'আদাব' গল্পে বর্ণিত সুতা-মজুর চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬-এর ১৬ই আগস্ট তৎকালীন মুসলিম লিগ 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' এর ডাক দেয়। শুরু হয় হিন্দু মুসলমানের রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ক্রমশ এই দাঙ্গা সারা বাংলা হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন প্রবল বিশ্বাসহীনতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, সন্দেহ আর আক্রোশ। এরই পটভূমিতে সমরেশ বসু লিখেছেন 'আদাব' গল্পটি। এ-গল্পে দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরের রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে তিনি যে-দুটি আতঙ্কগ্রস্ত প্রাণভীত অপরিচিত মানুষের জীবন্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন, তার অন্যতম হল সুতা-মজুর চরিত্র। নির্দয় জীবনবিরোধী পরিবেশে অবস্থান করেও ধর্মের সংকীর্ণ বেড়াজালকে অতিক্রম করে এই হিন্দু সুতা-মজুর চরিত্রটি মানবিকগুণে সমুজ্জল হয়ে উঠেছে।


‘আদাব’ গল্পে বিভীষিকাময় দাঙ্গার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে একরাত্রে একটি শঙ্কাগ্রস্ত লোক আশ্রয় নেয়। দুটিগুলির মধ্যবর্তীস্থানে রাখা এক ডাস্টবিনের আড়ালে। পড়ে থাকে নিঃসাড়ে, মাথা তোলার সাহসটুকুও তখন তার লুপ্ত। এমন সময় নড়ে ওঠে ডাস্টবিনটা। অপর পাশে তারই মতো আরেকটি লোক, ভীত-সন্ত্রস্ত। দুজনেই দুজনকে অবিশ্বাস করে। তীব্র শঙ্কায় আর সন্দেহে অপেক্ষা করে থাকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের। কিন্তু বাস্তবে যখন কোনো আক্রমণ আসে না, তখন উৎকণ্ঠায় অধৈর্য হয়ে একে অপরের পরিচয় জানতে চায়। তবে তাদের পরিচয় দিতে উভয়েই নারাজ। ক্রমশ পরিষ্কার হয় তাদের পেশা, জানা যায় তাদের আবাসস্থল। আর এই সূত্রে পাঠকও প্রথম সনাক্ত করতে পারে সুতা-মজুরকে, যার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের কাছে চাষাড়ায় এবং যে নারায়ণগঞ্জের সুতাকলে কাজ করে। অপরজন নৌকোর মাঝি, বাড়ি, 'বুড়িগঙ্গার হেইপারে—সুবইডায়'।


প্রাথমিক এই পরিচয়-লাভের পরেও সুতা-মজুরের মনের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা দানা বেঁধে থাকে। কারণ সে যেমন নিজের জাতের কথা মাঝিকে বলে নি, তেমনই ঐ মাঝির জাতের পরিচয় তখনো পর্যন্ত নিজে জানতে পারেনি। দাঙ্গা দগ্ধ পরিবেশে আত্মরক্ষার খাতিরেই সুতা-মজুরকে এভাবে সংশয়ের জালে বন্দি হতে হয়েছে। তাই সে অন্ধকারের মধ্যে মাঝির চেহারা ও পোশাক-পরিচ্ছদ খুঁটিয়ে দেখে তার জাত-সম্বন্ধে ধারণা তৈরির চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ যখন কাছাকাছি কোথাও দাঙ্গাবাজ হিন্দু-মুসলমানের উন্মত্ত কণ্ঠধ্বনি শোনা যায়, তখন আতঙ্কিত মাঝি সে-স্থান ছেড়ে উঠে যাবার কথা বললে সুতা-মজুর ঘনিষ্ঠজনের মতো তাকে বাধা দিয়ে বলে—আরে না না—উইঠো না। জানটারে দিবা নাকি?” অথচ মাঝি জেদবশত তার নিষেধকে অস্বীকার করে যেতে চাইলে সুতা-মজুর তার প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠে। মাঝি তার দলবল নিয়ে আসতে পারে সুতা-মজুরকে মারবার জন্য এমন সন্দেহ সে প্রকাশ করলে মাঝির মনে আঘাত লাগে। তখন সুতা-মজুর তাকে ‘ভাই' বলে সম্বোধন করে বসতে বলে। তার কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় মাঝি আশ্বস্ত হয়, যখন সুতা-মজুর বলে—'তুমি চইলা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি?" স্বল্প সময়ের পরিচয়েই দাঙ্গার আতঙ্কিত পরিবেশে অসহায় সুতা-মজুরের মাঝির ওপর এক ধরণের নির্ভরতা তৈরি হয়।


