সতীনাথ ভাদুড়ীর 'চরণদাস এম. এল. এ.' গল্পটি ছোটগল্প হিসাবে সার্থক হয়েছে কী না আলোচনা করো।

সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘চরণদাস এম. এল. এ.' গল্পটিতে গল্পকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিশ্বন ধরা পড়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে সতীনাথ একসময় ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। সেই জীবনের অস্বস্তির কথা, রাজনৈতিক নেতাদের সেই মিথ্যাচারের কথা, নষ্টামীর কথা, সুবিধাবাদী চরিত্রের কথা ব্যক্ত করেছেন তাঁর সাহিত্যের মধ্যে। তিনি দেখিয়েছেন তথাকথিত দেশসেবকরা দেশের সেবার চেয়ে নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। এমনকি তারা আশৈশব লালিত গ্রাম ও গ্রামীণ সংস্কৃতিকে পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে যায়। গ্রামের ছেলে হয়েও দেবমন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি আর মোষের গলার ঘণ্টা শব্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না। শহর থেকে কখনো কোনো উপলক্ষে নির্বাচন ক্ষেত্রে এলেও থাকেন সার্কিট হাউসে। সাধারণ লোকের সমর্থন পেয়ে বিধায়কের পদ পাওয়ার পর তাঁরা সাধারণ লোকের থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করেন। কিন্তু হাইকমাণ্ডের নির্দেশে যখন অগত্যা সেই সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে আসেন তখন দেখেন সকলেই যেন তাঁকে এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু তাতেও কোনো রকম বিচলিত হন না তাঁরা। রাজনীতির নানা ঘাটে জল খাওয়া এই সমস্ত এম.এল.এ.রা সমস্ত রকম পরিস্থিতিকেই নিজের অনুকূলে আনতে পারেন। সে যোগ্যতা তাঁদের আছে বলেই তাঁরা ওই পর প্রাপ্ত হয়ে থাকেন।


আলোচ্য গল্পের মধ্যে দেখা যায়, চরণদাস এম.এল.এ. অনেক দিন পর নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে এসে, দেখেছেন মানুষের মতিগতির পরিবর্তন হয়েছে। যাদের পেটে বোমা মারলেও একটা কথা বার করা যেত না, কোন্ এক জগৎগুরুর আনুকূল্যে তাদের মুখে বুলি ফুটেছে। তারাও নিজেদের মূল্য বুঝতে শিখেছে। এমনকি চরণদাসের মতো একজন মালয়েজী পর্যন্ত তাদের ডেকে কথা বলতে চাইলেও তারা তাঁকে এড়িয়েই চলেছে। প্রথমে চরণদাস এদের এড়িয়ে চলার কারণ বুঝতে পারেননি। পরে মনে করেছেন তাঁর গোপন নীতির কথা হয়তো এরা সকলে জেনে গেছে। তিনি ছেলেদের জন্যে সাদরে সুপারিশ পত্র লিখে দেন– একটুও দেরি করেন না; কারণ সরকারি দপ্তরে আগেই তিনি বলে রেখেছেন, তার সুপারিশ পত্রের ওপর কোনো গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যে। এই কৌশলের ফলে উভয় দিক বজায় রেখেই তিনি চলতে পারেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, এই কৌশলের কথা কি এরা সকলে জেনে গেছে? কিংবা তাঁরই পয়সায় পুষ্ট লাললখন-রা তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী হবার জন্যে গ্রামবাসীদের জানিয়ে দিয়েছে কি না। কিন্তু পরে আলাপ আলোচনা করে জানতে পারলেন, গ্রামে যে জগৎগুরু সহস্রানন্দ নামে সিদ্ধপুরুষ আশ্রম করে অবস্থান করছেন, তিনিই এই সব মূর্খ হতদরিদ্রদের আত্মনির্ভরতার শিক্ষা দিচ্ছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, ভোটার-চরণদাস এবারে গুরুদেবের চরণদাস হয়েই নির্বাচনের বৈতরণী পার হবেন। এবং অবশেষে দেখা গেল চরণদাস একজন মৌলভী সাহেব নামক সরকারি কর্মচারীর চরণ ধরেই এ যাত্রায় রক্ষা পেলেন। যে মৌলভী সাহেবকে তিনি সকাল বেলা পার্টি অফিসে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিকেল বেলা জন সমর্থন সংগ্রহ করতে, সেই মৌলভী সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়লেন এবং গল্পের পরিসমাপ্তিতে দেখা গেল মৌলভী সাহেবের পায়ে ধরেই চরণদাস এ যাত্রায় নির্বাচন কেন্দ্রের জনসমর্থন নিজের হাতে রাখতে সমর্থ হলেন।


আলোচ্য গল্পের মধ্যে সতীনাথ ভাদুড়ী চরণদাসের যে রকম নিখুঁত ও বাস্তবানুগ চরিত্রচিত্রণ ও তাদের এম.এল.এ. হওয়া ও পদ রক্ষার জন্যে আপ্রাণ প্রয়াসের ঘটনার বর্ণনা করেছেন তা বিরল দৃষ্টান্ত। একসময় তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন বলেই যে এই ভাবে চিত্রগুলি তুলে ধরতে পেরেছেন এ কথা বলাই বাহুল্য। আলোচ্য গল্পের কাহিনির মধ্যেও তাই বাস্তবতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। এবং সেই সঙ্গে দেখা যায়, লেখক কাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকেছেন। তাই গল্পের মধ্যে কোনো অলীক বা আকাশকুসুম কল্পনায় কারো চরিত্রহনন বা দেবত্ব আরোপের নিদর্শন চোখে পড়ে না। সেই সঙ্গে গল্পের শুরু থেকে পাঠক চিত্তে কৌতূহল জাগিয়ে তুলে ক্রমশ কাহিনি এগিয়ে গেছে অপ্রতিহত একমুখী গতিতে পরিণামের দিকে এবং অবশেষে একটিমাত্র শীর্ষবিন্দুতে উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে সমাপ্তি ঘটেছে গল্পের। ফলে ছোটোগল্পের আবৃশ্যিক শর্তগুলি এখানে রক্ষিত হয়েছে যথাযথ ভাবে। তাই আলোচ্য চরণদাস এম.এল.এ.' গল্পটি যে যথার্থই ছোটোগল্প হয়ে উঠেছে এ কথা অপ্রতিবাদে স্বীকার করতে হয়।