিক বয়সে কলেজে ভর্তি হয়ে, আবেগের বিপুল বাতাসে উড়ে কলেজের পড়া সাঙ্গ করেই ঝাঁপিয়ে ছিলেন দেশের কাজে। কাজের মধ্যে দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের মুক্তি মানুষের মধ্যেই তাকে সেবা, রাজনীতি, দায়বদ্ধতা যে নামই দেওয়া হোক না কেন— এই হল কমরেডদের সার কথা। অর্থাৎ সুবিধাবাদী রাজনীতিক তিনি ছিলেন না। সেই জন্যেই এলাকার ইতিহাসে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। সেই ভূপতি বাঁড়ুজ্জের ছেলে রুনু, স্কুল কলেজ জীবনে রাজনীতির পাঠ যার কিছু মাত্র ছিল না, হঠাৎ সে সমাজের ভাবনা ভাবতে শুরু করলো। তাদের ভাবনা আর কর্মের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। তারা মনে করে একরাত্রের মধ্যেই বিপ্লবের পথে সমাজের পরিবর্তন আসবে। বাবা-মা-ছেলে মেয়ে এই সব ফিউডাল সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার সরিক না হয়ে, ক্যামোফ্রেজে সমাজের সেবা করে তারা নতুন যুগ আনবে। অথচ, তাদের পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত পলিটব্যুরোর প্রেসিডেন্ট, তাঁর সংসারের চাল-ডাল-আনাজ কিনে দিয়ে যেতে বলেন অন্য দুজন সদস্যকে। তাঁরা চা খান, বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার সরিক ফিউডাল সম্পর্কে বাবা হন এমন একজনের পকেট মেরে। দ্বিতীয় সদস্য মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে অফিস ডুব মারেন। এই জীবনাচরণ ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রুনু। তাই সে অফিসে যায় না, বুর্জোয়া ডাক্তারের ওষুধ খায়। ফিউডাল সম্পর্কে আশ্রিত মা-কে দাসীর মতো খাটায়। খাওয়ার সময় তাঁকে ওষুধ ও জল হাতে দাঁড় করিয়ে রাখে। বিভূতির রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক আদর্শের অনেক প্রভেদ। রুনুর কাছে ‘সেবা, হেল্প, মানে পচা সমাজকে টিকিয়ে রাখা। তারা মনে করে আমাদের সায়েন্টিফিক হওয়া দরকার'।


সমাজ নিয়ে ভাবিত রুনু একদিন দেখতে পায় তার বাড়ির সামনের গাছটার কঙ্কাল-ডালে একটা কাক বসে চতুর্দিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছে। তার সন্ধানী-চোখজোড়া ঝকঝক করছে। তার চঞ্চু স্টীলের মতো চকচক করছে। সেই কঠিন স্টীলের চঞ্চু দিয়ে একটু আগেই বোধ হয় একটা ইঁদুর ধরেছিল, তার তাজা রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। এখন সে খুঁজছে শিশুদের যকৃৎ। ঘরে ঘরে বাপ মায়েরা কত নিশ্চিন্তে আছে। এই দৃশ্যটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। গোটা সমাজকে খুবলে খাবে বলেই যেন বসে আছে এই কাক তার তীক্ষ্ণ কঠিন স্টীলের চঞ্চু নিয়ে।


রুনুর এই আশংকার ওপর ভর করেই আলোচ্য গল্পের নামকরণ করা হয়েছে ‘স্টীলের চঞ্চু'। এই নামকরণ তখনই সার্থক হয়ে ওঠে, যখন সেই কাকের জন্যেই মরতে হয় রুনুর মতো ভ্রান্তপথের বিপ্লবীকে— জনগনের সেবাকে যারা মড়া আগলে রাখার মতো কাজ বলে মনে করে। কাক তার চঞ্চুতে যেমন আবর্জনা পরিস্কার করে দেয়, তেমনি রাজনীতির আঙিনায় রুনুর মতো আবর্জনাকে পরিস্কার করছে রুনুর দেখা কাক তার কঠিন স্টীলের চঞ্চু দিয়ে।


শুধু রাজনীতি নয়, সমাজের ক্ষেত্রেও রুনুদের মতাদর্শ আবর্জনারই নামান্তর। তারা রোগীর সেবা করতে পারে না। অসুস্থ বাপকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখে। অকারণে ইচ্ছে করে কাজে ফাঁকি দিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটায়। চুরি করে। অন্যের ওপর নিজের দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ার। মানবতার কথা বলে, অথচ নিজের প্রয়োজনে বাবা-মায়ের সঙ্গে পর্যন্ত ক্রীতদাস দাসীর মতো আচরণ করে। এদের মতো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে পরিস্কার বলে মানতে পারা যায় না। তাই কাকের চঞ্চুতে এরা পরিস্কৃত হয়। সমাজের বুক থেকে। কারো কারো মতে আলোচ্য গল্পের নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখকের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়েছে। রুনুদের রাজনৈতির আদর্শের সঙ্গে আচরণের দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, সমালোচকদের উক্ত মন্তব্যের পক্ষে মত দান করা যায়।