জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর 'চোর' গল্পটি সমকালীন শ্রেণিবিভক্ত সামাজিক সম্পর্কের অন্তর্গত জটিল প্রবাহটিকেই উদঘাটিত করেছে— আলোচনা করো।

বাংলার সমাজ মানস ও মূল্যবোধের ওপর বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট যে ভাঙন সূচিত করেছিল, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর কথাসাহিত্যে সেই ভাঙনেরই ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর গল্প উপন্যাসে বারবার উঠে আসে জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া, আত্মসমর্পিত, দুমড়ানো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ। যে সমাজ বিত্তের মানদণ্ডে বিভাজিত, যেখানে স্বভাবতই বাহ্য জৌলুষ ও কৃত্রিম আড়ম্বরই সামাজিক সম্মানের সূচক। এ সমাজে সেই কৃত্রিম চাকচিক্য ও স্বপ্নসুখের প্রলোভনে বিভ্রান্ত নিম্নস্তরবর্তী সব মানুষ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখানে আবেগবর্জিত, প্রীতি-স্নেহ-আন্তরিকতাশূন্য। আসলে এ সমাজে সমস্ত সম্পর্কই অর্থমূল্যের দ্বারা, স্বার্থসম্বন্ধের দ্বারা এবং সুবিধাবাদের দ্বারা নির্ণীত। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পটিতেও সমকালীন সমাজের এই স্বার্থসর্বস্ব নগ্ন চেহারাটি ও পারস্পরিক সম্পর্কের পিছনে সুবিধাবাদের প্রলোভনটি উদ্ঘাটিত হয়েছে।


‘চোর’ গল্পে প্রধান চরিত্র তিনটি—মিন্টু, মদন এবং সুকুমার। গল্পের চরিত্র হিসাবে এই তিনটি বালকের বিশেষত্ব বা বিশিষ্টতা এ গল্পে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ এই বালক তিনটির শ্রেণিগত অবস্থান। সুকুমার বিত্তবান পরিবারের সন্তান, তার বাবা বড়ো ব্যারিস্টার, তাদের গাড়ি, বাড়ি, বিশাল বাগান, চাকর-বাকর-দরোয়ান মালী আছে। মিন্টু এই গল্পের কথক। সে সুকুমারদের প্রতিবেশী। কিন্তু বিত্তের মানদণ্ডে মিন্টু মধ্যবিত্তের সস্তান। মিন্টুর বাবা সামান্য কেরানী। ঘরে কাজকর্মের জন্য আলাদা লোক রাখার সাধ্য তাঁর নেই। কিন্তু হৃদয় তাঁর আছে। তাই অসহায় মদনকে অসুবিধার মধ্যেও তিনি বহাল করেন। মদন খেটে খাওয়া মানুষ, অর্থাৎ নিম্নবিত্ত। কিংবা বলা যায়, তার কোন বিত্তই নেই কেবল শ্রমশক্তি ছাড়া।


গল্পের কথক মধ্যবিত্ত সন্তান মিন্টু নিজ অবস্থান সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। ব্যারিস্টারের ছেলে সুকুমারের সঙ্গে নিজের পার্থক্য সম্বন্ধে সে ভাবে ওরা বড়লোক, আমরা গরীব। আমরা খালি পায়ে স্কুলে আসি, আমাদের জামাপ্যান্ট ময়লা ছেঁড়া।' মিন্টুর বাবাও মদনকে বলেছেন—'আমি গরীব কেরানী মানুষ। কিন্তু গরীব মানুষ হলেও মানবিকতার বোধ তাঁদের আছে তাই অসহায় মদন যখন চাকরী খুইয়ে মিন্টুদের দরজায় এসে দাঁড়ায়, তখন অসুবিধে থাকলেও মিন্টুর বাবা-মা তাকে ফেরান না। মিন্টুও নিম্নবিত্ত এই ছেলেটিকে বন্ধুর মতোই আপন করে নেয়।


