‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনের কর্তামশাই বা নবকুমারের পিতার চরিত্র আলোচনা করো।

মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে নবকুমারের পিতা কর্তামহাশয় রূপে অভিহিত। তাঁর কোনো নাম দেওয়া হয়নি; চরিত্রটি স্বল্প রেখায় অঙ্কিত, কিন্তু চরিত্রগত পূর্ণতা অনুপস্থিত নয়। কর্তামশাইয়ের চরিত্রবৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে অশোককুমার মিশ্র তাঁর 'বাংলা প্রহসনের ইতিহাস' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—“নবকুমারের পিতা কর্তামশায়ের চরিত্র ঘোর প্রাচ্যপন্থী চরিত্রদের প্রতিনিধিত্ব করছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত একদল মানুষ অন্ধভাবে বিদেশিয়ানার অনুসরণ করতে শুরু করলে ধর্মসভার পৃষ্ঠপোষকতাধন্য গোঁড়া হিন্দুসমাজ অন্ধ প্রাচ্যপন্থী মনোভাব প্রদর্শন করতে থাকে। কর্তামশায়ের চরিত্রে প্রকাশিত হয়েছে সমাজের সেই অংশের চিত্র। পরম বৈষ্ণব কর্তামশায় অধিকাংশ সময় বৃন্দাবনে বাস করেন। স্বাভাবিক কারণেই বৈষ্ণবশাস্ত্রের সম্পর্কে তাঁর ভাবালুতার প্রকাশ ঘটেছে।”


প্রহসনটি থেকে জানা যায়, কর্তামশায় বৃন্দাবনে বাস করেন, কখনো কখনো কলকাতায় এলে আপন বাসভবনে বাস করেন। নাটকের আরম্ভে কর্তামশায় কলকাতায় এলে নবকুমার অসুবিধায় পড়েন এবং তেমনই এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে নাট্যঘটনার সূত্রপাত। কলকাতা সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি কলকাতাকে ‘বিষম ঠাঁই' বলে মনে করেন। তাঁর কাছে কলকাতা হল পাপ ও দুর্নীতির সহাবস্থানের কেন্দ্রভূমি। তাই কলকাতা এলে নবকে চোখের আড়াল করেন না; তিনি অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং নবকুমার সম্পর্কে তাঁর ধারণা অসত্য প্রমাণিত হয়নি। পুত্রের সম্পর্কে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও তিনি পুত্রের অধঃপতন রোধ করতে পারেননি। পুত্রকে তিনি মনে করেছেন ‘কুলাঙ্গার' এবং আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়ে পুনরায় বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।


যথার্থ বৈষ্ণব কর্তামশাই-এর চরিত্রে কোনো অসঙ্গতি নেই এবং প্রহসনটিতে মধুসূদন তাঁকে কোনো ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেননি। কর্তামশাই-এর চরিত্র ভাবাকুলতা ও বাস্তবতা উভয়ের সংমিশ্রণে গঠিত। তিনি দর্শকদের হৃদয়াসনে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত। কলকাতার অন্যান্য বৈষ্ণবভাবাপন্ন মানুষজন তাঁর অজানা নয়। বৈষ্ণবজনদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাভক্তি অসীম। নবকুমারের বন্ধু কালীনাথের জনৈক খুল্লতাত বাঁশবেড়ের কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ পরম বৈষ্ণব ছিলেন, বৃন্দাবনেই তার প্রয়াণ ঘটে। কালীনাথের মুখে তাঁর নাম শুনে তিনি জানিয়েছেন যে তিনি তার পরম মিত্র ছিলেন। কালীনাথের মুখে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র আদর্শ ও কার্যাবলীর কথা শুনে তিনি গর্বিত হয়েছেন। তবে কর্তামশাই বেশ দুর্বলহৃদয়বিশিষ্ট; কেননা কালীনাথ নবকুমারের পরামর্শে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাঁকে অনায়াসে জয় করে ফেলে। 'জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায়’ শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ও গীতগোবিন্দের চর্চা হয় শুনে তিনি ভক্তিনত চিত্তে বলেন, “আহা কবিকুলতিলক, ভক্তিরস সাগর।”


কালীনাথের বাক্যজালে প্রভাবিত হয়ে নবকে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় যেতে দিলেও সংশয়ী কর্তামশাই তাঁর সন্দেহ দূরীকরণের জন্য তাঁর সঙ্গী বৈষ্ণব বাবাজীকে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র খোঁজে প্রেরণ করেন। এইখানেই তাঁর বাস্তববুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র ঠিকানা, কার্যবিবরণ; কার্যকলাপ, আলোচনা ইত্যাদি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। অবশ্য বৈষ্ণববাবাজীর কাছ থেকে সমস্ত তথ্যাদি না পেলেও তিনি পানোন্মত্ত নবকুমারের গৃহে প্রত্যাবর্তন ও তার আচার-আচরণ দেখে বেশ ক্ষুব্ধ হন। তিনি পুত্রকে ‘কুলাঙ্গার, দুরাচার এবং নরাধম' রূপে অভিহিত করে বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তনের সংকল্প ঘোষণা করেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে আবেগপ্রবণ মনে হলেও তিনি বাস্তবানুগ সিদ্ধান্তে অচল। তাঁর ভাষারীতি ও সংলাপও তাঁর চরিত্রের পরিচয় দেয়। তাঁর ভাষারীতি কৃত্রিম বা আড়ষ্ট নয়। কর্তামশায়ের মুখে প্রযুক্ত ভাষারূপ মার্জিত ও পরিচ্ছন্ন। সজ্জন, ধর্মভীরু, রাশভারি কর্তামশাই-এর মুখের ভাষা তাঁর চরিত্রেরই প্রতিফলন।