‘পুতুল নাচের ইতিকথা' পল্লী-পরিবেশের গল্প বটে, কিন্তু কখনোই ‘পল্লী-সমাজ’-এর নয়।— আলোচনা করো।

বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে পল্লীজীবন প্রথম থেকেই বিষয়বস্তু হিসেবে আকর্ষণীয়। বঙ্কিমচন্দ্রকে বাদ দিলে শরৎ-সাহিত্যে পল্লীজীবন ও পল্লী-পরিবেশের প্রাধান্য ছিল। 'পণ্ডিতমশাই’, ‘অরক্ষণীয়া' বা 'পল্লীসমাজ' শরৎচন্দ্রের সব জনপ্রিয় গ্রন্থ যেখানে পল্লীজীবন ও পল্লী-পরিবেশের বাস্তবচিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রধানত নাগরিক মন ও মননের স্রষ্টা। তাঁর রচনায় পল্লীজীবনের চিত্র থাকলেও তাঁর 'চোখের বালি', 'গোরা', ‘ঘরে বাইরে’, ‘চতুরঙ্গ' প্রধানত শহরাশ্রয়ী উপন্যাস। বাংলার পল্লীজীবন ছিল শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু। তিনি পল্লীজীবনের অবক্ষয়, দুঃখদারিদ্র্য ও সঙ্কীর্ণতাকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু করেছেন। 'পল্লীসমাজ' শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পল্লীজীবনাশ্রয়ী উপন্যাস। বেণী গাঙ্গুলীর মত চরিত্র অঙ্কন করে তিনি পল্লীসমাজের ভণ্ডামিকে নির্মমভাবে আঘাত করেছেন। পল্লীসমাজের সঙ্কীর্ণতা, হীনতা ও দলাদলি কীভাবে স্বার্থান্ধ মানুষের দ্বারা চালিত হয়ে মানুষের ক্ষতিসাধন করেছে, তার নির্মম বর্ণনা 'পল্লীসমাজের’ পাতায় পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শরৎচন্দ্রের এই পল্লীচিন্তাকে গ্রহণ করেছেন ও নিজের মত করে তাকে জারিত করে নতুনভাবে প্রকাশ করেছেন। এইদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'; ‘পদ্মানদীর মাঝি' শরৎচন্দ্রের পল্লীচিন্তার উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান গ্রহণ করেছে।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র গ্রামের নাম গাওদিয়া। নদী আর খাল মিলে গ্রামটির আসা যাওয়ার পথ। নৌকায় খাল পার হলেই গাওদিয়ার সড়ক। বাজিতপুর থেকে মাঠ ভেঙে এসে ঘাসের নীচে অদৃশ্যপ্রায় রেখা দিয়ে পথসংক্ষেপ করে। বটগাছের সামনে খালের পাড় অত্যন্ত ঢালু। বৃষ্টিতে পেছল হয়ে আছে। বটগাছের শাখায় পাখি উড়ে এসে বসে। বুঁদি গাছের ডালে একটা গিরগিটি কিছুক্ষণের মধ্যে অনেক পোকা আয়ত্ত করে ফেলে। গাওদিয়ার প্রান্তভাগ ছুঁয়ে খাল পূর্বে দিক পরিবর্তন করেছে। বাঁকের মুখে গ্রামের ঘাট। গাওদিয়া ছোট গ্রাম। ব্যবসাবাণিজ্যের ধার বিশেষ ধারে না। গ্রামে ঢুকবার আগে খালের সঙ্গে যুক্ত নালার ওপর একটা পুল পড়ে। পুলের নীচে স্রোতের মুখে জাল পেতে নবীন মাঝি বুকজলে দাঁড়িয়ে থাকে। নিতাই নবীন মাঝির মাছ ধরা দেখে। মাগুর-টাগুর মাছ খোঁজে। ছেলে পথ্যি করবে বলে তার এই ব্যবস্থা। হারু ঘোষের মৃতদেহ নিয়ে যে পথ দিয়ে। যায়, সে পথ কাঁচা পথ। বর্ষাকালে একহাঁটু কাদা হয়, এঁটেল মাটিতে বিপজ্জনক রকমের পেছল হয়ে যায়। গোরুর গাড়ির চাকাতে রাস্তার ক্ষতি হয়। বর্ষার পর কাদা শুকোলে মনে হয় আগাগোড়া যেন লাঙলের চাষ পড়েছে। শীতের আবির্ভাবে পথ সমতল হয়ে যায়, কিন্তু রাস্তার ক্ষতগুলো গুঁড়ো হয়ে এত ধুলো হয় যে পায়ের পাতা ডুবে যায়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে বাতাসে ধূলো ওড়ে, গাছগুলিকে বিবর্ণ মনে হয়। এই হচ্ছে গাওদিয়া গ্রামের চিত্র।


