রূপক নাটকের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে যে কোনও একটি বাঙলা রূপক নাটক সম্বন্ধে আলোচনা কর।

রূপক নাটকের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে হলে প্রথমেই রূপকের স্বরূপধর্ম পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। ইংরেজিতে allegory বলতে যা বোঝায়, বাঙলায় তাকেই আমরা 'রূপকা বলি। কোনও চিন্তা, তত্ত্ব বা নীতিকে যখন মূর্তিস্বরূপতায় প্রকাশ করা হয়, আমরা তখন রূপকের উদাহরণ পাই, যেমন, ঈশপের গল্পে বা পঞ্চতন্ত্রের উপাখ্যানে শৃগাল মানুষের ধূর্ততার প্রতিরূপ। রূপকে প্রতিরূপ এবং তার পশ্চাদপটের তত্ত্ব বা নীতিকে পাশাপাশি সুস্পষ্টরূপেই লক্ষ্য করা যায়, কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে, রূপকের মধ্যে নিহিত লেখকের অভিপ্রেত অর্থ পাঠকদের কাছে স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষভাবেই ধরা দেয়। গ্যেটে রূপকের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন: "Allegory transforms the phenomenon into a concept, the concept into an image ; but in such a way that in the image the concept may even be preserved, circumscribed and complete at hand and expressible.” রূপকের উৎস ধর্মীয় ভাবনায়। প্রাচীন যুগের দার্শনিক ধর্মশাস্ত্রের ভাষ্যকার খ্রীষ্টান ধর্মযাজকেরা ও মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ববিদরা এই পৃথিবীকে ঈশ্বরের প্রতীক-পুস্তকরূপে দেখেছেন, জগৎ একটি অন্তনির্হিত অর্থের (nucleus) বহিরাবরণ (cortex)। সেইজন্যই প্রাচীন যুগ থেকে ধর্মশাস্ত্রে ও তার ব্যাখ্যায় রূপকের ব্যাপক প্রাধান্য চোখে পড়ে। বাইবেলের প্রতিটি কাহিনীই তো রূপক। স্বভাবতই প্রাচীনকাল থেকে সাহিত্যে রূপকের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। গ্রীক ও ল্যাটিন রঙ্গনাট্য বহুল পরিমাণে রূপকধর্মী। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত লেখক বানিয়ানের Pilgrim's Progress রূপকাকারে পাপ, প্রলোভন ও ভক্তি-পুণ্য প্রভৃতির মধ্য দিয়ে মানবাত্মার তীর্থযাত্রার কাহিনী। রূপক নাটকেও আমরা রূপকের বা মূর্তিস্বরূপের (personification) মধ্যে তার রূপকার্থ বা তত্ত্ব নীতি ইত্যাদিকে সুস্পষ্ট ও প্রত্যক্ষরূপে ফুটে উঠতে দেখি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত, সেই বিখ্যাত জার্মান লেখক হাউপ্টম্যানের নাটকগুলি রূপকধর্মী। ইবসেন বাস্তবতাপ্রধান নাটক রচনার জন্যই বিখ্যাত, কিন্তু তিনি কয়েকটি রূপক নাটকও রচনা করেছিলেন। তাঁর Peer Gynt নাটকে একজন সাধারণ মানুষের নিজের প্রকৃত সত্তা অন্বেষণের রূপক কাহিনী উপস্থাপিত হয়েছে। The Wild Duck নাটকে পঙ্গু হাঁসকে দরিদ্র মানুষদের রূপক হয়ে উঠতে দেখি। জার্মানির ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত নাট্যকার Friedrich Hebbel-এর Judith (১৮৪০) নাটকে প্রাচ্য স্বেচ্ছাচারতন্ত্র, পার্থিব মূল্যবোধের এবং ইহুদিধর্মের গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধের রূপকরূপে প্রদর্শিত। তাঁর Maria Magdalene (১৮৪৪), যার উপজীব্য বাইবেলের কাহিনী ও Herod and Mariamne (১৮৫০) ও রূপক নাটক। রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ ও ‘মুক্তধারা’কে আমরা রূপক নাটকরূপে চিহ্নিত করতে পারি, কারণ তাদের রূপকে নিহিত তত্ত্ব আমাদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। ইংল্যান্ডের মধ্যযুগের মরালিটি নাটকগুলিকে রূপক নাট্য বলা চলে, এই রচনাগুলিতে দয়া, ধর্ম, লোভ, লালসা, সত্য প্রভৃতিকে মানুষের রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অচলায়তনে’ (১৩১৮) অর্থহীন সংস্কার, বিশ্বাস ও যুক্তিবিচারবোধবর্জিত আচার প্রথার নাগপাশে আবদ্ধ সমাজের বিকৃতি ও মনুষ্যত্বহীনতা উদ্ঘাটিত করে দেখিয়েছেন। এই নাটকের মহাপঞ্চক ও তার অনুচরেরা সমাজের তথাকথিত নীচ ও অস্পৃশ্য সাধারণ মানুষদের দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের শুচিতা রক্ষার জন্য আচারবিচারের নিয়ম মন্ত্রতন্ত্রের দ্বারা গন্ডিবদ্ধ অচলায়তনে নিজেদের ও অন্যান্যদের বন্দী ও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সমগ্র নাটকে অচলায়তন তারই রূপক বা প্রতিরূপ হিসেবে উপস্থাপিত। তার মধ্যে আচার্যের মত ক্ষমাপরায়ণ এবং পঞ্চকের ন্যায় জীবনীশক্তিসমৃদ্ধ পুরুষ স্থান পায় নি। রবীন্দ্রনাথের নিজেরই বহু কথিত জড়শক্তির বিরুদ্ধে প্রাণশক্তির সংগ্রাম এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু। কবি বলেছেন, “আচারই ধর্ম নহে, বাহ্যিকতায় অন্তরের ক্ষুধা মেটে না, এবং নিরর্থক অনুষ্ঠান মুক্তির পথ নহে, তাহা বন্ধন।” জড় অভ্যাসের প্রভাবে মানুষ আচার-অনুষ্ঠানের গন্ডি-বহির্ভূত ধর্মের সহজ রূপটি উপলব্ধি করতে না পেরে নিয়ম, আচার-বিচারকেই একমাত্র সত্য মনে করে, সেই বন্ধনপীড়িত মানবাত্মার আকুতি পঞ্চকের মুক্তিতৃষ্ণায় অভিব্যক্ত। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই চরিত্রটি সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন : “প্রবহমানা নির্ঝরিণীর সঙ্গে স্রোতোবিরোধী শিলাখন্ডের, মুক্ত আকাশে বিহার-বিলাসী পাখীর সহিত লৌহপিঞ্জরে যে ক্ষুব্ধ, বাধাব্যথিত সম্পর্ক, পঞ্চকের চিরকিশোর, দিগন্তসন্ধানী তরুণ প্রাণোচ্ছলতার সহিত আশ্রমে বিধিনিষেধ বিড়ম্বিত, শ্বাসরোধকারী পরিবেশেরও ঠিক সেই সম্পর্ক। যে প্রতি মুহূর্তে আশ্রমের শাসনশৃংখলকে অস্বীকার করিতে চাহিয়াছে, প্রতি মুহূর্তে আশ্রম চর্যার সহিত তাহার মুক্তি ব্যাকুলতার রক্তাক্ত সংগ্রাম ঘটিয়াছে, কিন্তু এই উতলা মনোভাব, এই অনিৰ্দেশ্য আকৃতি নিজশক্তিতে কোন নিষ্ক্ৰমণ পথ রচনা করিতে পারে নাই।”


পঞ্চককে অচলায়তন থেকে বন্ধনমুক্তির জন্য নির্ভর করিতে হয়েছিল গুরুর ওপর। এই নাটকে তাঁর চরিত্র সর্বশক্তির উৎসরূপে পরিকল্পিত। তিনি তিনটি রূপে প্রতিভাত : অচলায়তনের গুরু শোনপাংশুদের কাছে দাদাঠাকুর এবং দর্ভকদের কাছে গোসাঁই। 'অচলায়তনে'র সূত্রপাত থেকেই গুরুর আবির্ভাব সম্পর্কে কৌতূহল ও উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা জাগিয়ে তোলা হয়েছে। মহাপঞ্চকের কাছে গুরু যোদ্ধার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, কিন্তু শঙ্খবাদক ও মালীর কাছে তিনি ধরা দিয়েছেন। সহজরূপে। অচলায়তনের শুষ্ক আচারের মরুভূমির মধ্যে শঙ্খবাদক ও মালী শঙ্খ ও ফুলের মধ্য দিয়ে সহজ-সরল জীবনসত্য ও সৌন্দর্যের সাধনা করে চলেছিল, সেইজন্যই তারা গুরুকে চিনতে পেরেছিল। গুরু ঈশ্বর বা ধর্মের প্রকৃত সত্যের মূর্তিস্বরূপ। অচলায়তনকে চূর্ণ করে তিনি মহাপঞ্চকেরও হৃদয় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। শোনপাংশুরা গতিশীল কর্মচক্রে সদাই ঘূর্ণমান, বৈষয়িক উন্নতি সাধনের কর্মযজ্ঞের ও ইয়োরোপীয় জাতির মূর্তিস্বরূপ (Personification)। দাদাঠাকুর তাদের উৎসবজীবনের পুরোধা ও নিয়ামকরূপে উপস্থাপিত ; কিন্তু তাঁর সঙ্গে শোনপাংশুদের সম্পর্কের যোগসূত্রটি নাটকে স্পষ্ট হয় নি। ‘অচলায়তনে’র আর একটি ত্রুটি, মহাপঞ্চকের দৃঢ়তাপূর্ণ সংগ্রামশীল ব্যক্তিত্বদীপ্ত চরিত্রটির তুলনায় পঞ্চকের চরিত্র নীরক্ত, দীপ্তিহীন। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে হিন্দু সমাজের অন্ধ-সংস্কার, বিশ্বাস ও আচার-বিচারের সমালোচনা করেছেন, তাঁর সমালোচনা মাঝে মাঝে অত্যন্ত বিদ্রূপতীক্ষ্ণ এবং তার নৈতিক উদ্দেশ্য অতিমাত্রায় প্রকট হয়ে পড়েছে; এটাও রূপক নাটক হিসেবে অচলায়তনের ত্রুটি। দর্ভকরা হিন্দুসমাজের অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য অংশ, সরল, অনার্য জাতি, তারা ভক্তি ভাবরসে বিভোর, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দোচ্ছলতায় নাচেগানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। তাদের সরল ভক্তি, বিশ্বাস ও একান্ত আত্মনিবেদনের কাছেই গুরু গোঁসাইরূপে ধরা দিয়েছেন। অচলায়তনে এই মানুষগুলির ভক্তিপ্রাণতাই জয়ী হয়েছে।