পৌরাণিক নাটকের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে বাঙলা ভাষার একটি পৌরাণিক নাটক সম্বন্ধে আলোচনা কর।

সাধারণ নাটকের সঙ্গে পৌরাণিক নাটকের পার্থক্য কোথায়? একটি বাংলা পৌরাণিক নাটক অবলম্বনে এ শ্রেণীর নাটকের লক্ষণগুলি দেখিয়ে দাও।

কোনও দেশের ধর্মজীবনের সঙ্গে জড়িত প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে পৌরাণিক নাটক (mythological drama) রচিত হয়। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর নাট্যরূপায়ণে ভক্তিরসের উদ্দীপনের দিকে নাট্যকারের লক্ষ্য থাকে, তার সঙ্গে মানবরসের মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়। কখনও কখনও নাট্যকারের পৌরাণিক বিষয়বস্তুর আবরণে সমকালীন জীবনের আদর্শ বা জীবনচেতনাকেও রূপায়িত করেন। ‘কেইন' (Cain) নাটকের বিষয়বস্তু বাইবেলের বিশ্বের প্রথম নরহস্তা কেইনের কাহিনী, সে শয়তানের অনুচর হয়ে তার প্ররোচনায় ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরক্ত ভাই অ্যাবেলকে হত্যা করেছে; ঈশ্বর তাকে শাস্তি দিয়েছেন, অনুতপ্ত কেইন বিশ্বসংসার থেকে নির্বাসিত হয়েছে। কিন্তু এই নাটককে প্রচলিত অর্থে পৌরাণিক নাটক বলা চলে না, কবি কেইনকে আদর্শ বীরপুরুষ, নিজের সমাজদ্রোহী ও উদ্ধৃত সত্তার প্রতিমূর্তিরূপেই উপস্থাপিত করেছেন। অলৌকিক পৌরাণিক বিষয় নিয়ে রচিত হয় বলে পৌরাণিক নাটকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা সন্নিবিষ্ট হয়।


আমরা এখানেই সাধারণ নাটকের তুলনায় পৌরাণিক নাটকের পার্থক্য লক্ষ্য করি। সাধারণ সামাজিক নাটকের ভিত্তি বাস্তব জীবনের অনুকৃতি (imitiation of real life)। এই জাতীয় নাটকের ঘটনার আকস্মিক যোগাযোগ, চরিত্র চিত্রণে অতিরঞ্জন, নিয়তির রহস্যময়তা ইত্যাদি থাকতে পারে; কিন্তু তারা বাস্তবরূপে প্রতীয়মান হবে, সম্ভাব্যতার সীমা অতিক্রম করবে না, দর্শকদের এই প্রত্যাশা নাট্যকারকে পুরণ করতেই হবে। সেইজন্য সাধারণ নাটকের রচয়িতাকে দৃশ্য, ঘটনা ও চরিত্রের বাস্তবরূপ প্রতীয়মানতা এবং সমস্ত অংশের কার্যকারণের যুক্তি শৃংখলারক্ষা সম্পর্কে অবহিত থাকতে হয়। পৌরাণিক নাটকের ক্ষেত্রে এই দায় নাট্যকারকে বহন করতে হয় না, তাঁর পৌরাণিক বিষয়বস্তু পরিবেশনের মূল ভিত্তি ভক্তি-বিশ্বাস, শুধু তার অলৌকিকতাকে নাট্যকলাকৌশলসম্মত করে তোলার প্রতিই তাঁর দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রাখতে হয়।


