ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলির শ্রেণিবিন্যাস করে যে বিশ্লেষণ করেছেন সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

ইউরোপীয় ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা সম্পর্কে আলোচনা করে তার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলির বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটিত করবার চেষ্টা করেছেন ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশ্চাত্য দেশের ছোটগল্প সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “জীবনের কেন্দ্রস্থ গভীর ভাব ও অনুভূতিগুলিকে, তাহার সীমাপ্রদেশের গৌণ বৈচিত্র্যগুলিকে লইয়াই তাহার কারবার। চটুল সরসতা, জীবনের বিস্ময়কর, আশ্চর্য সংগঠনসমূহ, তাহার হাস্যরসপ্রধান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসঙ্গতিগুলিই সাধারণত ইউরোপীয় ছোটগল্পের বিষয়। আমাদের দেশে, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলিতে ইহার বিপরীত ব্যাপার। তাঁহার দুই একটি গল্পে হাস্যরসের প্রাচুর্য ও লঘুতার স্পর্শ থাকিলেও, অধিকাংশের মধ্যেই জীবনের গভীর কথা, সূক্ষ্ম পরিবর্তন ও রহস্যময় সূত্রগুলিরই আলোচনা হইয়াছে। আমাদের এই বাহ্যতঃ তুচ্ছ ও অকিৎিকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুসজল, ভাবঘন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে সেগুলিকে আবিষ্কার করিয়া পাঠকের বিস্মিত মুগ্ধ বৃষ্টির সম্মুখে মেলিয়া ধরিয়াছেন। যেখানে বাহ্য দৃষ্টিতে মরুভূমির বিশাল, ধূসর বালুকা-বিস্তারমাত্র দেখা যায়, তিনি সেখানেও সেই সর্বদেশ-সাধারণ ভাব মন্দাকিণীধারা প্রবাহিত করিয়াছেন। আমাদের যে আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি বহির্জীবনে বাধা পাইয়া বাহ্যবিকাশের দিকে প্রতিহত হইয়া অন্তরে মুকুলিত হয় ও সেখানে গোপন মধুচন্দ্র রচনা করে, রবীন্দ্রনাথ নিজ ছোটগল্পগুলির মধ্যে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হইবার অবসর দিয়াছেন। বাস্তব জগতের রিক্ততার মধ্যে যে বিশাল ভাবসম্পদ কবিচক্ষুর প্রতীক্ষায় আত্মগোপন করিয়া আছে তিনি সেই ছদ্ম আবরণ ভেদ করিয়া তাহাদের স্বরূপ অভিব্যক্ত করিয়াছেন। তাঁহার গল্পগুলি আমাদের মর্মে এই আশার বাণী ধ্বনিত করে যে, আমাদের বিষয়দৈন্য ও বৈচিত্রাহীনতার জন্য কুণ্ঠিত হইবার কোন কারণ নাই ; আমাদের রস-সম্পদের কোন অভাব নাই, অভাব কেবল সুক্ষ্মদৃষ্টির ও কবিত্বপূর্ণ অনুভূতির।" (বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের যারা : ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সপ্তম পুনমুদ্রণ সংস্করণ, ১৯৮৪)


রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলি বিশ্লেষণ করে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সেগুলির বিষয়বস্তু আত্মা ও গল্পকারের মেজাজ অনুসারে চারটি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যদিও তিনি এই শ্রেণিবিভাগকে বাঙালী জীবনের সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার মধ্যে রোমান্সের মুক্ত হাওয়া বইয়ে দেওয়ার উপায়রূপে রবীন্দ্রনাথের গল্পরচনার প্রচেষ্টাকে চিহ্নিত করেছেন, তবু আলোচনার সুবিধার জন্য এই শ্রেণিবিভাগ বিশেষ কার্যকর। উপায়গুলি এইরকম: (১) প্রেম; (২) সামাজিক জীবনে সম্পর্ক-বৈচিত্র্য; (৩) প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের নিগূঢ় অন্তরঙ্গ যোগ: (৪) অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ।


যে-সব গল্পে বিচিত্র লীলা অভিব্যক্ত হয়েছে তার মধ্যে প্রধান কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে—'একরাত্রি', ‘মহামায়া', 'সমাপ্তি', 'দৃষ্টিদান', 'মাল্যদান', 'মধ্যবর্তিনী', 'শান্তি', 'প্রায়শ্চিত্ত', 'মানভঞ্জন’, ‘দুরাশা’, ‘অধ্যাপক' ও ‘শেষের রাত্রি'।


সামাজিক সম্পর্ক-বৈচিত্র্য গল্পগুলির মধ্যে ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, 'দিদি' গল্পটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া ‘হালদার গোষ্ঠী', 'ঠাকুরদা' প্রভৃতি গল্পে সামাজিক বংশ গৌরবের দুই-টি দিক প্রকাশিত হয়েছে। কতকগুলি গল্পে বঙ্গসমাজের প্রধান কলঙ্ক, বিবাহের অত্যাচার বিষয়বস্তুরূপে গৃহীত হয়েছে। এইসব গল্পের মধ্যে 'দেনা-পাওনা', 'যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘হৈমন্তী’ ইত্যাদি গল্প উল্লেখযোগ্য।


তৃতীয় শ্রেণির গল্পগুলিতে রবীন্দ্রনাথ রোমান্স সৃষ্টির এক অভিনব উপায় ব্যবহার করেছেন। এগুলিতে তাঁর কবিপ্রতিভা এবং কবিসুলভ সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্ট চরিত্রের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার সঙ্গে বহিঃপ্রকৃতির এক নিগূঢ় সম্বন্ধ স্থাপন করে অতি সাধারণ ঘটনাকেও আশ্চর্য মহিমা দান করেছে। 'সুভা', 'অতিথি', 'আপদ' প্রভৃতি গল্প এই শ্রেণির অন্তর্গত।


অতিপ্রাকৃত গল্পগুলির মধ্যে ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘গুপ্তধন’ প্রভৃতি কয়েকটি গল্পে সহজ অতিলৌকিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কাহিনী গড়ে উঠেছে এবং পরিণতি লাভ করেছে। আবার নিশীথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘মণিহারা’ প্রভৃতি গল্পে আশ্চর্য কল্পনাসমৃদ্ধির সহায়তায় অতিপ্রাকৃতকে এক নূতন স্তরে উন্নীত করা হয়েছে। বাস্তব জীবনের সঙ্গে অতিপ্রাকৃতের সমন্বয় সাধনে এই গল্পগুলিতে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন।