'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের সর্বাপেক্ষা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর চরিত্রসৃষ্টি”– আলোচনা করো।

‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর চরিত্র সৃষ্টি। অতি অল্প আয়াসে মধুসূদন এই প্রহসনে অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।


আলোচ্য প্রহসনের জমিদার ভক্তপ্রসাদের চরিত্রটিই সর্বাপেক্ষা সার্থক চরিত্র সৃষ্টি। ভক্তপ্রসাদ শুধু জমিদার নয়, প্রজাপীড়কও বটে। খাজনা আদায়ে সে মায়া মমতাহীন। হানিফ যখন বলে - “কত্তাবাবু, বন্দা অনেক কাল্যে রাইয়ৎ, এখনে আপনি আমার উপর মেহেরবাণী না কল্যি আমি আর যাবো কনে? আমি এক্ষণে বারোটি গণ্ডা পয়সা ছাড়া আর এক কড়াও দিতি পারি না।"


তখন জমিদারের মন গলে না। হানিফ যে খরার জন্য ধান ঘরে তুলতে পারেনি, সেকথা জমিদারের কানে যায় না। কিন্তু পরিবর্তে ভক্তপ্রসাদ তার নিঃসম্বল প্রজাকে প্রহার ও নিপীড়নের পথে নিতে চায়। তাই আদেশ প্রদান করে— “এ পাজী বেটাকে ধরে নে যেয়ে জমাদারের জিম্মে করে দে আয় তো।”


অর্থাৎ জমিদারের প্রহার আর অত্যাচারই হানিফকে খাজনা দিতে বাধ্য করবে- এমন ইঙ্গিত এ বক্তব্যে পাওয়া যায়।


এই ভণ্ড মায়ামমতাহীন জমিদার হানিফের স্ত্রী সুন্দরী ফতিমাকে পাবার আশায় অবশেষে নরম হয় গদাধরের কথায়।


মধুসূদন ভক্ত চরিত্রটিকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন বলেই ফতিমার জন্য তার লালসাকে তার চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে অঙ্কন করেছেন। গদাধরের সঙ্গে কথাবার্তায় প্রকাশ পায় ভক্তপ্রসাদের লাম্পট্যের ইতিহাস—

“গদা। কত্তামশায়, আপনার সেই ইচ্ছেকে মনে পড়ে তো!

ভক্ত। কোন্ ইচ্ছে?

গদা। আজ্ঞে, ঐ যে ভট্চাজ্যিদের মেয়ে, আপনি যাকে (অর্দ্ধোক্তি) —তার পরে যে বেরিয়ে গিয়ে কসবায় ছিল।

ভক্ত। হাঁ। হাঁ। ছুঁড়ীটে দেখতে ছিল ভাল বটে (দীর্ঘ শ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) রাধে কৃষ্ণ! প্রভো তুমিই সত্য। তা সে ইচ্ছের এখন কি হয়েছে রে?

গদা। আজ্ঞে, সে এখন বাজারে হয়ে পড়েছে। হান্‌ফের মাগ তার চাইতেও দেখতে ভাল।

ভক্ত। বলিস্ কি! অ্যা? আজ রাত্রে ঠিকঠাক্ কত্যে পারবি তো?


এ জাতীয় সংলাপ থেকে বোঝা যায় যে ভক্তর কামানলে একটি মেয়ে দগ্ধ হয়ে ঘরছাড়া হয়েছে এবং কুলমান ত্যাগ করে দেহপসারিণীর বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ভক্তর নির্লজ্জ আচরণ আর কত মেয়ের সর্বনাশ করবে তারও ইঙ্গিত আছে। পঞ্চীকে দেখে তার লোলুপতা বেড়ে গেছে। আর উনিশ বছরের ফতিমাকে পাওয়ার জন্য সে অর্থব্যয় করতে অসম্মত নয়।


-ভক্তপ্রসাদ দ্বন্দ্বময় চরিত্র। একদিকে সে হিদুয়ানির গোঁড়া সমর্থক, পরম ভক্ত, সন্ধ্যা আহ্নিক ও জপতপ তার নিত্যকর্ম। সনাতন ধর্ম রক্ষায় আগ্রহ তার প্রবল। অথচ মুসলমান ঘরের যুবতী মেয়েকে পাবার জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আবার ধর্মের ভয়ও তার কম নয়। অবশেষে প্রবৃত্তির তাড়নায় ধর্মভয় মুক্ত হতে পেরেছে সে।

ভক্তর একটি পরিণতি দেখানো হয়েছে নাটকের শেষে। সে নিজেই বলছে— “এ জঘন্য কৰ্ম্মটাই আজ অবধি দূর কলোম। এতোতেও যদি ভক্তপ্রসাদের চেতনা না হয়, তবে তাঁর বাড়া গর্দভ আর নাই।”


ভক্তর যথেষ্ট শিক্ষালাভ হয়েছে। অবশ্য সন্দেহ জাগতে পারে যে নারীলোলুপতা কামপ্রবলতা যার স্বভাব, সে সত্যিই কি নিজেকে পাল্টাতে পারবে। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে ভক্তপ্রসাদ আপাতভাবে নিজের কাজকর্মের পরিণামে তিতিবিরক্ত। নাট্য পরিণতিতে তাই ভক্ত অনুতপ্ত এবং নিজেকে সংশোধনের প্রয়াসী।


হানিফ গাজীর চরিত্রটি এই গ্রহসনের অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। হানিফ গরীব চাষী, তার ভয় খাজনার দায়ে তার ভিটেটাই না ত্যাগ করতে হয়।


হানিফ বুদ্ধিমান। সে আট সিকে কাছায় বেধে রেখেছিল। ভক্তবাবু বেশি পীড়াপীড়ি করলে সে হয়ত টাকাটা দিত। তবে কৌশলে না দিতে পারায় সে খুশী। অন্যদিকে হানিফ নিজের বাস্তব বুদ্ধিবলে জমিদারকে নাজেহাল করে।


হানিফের পরামর্শ মতই তার বৌ ফতিমা পুঁটির কথায় রাজি হয়। হানিফ গরীব। অতএব টাকার লোভ সে সহজে ছাড়তে পারে না। অথচ ক্রোধও প্রবল— “লেকিন আমার সামনে যদি আমার বিবির গায়ে হাত দেয়, কি কোন রকম বেইজ্জৎ কত্তি যায়, তা হলি তো আমি তখনি সে হারামজাদা বেটার মাথাটা টান্যে ছিঁড়ে ফেলাবো।”


তার কথায় যথার্থই ভয় পায় তারই সহযোগী বাচস্পতি— “বেটা একে সাক্ষাৎ যমদূত, তাতে আবার রেগেছে। না জানি, আজ একটা কি বিভ্রাটই বা ঘটায়।”


দেখা যাচ্ছে হানিফ রেগে গিয়ে যে একটা কাণ্ড ঘটাতে পারে, – এ ভয় আছে বাচস্পতির।


অবশ্য হানিফ যতটা গর্জন করেছে ততটা কার্যে প্রকাশ পায়নি। তাকে খানিকটা সামলায় বাচস্পতি। ভূত হয়ে সে গদাধরকে চড় মারে। পুঁটিকে লাথি মারে আর ভক্তর পিঠে বসে ঘুষি মারে। এইভাবেই সে তার মনের জ্বালা জুড়ায়।


হানিফ সবশেষে আবার রসিকতাও করতে ছাড়ে না। ভক্তকে সে বলেছে– “সে কি, কত্তাবাবু? – আপনি যে নাড়্যেদের এত গাল্ পাড়তেন, এখনে আপনি খোদ্ সেই নাড়ে হতি বসেছেন, এর চায়ে খুসীর কথা আর কি হতি পারে? তা এ কথা তো আমার জাত কুটুমগো কতিই হবে।”


হানিফ এ প্রহসনের অতি সজীব চরিত্র। তার ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ যেভাবে ঘটেছে, তাতে গ্রাম্য সরল চাষীরূপে সে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বস্তুত হানিফের মতো চরিত্রের জন্যই এই প্রহসন এত সার্থক। এই প্রহসনে ভক্তপ্ৰসাদ যদি প্রধান চরিত্র হয়, তবে হানিফ হল তার যথার্থ প্রতিনায়ক। হানিফের কার্যকলাপ এ নাটকের কাহিনীকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যায় তাই নয়, তাকে সার্থক পরিণতিও দান করে।


বাচস্পতি দরিদ্র, সৎ ও নিষ্ঠাবান চরিত্র। ভক্তপ্রসাদ তার প্রতি অবিচার করেছে। দরিদ্র বলে তার কাছ থেকে ব্রহ্মত্র জমি কেড়ে নিয়েছিল জমিদার। শুধু তাই-ই নয়, ভক্তপ্রসাদ তাকে মাতৃশ্রাদ্ধে সাহায্য করতেও অনিচ্ছুক, আর মিতভাষী বাচস্পতি তাকে পীড়াপীড়ি করতেও নারাজ– “বাবুজী, আপনি হচ্যেন ভূস্বামী, রাজা; আপনার সম্মুখে তো আর অধিক কিছু বলা যায় না; তা আপনার যা বিবেচনা হয়; তাই করুন। (দীর্ঘ শ্বাস) এক্ষণে আমি তবে বিদায় হল্যেম।”


বাচস্পতি, নিতান্ত নির্বোধ নন। জমিদারের থেকে পাঁচ টাকা সে সাহায্য যোগাড় করতে পেরেছে। তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার ধর্মবোধ ও সততা– “রাম বলো! কলিদেব এত দিনেই যথার্থরূপে এ ভারতভূমিতে আবির্ভূত হলেন। হানিফ, দ্যাখ, যে কথা বল্যেম তাতে যেন খুব সতর্ক থাকিস।”


বাচস্পতির পরামর্শে জমিদার ভক্তপ্রসাদ নগদ দুশো টাকা দেয় হানিফকে। এ যেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা। সে কার্যে বাচস্পতি মধ্যস্থতা করায় তার বাজেয়াপ্ত হওয়া ব্রহ্মত্র জমিও তাকে প্রত্যার্পণ করা হয়।


ফতিমা বিবি অল্প আয়াসে আঁকা এক সার্থক চরিত্র। ফতিমার কার্যকলাপে তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রকাশিত। পুঁটির মাধ্যমে ভক্তবাবুর প্রস্তাব পেয়ে সে মজা পায়। আবার টাকা ফিরিয়েও দেয় না। এর জন্য ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয় সে।


ফতিমার বুদ্ধি ও সাহসবলেই ভক্তপ্রসাদের স্বরূপ উদঘাটিত হয়। পুঁটির কাছে সে এখন ভাব দেখায় যে, সে যেন ভক্তর প্রস্তাবে গোপনে সায় দিয়েছে। অথচ স্বামী হানিফের সঙ্গে পরামর্শ করেই সে যে এ কার্য করছে, একথা সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয় না।


বারেবারেই ফতিমা তার স্বামীর অনুপ তির কথা বলেছে। পুঁটি তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করেনি। এটা তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। নিতান্ত ভীত হলে তার পক্ষে এ কাজ করা যেত না। আবার ভক্তর স্বরূপ প্রকাশ পাবার পর সে অনায়াসে জমিদারকে বলেছে— “সে কি, কত্তাবাবু?— এই, মুই আপনার কলজে হচ্ছেলাম, আরো কি কি হচ্ছেলাম; আবার এখন মোরে দূর কত্তি চাও?”


এ উক্তিতে অতি সহজ ও স্বাভাবিক ফতিমার রূপ প্রকাশ পেয়েছে। নিতান্ত জড়তাহীন ও ভয়হীন এক গ্রামীণ নারী ফতিমা।


কুটিনী পুঁটি সহজ স্বাভাবিক চরিত্র। জমিদারকে মেয়ে ধরে দেবার কাজে সে পটু। ফতিমাকে অর্থের লোভ দেখিয়ে সে রাজী করায়। অথচ পুঁটি বুঝতে পারে না যে ফতিমা তার সঙ্গে অভিনয় করেছে মাত্র। তার ভয়-ভয় ভাব, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজী হওয়ার মনোভাব প্রকাশ— এ সবই যে অভিনয়, তা সরল পুঁটি বুঝতে পারেনি। বলা চলে, বুদ্ধির কৌশলে ফতিমার কাছে পুঁটি পরাজিত হয়েছে। অর্থের জন্যই যে পুঁটি এই কুটিনীবৃত্তি গ্রহণ করেছে তাও বেশ স্পষ্ট। কুটিনী পুঁটির সরল মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তপ্রসাদের প্রতি তার অশ্রদ্ধার মনোভাব বেশ প্রবল।


আলোচ্য গ্রহসনে গদাধর চরিত্রটি যথেষ্ট সুন্দরভাবে মধুসূদন কর্তৃক রূপায়িত হয়েছে। হাস্যরস সৃষ্টির জন্য গদাধরের প্রভুর মতো আচরণ প্রহসনে অঙ্কিত হয়েছে। সে টাকার জন্য প্রভুর মন রক্ষার চেষ্টা করে চলে। ভক্তপ্রসাদের প্রতি শ্লেষবাক্য নিক্ষেপে গদাধর বিশেষ দক্ষ। অবশ্য সেই শ্লেষবাক্য তার স্বগতোক্তি। নাটকের মূল ভাব প্রকাশে, ঘটনা সন্নিবেশে হাস্যরসের আয়োজনে গদাধরের মতো চরিত্রের ভূমিকা কম নয়।


এইভাবে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, আলোচ্য প্রহসনের প্রত্যেকটি চরিত্র বেশ সুঅঙ্কিত; সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিবেশ সৃষ্টিতে এবং সংলাপে তারা মধুসূদনের সৃষ্টি-প্রতিভার পরিচয় বহন করে।