ইয়োরোপে ধর্মানুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই নাটকের সূত্রপাত ঘটে। খ্রীস্টানদের দুটি উৎসব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্রীসমাস বা বড়দিন, অন্যটি ইস্টার। এই দুটি উৎসবকেই কেন্দ্র করে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম থেকে তাঁর পুনরুত্থান পর্যন্ত তাঁর জীবনের ঘটনাবলীকে নাটকের রূপ দেওয়া হত। দশম শতাব্দীতে ইস্টার উপলক্ষে ল্যাটিন ভাষায় রচিত একটি নাটক পাওয়া যায় সেখানে তিনজন নারী ও একজন দেবদূত যীশুখ্রীষ্টের কবরের কাছে কথোপকথনরত, এই দৃশ্য উপস্থাপিত। অতঃপর নতুন নতুন চরিত্র এই ধরনের প্রাথমিক ও অপরিণত নাট্যরচনায় সন্নিবিষ্ট হতে থাকে এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে যীশুখ্রীষ্টের জীবনকাহিনী সুষ্ঠু নাট্যরূপে উপস্থাপিত হয়। এতদিন পর্যন্ত গীর্জার মধ্যেই অভিনয়ের অনুষ্ঠান হত, তারপর তা স্থানান্তরিত হল গীর্জার প্রাঙ্গণে, অবশেষে কিছুদিন পরে জনাকীর্ণ বাজারের কাছে। ল্যাটিনের পরিবর্তে ইংরেজিতে নাটক রচিত হতে থাকে। এই নাটকগুলিকে বলা হয় মিস্ট্রি প্লে (Mystery Play), ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই জাতীয় ধর্মীয় পৌরাণিক নাটক বহু রচিত হয়েছিল। তাদের উপজীব্য ছিল শুধু বাইবেলের কাহিনী। এই সময়ে আর এক ধরনের ধর্মীয়-পৌরাণিক নাটক রচনা ও অভিনয় শুরু হয়, তাদের বলা হত মির‍্যাল্ প্লেজ (Miracle Plays), তাদের বিষয়বস্তু বাইবেলের ঘটনাবলী বা খ্রীষ্টান সাধুসম্ভের জীবন কাহিনী। এই সময় ফরাসী ভাষায়ও এই ধরনের নাটক রচিত হতে থাকে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রচিত এই নাটকগুলিকে Mysteries বলা হতে থাকে। এ ধরনের সবচেয়ে পুরনো নাটক যা পাওয়া গেছে তা হ’ল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগের Mystered' Adam। এই শতাব্দীতেই রচিত Jean Bodel-এর Jeude Saint Nialas দ্বিতীয় শ্রেণীর ধর্মীয়-পৌরাণিক নাট্যধারায় একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। বাস্তব জীবনের মতই এই রচনায় অকুণ্ঠভাবে হাস্যরসাত্মক ও সিরিয়াস বা গুরুগম্ভীর উপাদানগুলিকে সমন্বিত হতে দেখি। বিশুদ্ধ কৌতুক, চরিত্রের বৈচিত্র্য প্রভৃতির জন্য উৎসাহ এবং লোকভাষার সজীবতা প্রতিটি দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তুলেছে। এই সময় জার্মান ভাষায়ও এই জাতীয় ধর্মীয়-পৌরাণিক নাটক রচিত হতে থাকে। জার্মান নাটকগুলির অভিনয় স্থানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য: বাজারের যে স্থানে এই নাটকগুলি অভিনীত হত, তা ছিল মধ্যযুগীয় বিশ্বের প্রতীক, স্বর্গ, পৃথিবী ও নরক এই তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। নাটকের ঘটনা তিনটি স্থানেই যুগপৎ প্রদর্শিত হত, পৃথিবীতে এমন কোনও ঘটনা ঘটত না যার অনুরূপ ঘটনা ও ফলাফল স্বর্গে ও নরকে দেখা যেত না।


ইংরেজ নাট্যকার জন হেউডের The Four P's, মনোমোহন বসুর 'সতী' নাটক, ‘হরিশচন্দ্র' নাটক, গিরিশচন্দ্র ঘোষের 'বিশ্বমঙ্গল', 'জনা', দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'সীতা', ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদনের 'নরনারায়ণ', মন্মথনাথ রায়ের 'কারাগার' ইত্যাদি পৌরাণিক নাটকের উদাহরণ। পৌরাণিক নাটক যে কিভাবে সমকালীন জীবনভাবনায় অনুরঞ্জিত হয়, তার পরিচয় মেলে ‘হরিশচন্দ্র' নাটকে, মনোমোহন তাঁর এই নাটকে হিন্দুমেলায় গীত তাঁর বিখ্যাত গান 'দিনের দিন সবে দীন, হয়ে পরাধীন' অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার একটি গানে করভার জর্জরিত দেশের দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে।


ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলায় অজস্র পৌরাণিক নাটক রচিত হয়েছিল। ভক্তিরসের প্রতি আকর্ষণ বাঙালি মানসের জাতীয় প্রবণতা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধনায় যখন বাঙালীর দেব-দেবী কল্পনা ও অধ্যাত্মচেতনা প্রত্যক্ষ সত্যরূপে উদ্ভাসিত হয়েছিল, তখন ধর্মানুভূতির প্রবল ভাবোচ্ছ্বাস জাতীয় মানসকে প্লাবিত করেছিল, তার উদ্দীপনাই গিরিশচন্দ্র ও ক্ষীরোদপ্রসাদের পৌরাণিক নাটকে বিধৃত হয়েছে।


পৌরাণিক যুগের অলৌকিক ঘটনা, ঈশ্বরের মানুষীরূপে আবির্ভাব ও মানুষের মত ভাবাধীনতা, ভক্তির অসাধ্য সাধন—সমস্তই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের বাঙালি জনসাধারণের নবজাগ্রত ধর্মবিশ্বাস প্রবণতায় জীবন্ত সত্য ও রসচেতনার উদ্দীপকরূপে গৃহীত হয়। মধ্যযুগের যাত্রাগান, ধর্মীয় আকুতি ও সঙ্গীতপ্রাধান্য নিয়ে আধুনিক যুগের উন্নত অভিনয় কৌশল ও নাট্যরীতির পরিমার্জনায় বাঙালির মানসলোকে নতুন জন্ম পরিগ্রহ করে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি থেকে সংগৃহীত অলৌকিক আখ্যানবস্তুকে আধুনিক যুক্তিবাদী মানসের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মনস্তাত্ত্বিক কলা ও কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা বাঙালি নাট্যকারেরা অনুভব করতেন না, এদেশের জনসাধারণের মনের সহজ বিশ্বাস, বিশেষত ভক্তিরসবিহ্বলতার ওপর নির্ভর করে তাঁরা পৌরাণিক ঘটনাবলীকে যুগোচিত কোনও পরিবর্তন ছাড়াই নাটকে সন্নিবিষ্ট করতেন। আধুনিক সাহিত্য বিচারে এই পৌরাণিক নাটকগুলি প্রকৃত নাটক নয়, নাটকের আধারে সংরক্ষিত অলৌকিক রসের আত্মবিস্তার মাত্র। যেখানে দেবমহিমা ও ভক্তের আত্মনিবেদনই নাটকের উপজীব্য, সেখানে জাগতিক নিয়ম বা কার্যকারণশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্বসংঘাত ইত্যাদির বিশেষ কোনও গুরুত্ব থাকতে পারে না। তবু এই যাত্রাধর্মী, ভক্তিরসপ্লাবিত পৌরাণিক নাটকই বাঙালির মনোধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কান্বিত নাট্যরস বিকাশের দৃষ্টান্ত।


গিরিশচন্দ্রের নাট্যপ্রতিভা পৌরাণিক নাটকেই তার স্বাভাবিক বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছিল। তিনি অন্যান্য বাঙালি পৌরাণিক নাট্যকারদের মতই রামায়ণ, মহাভারত অথবা অন্য কোনও পুরাণ কাহিনী থেকে তাঁর পৌরাণিক নাটকগুলির বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পৌরাণিক নাটক ‘জনা’ (১৮৯৪)। জৈমিনী-ভারতের অশ্বমেধ পর্বে পঞ্চদশ অধ্যায়ে গঙ্গাশাপবৃত্তান্তে জনার কাহিনী পাওয়া যায়, এই অংশে জনার নাম জ্বালা; এই নামে পুত্রশোকাতুর মাতৃহৃদয়ের জ্বালাযন্ত্রণার ইঙ্গিত মেলে। এখানে জনার তেজস্বিতা ও প্রতিহিংসাই বেশি পরিমাণে প্রকাশিত। কাশীরাম দাস ও তাঁর অনুবর্তী কবিদের বর্ণনায় জনার পুত্রশোকাতুর বিষাদমূর্তিটিই প্রোজ্জ্বল। জনার প্রতি আধুনিক জীবনচেতনার অধিকারী মধুসুদনের দৃষ্টিও যে আকৃষ্ট হয়েছিল তাঁর প্রমাণ ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ কবিতাটি।