মদন শ্রমজীবী বালক। শৈশব থেকেই সে পৃথিবীকে চিনে নিয়েছে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক সূতোয় বাঁধা একটি ক্ষেত্র হিসাবে। সুকুমারদের বাড়ি সে কাজ করত। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য সেই অন্ন সংস্থানের সুযোগটুকু সুকুমাররা অনায়াসে কেড়ে নেয় বলে একটি শ্রেণিগত ক্রোধ জন্ম নেয় তাঁর মধ্যে। ওদের বাগানের সুন্দর সাজানো ফুল ফলের গাছগুলো দুমড়ে-মুচড়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। ওদের বাগানের গাছ চুরি করে আনার চক্রান্ত করে মদন। মদনের এই ইচ্ছায় প্রভাবিত হয় মিন্টুও। সেও সুকুমারদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে মদনের প্রতি সহমর্মিতা বশত। কিন্তু মদন সুকুমারের গায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে কাদাজল ছিটিয়ে দেওয়ায় ধরা পড়লে উদ্বিগ্ন হলেও মিন্টুর বাবা কিন্তু সুকুমারদের বাড়ি যান না। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও তাঁদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল। তাই তিনি সুকুমারদের বাড়ি নিয়ে না গিয়ে মিন্টুকেই পাঠান মদনের সংবাদ নেবার জন্য।


সমকালীন শ্রেণি সম্পর্কের বিচিত্র চেহারাটা এরপরেই প্রকাশিত হয়। মিন্টু দেখতে পায় পূর্ব শত্রুতা ও সমস্ত ক্রোধ অনায়াসে ভুলে গিয়ে মদন সুকুমারদের বাড়িতে পুনর্বহাল হয়েছে। মদন কণ্ঠাহীনভাবেই জানিয়েও দেয় যে, সে মিন্টুদের বাড়ি আর কাজ করবে না। কারণ সুকুমারদের বাড়িতে সে আবার কাজ পেয়ে গেছে।


মদনের এই অকৃতজ্ঞ আচরণে মিন্টু তখন ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু কয়েকমাস পরে সুকুমারের সঙ্গে বই দেওয়া নেওয়া নিয়ে ঘনিষ্ঠতা ও তাদের বাড়ি যাতায়াত শুরু হলে মিন্টু আবিষ্কার করে যে, সুকুমারদের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য, আদর-যত্ন, সুন্দর বাগান, ঝকঝকে বাড়ি ইত্যাদি সবই যেন প্রলোভিত করছে বা আকর্ষণ করেছে তাকে। অর্থাৎ প্রত্যেকটা শ্রেণিই যেন সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, প্রাচুর্য্য বৈভবের প্রতি লোভীর মতো ঊর্ধমুখী। শুধু মদন সুকুমারদের বৈভবের টানে ছুটে যায় না, মিন্টুকেও সেই বৈভব আকর্ষণ করে।


মিন্টুর মধ্যবিত্ত শ্রেণিসচেতনতা এই মোহটিকে আবিষ্কার করে আত্মধিক্কারে নিজেকে সরিয়ে আনে। মোহছিন্ন করার তাগিদে সে সুকুমারদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে। কিন্তু নিম্নবিত্ত মদনের এই আত্মসম্মানবোধের বিলাসিতা নেই। সে সর্বহারা। সে অস্তিত্বের তাগিদে উচ্চতর কোনো শ্রেণির আশ্রয়ের সন্ধান করে। মধ্যবিত্ত কেরানী মিন্টুর বাবা যখন তার আশ্রয়দাতা, তখন সে তার আশ্রিত ও অনুগত। কিন্তু আরো লোভনীয় সুখ ও বৈভবের সন্ধান পেলে সে অতি অনায়াসে মিন্টুদের ত্যাগ করে যায়। এই স্বভাবগত মোহ বা লোভ মধ্যবিত্ত নিজের মধ্যেও মাঝে মাঝে আবিষ্কার করে। মিন্টু নিজের মধ্যে এই লোভটিকে আবিষ্কার করেই ভীত হয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র গল্পটিতে বহুবিভক্ত সমাজ কাঠামোর পারস্পরিক শ্রেণি-সম্পর্কের জটিল প্রবাহটিকেই গল্পকার রূপায়িত করেছেন।