অন্ধকার গলির মধ্যে মৃত্যুর প্রতীক্ষার মতো নিস্তব্ধ মুহূর্তগুলিতে ডাস্টবিনের একপাশে বসে সুতা-মজুর নিজের বিপদের কথা, ঘরের কথা, মা-বউ- লেমেয়েদের কথা চিন্তা করে। নিয়ে আর ঘরে ফিরে যেতে পারবে কিনা—এ আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে ওঠে। সে দুঃখের সঙ্গে ভাবে, হঠাৎ বজ্রপাতের মতো দাঙ্গা নেমে আসায় চারিদিকে কেমন সন্দেহ-আক্রোশের বিষ ছড়িয়ে পড়ল। এতদিনকার কথাবার্তা-কলহাস্যে মুখরিত পরিবেশ দাঙ্গায় কালো হয়ে গেল। মারামারি-কাটাকাটিতে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে লাগল। মানুষ যেন এক অভিশপ্ত জাত। এমনভাবে নির্মম হয়ে উঠতে তার বিবেকে বাধে না। এসব চিন্তা করে সুতা-মজুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সময়ের সহযোগে, কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় মাঝির প্রতি তার অবিশ্বাস ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। মাঝি যে মুসলমান—একথা জানতে পেরে সুতা-মজুর প্রথমে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। মাঝির পুঁটুলির দিকে তাকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। তারপর মাঝির কথায় সে বিশ্বাস স্থাপন করে। মাঝির প্রশ্নের উত্তরে সুতা-মজুর তার জামা-কাপড় নেড়েচেড়ে দেখিয়ে ভগবানের নামে শপথ করে জানায় যে, তার সঙ্গে একটা সুঁচও নেই। সুতা-মজুরের এমন আচরণ থেকে তার সরল, ঈশ্বরনিষ্ঠ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।


সুতা-মজুর নিরক্ষর নয়, সে খবরের কাগজ পড়ে; দাঙ্গাবিধ্বস্ত দেশের রাজনীতিকদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থসর্বস্ব মনোভাব-সম্বন্ধে সে ওয়াকিবহাল। মাঝি তার কাছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির কারণ জানতে চাইলে সে উত্তপ্ত গলায় বলে—‘দোষ তো তোমাগো ওই লিগওয়ালোগোই। তারাই তো লাগাইছে হেই কিয়ের সংগ্রামের নাম কইরা।' সুতা-মজুর প্রখর বাস্তবতাবোধ দিয়ে সঠিকভাবেই বলে যে, এই দাঙ্গার কারণে মাঝি অথবা সে মারা গেলে তাদের ছেলেমেয়েরা ভিক্ষে করে বেড়াবে। এ প্রসঙ্গে সে গতবছরের দাঙ্গায় তার ভগ্নিপতির নিষ্ঠুরভাবে নিহত হওয়ার কথা জানায়। সে কারণে সুতা-মজুর তার বিধবা বোন ও তার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিয়ে যে সাংসারিকভাবে পীড়িত হয়ে রয়েছে, সে-কথাও সে মাঝিকে বলে। এসময় সুতা মজুরের ক্ষুব্ধ-তিক্ত কণ্ঠে উঠে আসে দেশের অগণিত দুর্দশাগ্রস্ত সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা-লব্ধ মর্মান্তিক সত্য-কথন-... ন্যাতারা হেই সাততলার উপর পায়ের উপর পা দিয়া হুকুম জরি কইরা বইয়া রইল আর হালার মরতে মরলাম আমরাই।


দুজনের এই কথোপকথনের মাঝে টহলদারি পুলিশের ভারী বুটের শব্দ শোনা গেলে সুতা-মজুর পালাতে চাইলেও দিক নির্ণয় করতে পারে না, কারণ সে শহরের রাস্তাঘাট ভালো করে চেনে না। মাঝির ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে সুতা-মজুর তখন তার শরণাপন্ন হয়। মাঝির সঙ্গে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পাটুয়াটুলি রোডে পৌঁছয়। ইংরেজ অফিসারের দৃষ্টি এড়িয়ে দুজনে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। মাঝির কাছে মুসলিম এলাকা ইসলামপুর ফাঁড়ি আর বাদামতলির ঘাটের গমনপথ জানতে পেরে সুতা-মজুরের সমস্ত মুখ আতঙ্কে ভরে ওঠে। মাঝি তাকে সেই স্থানেই থাকতে বলে নিজে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যেতে চাইলে উৎকণ্ঠিত সুতা-মজুর তার কামিজ চেপে ধরে বলে—কেমনে যাইবা তুমি, আঁ?’ মাঝির মুখে পরের দিনের ঈদের কথা, নতুন জামা পরার আশায় পথ চেয়ে থাকা ছেলেমেয়ের কথা, তার বিরহবেদনাতুর বিবির কথা শোনার পর সুতা-মজুর নিজেও বেদনা অনুভব করে। তারপর বিদায় মুহূর্তে মাঝি সেই রাত্রের কথা না ভুলবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘আদাব’ জানালে বিচ্ছেদ-কাতর সুতা-মজুর নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিস্মৃত হয়ে বলে—'আমিও ভুলুম না ভাই–আদাব'। এখানেই সুতা-মজুর চরিত্রের উত্তরণ ঘটেছে যথার্থ মানবতায়।


মাঝি চলে যাওয়ার পর আতঙ্কিত, নিঃসঙ্গ সুতা-মজুরের মুহূর্তগুলো কাটে রুদ্ধ নিশ্বাসে। ঈশ্বরের প্রতি সে মাঝির জন্য প্রার্থনা করে—'ভগবান মাঝি য্যান বিপদে না পড়ে। মাঝি ঘরে ফেরার পর তার ছেলেময়ে ও বিবির আনন্দের কথা কল্পনা করে সুতা-মজুর নিজের জীবনের কথা ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। আর তখনই ‘হট’ কথাটি কানে আসতেই সে গলা বাড়িয়ে দেখে, পুলিশ অফিসার রিভলবার হাতে রাস্তায় লাফিয়ে পড়েছে। তারপরেই আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুনে রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠায় মাঝির বিপদের সঙ্গে নিজের একাত্মতা বোধ করে। সুতা-মজুর হাতের আঙুল কামড়ে ধরে। সে অনুমান করে নেয়, মাঝির আর বাড়ি ফেরা হল না। তার বিহ্বল চোখে ভেসে ওঠে, মাঝির বুকের রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে তার বিবির শাড়ি আর ছেলেমেয়ের পোশাক। তার কানে ধ্বনিত হয়, পরবের আগে মাঝির বাড়ি ফিরতে না পারার ব্যর্থতাজনিত হাহাকার।


আলোচ্য গল্পের দাঙ্গার চরম হিংসাত্মক পটভূমিতে সুতা-মজুর ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে অসামান্য মানবতার নিদর্শন রেখে গেছে। সে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও নিজ ধর্মের রীতিতে আবদ্ধ থাকেনি। তার মতো একই পরিস্থিতির শিকার মুসলমান মাঝির সঙ্গে সে ক্রমশ গভীর একাত্মতা বোধ করেছে। সারল্যে, পারিবারিক স্মৃতিচারণে, মানবিক সহমর্মিতায়, কল্যাণ কামনায়, রাজনৈতিক সচেতনতায়, স্পষ্ট সত্য-কথনে এই সুতা-মজুর চরিত্র সমরেশ বসুর বিশুদ্ধ মানবতাবোধ সঙ্ঘাত এক জীবন্ত সৃষ্টি এবং মহৎ মনুষ্যত্বের মর্যাদায় ভাস্বর।