পৌরাণিক নাটকে যেমন দেবতাদের শক্তির এবং দৈববিধানের লীলা ও মহিমা প্রদর্শনে দর্শকদের চিত্ত ভক্তিরসে আপ্লুত করা হয়, তেমনি পার্থিব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে লৌকিক আনন্দবেদনার আশ্রয় মানবরসসৃষ্টির দিকেও তার লক্ষ্য থাকে গিরিশচন্দ্রের ‘জনা’ নাটকেও আমরা এই দুই রসের সমাবেশ লক্ষ্য করি। জনা ও পুত্র প্রবীরের চরিত্রকে কেন্দ্র করে নাট্যকার বাস্তব জীবানাবেগ ও প্রবৃত্তির ঘাতপ্রতিঘাত সঞ্জাত লৌকিক নাট্যরস পরিবেষণ করেছেন, অন্যদিকে নীলধ্বজ, বিদূষক, অগ্নি, বৃষকেতু প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে অলৌকিক ভক্তিরস সৃষ্টি করেছেন। প্রবীরের বীরত্ব, স্বদেশপ্রেম, মাতৃভক্তি, প্রেম প্রভৃতি মানবিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং জনার পুত্রস্নেহ, স্বাদেশিকতা, স্বামী নীলধ্বজ ও অন্যান্য কৃষ্ণভক্ত লোকদের বিরোধিতা, পান্ডব বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার জ্বালা প্রভৃতি নাটকের মধ্যে বাস্তব জীবনের রস সৃষ্টি করেছে। প্রবীর ও জনার ব্যক্তিত্বসঞ্জাত দ্বন্দ্বসংঘাতময় ঘটনা যতদূর পর্যন্ত চিত্রিত হয়েছে, দর্শক ও পাঠকেরা সেই অংশে তীব্র সংঘাতময় মানবরসপূর্ণ নাট্যসংঘাতে আবিষ্ট হয়ে থাকে।


গিরিশচন্দ্র প্রবীরের মৃত্যুর পর দুটি অঙ্কে কৃষ্ণের লীলারহস্য ও অপার মহিমা চিত্রিত করেছেন। কৃষ্ণভক্ত বিদূষকই এই অংশে কৃষ্ণভক্তির প্রবক্তার ভূমিকা পালন করেছে, অন্যান্য চরিত্রগুলির কৃষ্ণভক্তির প্রবাহেও নাটকের এই অংশটি প্লাবিত। শুধু জনাই তার প্রতিহিংসার জ্বালা নিয়ে চারিদিকের ভক্তির উচ্ছ্বসিত প্রবাহের মধ্যে দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ। নিজের প্রতিহিংসার অগ্নিদহনে জনা নিজেই দগ্ধ হয়েছে, অন্যের মনে তার জ্বালা সঞ্চারিত হয়নি। জনার মৃত্যুতেই নাটক শেষ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু গিরিশচন্দ্র এক অলৌকিক দৃশ্যে শান্ত, সমাহিত জনাকে উপস্থাপিত করে তাঁর নাটকে ভক্তির মহিমা প্রদর্শন করেছেন। তাতে নাট্যরস কিছুটা পরিমাণে ক্ষুণ্ন হলেও নিজের প্রতিহিংসার বহ্নিবিভাসে দীপ্ত জনার চরিত্র একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যায় নি।