অনেক গরীব মানুষের বসবাস এখানে, মধ্যবিত্ত মানুষও অনেক আছে। আছে সন্ন্যাসী-ফকিরদের আস্তানা। পুল পার হয়ে রাস্তার দুপাশে শুধু চষা ক্ষেত। তারপর থেকে গ্রাম আরম্ভ হয়েছে। এদিকে বসতি কম। রাস্তার দক্ষিণে ঝোপঝাড়ের বেষ্টনীর মধ্যে পৃথক কয়েকটা ভাঙাচোরা ঘর। ওখানে সাত ঘর বাগদি বাস করে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে গরীব, সবচেয়ে ছোটলোক, সবচেয়ে চোর। দিনে ওরা যে গৃহস্থের চাল মেরামত করে, রাতে সুযোগ পেলেই তারই ভিটেয় সিঁদ কাটে। ওদের কেউ কেউ ছমাস এক বছর জেলে পড়ে আছে। গ্রামে ফিরে এসে বলে 'শ্বশুর ঘর থে ফিরলুম, দাদা।' একটু পার হয়ে গেলে ঘন বসতি চোখে পড়ে। পথের দুদিকে দু-একটা শাখাপথ পাড়ার দিকে বেরিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে দেখা যায়। মাঝে মাঝে কলাবাগান, সুপুরিবাগান ছোট ছোট বাঁশঝাড় ডাইনে-বাঁয়ে আবির্ভূত হয়। অন্ধকারে আমবাগানকে মনে হয় অরণ্য। কোন কোন বাড়ির সামনে কামিনী, গন্ধরাজ ও জবাফুলের বাগান করার নিষ্ফল চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। পরে দু-একটা পাকা দালানের দেখা পাওয়া যায়। বাড়িগুলো আগাগোড়া দালান নয়। এক ভিটেয় দুখানা ঘর হয়তো ইটের, বাকি শনে দেওয়া চাচের বেড়ায় গ্রামের চিরন্তন নীড়। এই হচ্ছে গাওদিয়া গ্রামের রূপরেখা।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামের এই ভৌগোলিক চিত্র আঁকতে গিয়ে 'ডিটেলসে'র আশ্রয় নেননি। 'ন্যাচারালিস্টের’ মত তন্ন তন্ন করে সব খুঁটিনাটির ব্যবস্থা করেননি। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে একটা আবছা চিত্র এঁকেছেন যাতে গ্রাম্য চিত্রের দারিদ্র্য দুঃখ ভরা আলগা চিত্র লক্ষ্য করা যায়।


এই গ্রামের ছেলে শশী। গোপাল দাসের ছেলে শশী কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে এসেছে। গোপাল দাসের কারবার দালালি ও মহাজনি। লোকে বলে যে সে বার তিনেক জীবন্ত মানুষের কেনাবেচার ব্যাপারেও দালালি করেছে। তিনটে বৃদ্ধের বৌ জুটিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে দু'জন মারা গেছে, বেঁচে আছে শুধু যামিনী কবিরাজ। সেনদিদি সুন্দরী, কিন্তু গ্রামে তার কলঙ্কিনী অখ্যাতি বেশি। গোপালের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে নানা কথা রটনা হয়। এই যামিনী কবিরাজের বাড়ি যাওয়া নিয়ে শশীর সঙ্গে বাবার বিরোধ বাধে। বাক্যালাপ বন্ধ থাকে। গোপালের একমাত্র ছেলে শশী। গাওদিয়ার দীনবন্ধু, আতবন্ধু ডাক্তার। তার আবেগ মানবীয় আবেগ। মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গে সে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু গোপাল তাকে পদে পদে বাধা দেয়। গোপালের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিন্ধ্যবাসিনী। এক পা খোঁড়া মোহনের সঙ্গেতার বিয়ে হয়েছে। সেজো মেয়ে বিন্দুবাসিনীর বিয়ের ব্যাপারটা গোপালের নামের কালিমা হয়ে আছে। জামাই নন্দলাল সাত বছর আগে পাটের কারবার উপলক্ষে গাওদিয়া গিয়ে উঠেছিল। গোপাল তাকে বাড়ি ডেকে নিয়ে গিয়ে আদরযত্ন করেছিল। তারপর কোন অজ্ঞাত ইতিহাসের বলে একদিন বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিয়ে গ্রামবাসীদের উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। গ্রামবাসীরা লাঠি হাতে এই বিয়ে সম্পন্ন করে। নন্দলালের চাকরটা রাতারাতি বাজিতপুর পালিয়েছিল। গ্রামসমাজের এই চিত্র কিন্তু স্বাভাবিক ও বাস্তবধর্মী। কিন্তু লেখক এই অংশের বর্ণনায় বেশি কালি ব্যয় করেননি। এই শান্ত, অনুচ্চ ভঙ্গীটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তবধর্মিতার পরিচায়ক—“তিন দিন পরে গোপালের অনুগত গ্রামবাসীরা লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া বিন্দুর সঙ্গে নন্দলালের বিবাহ দিয়া দিল। নন্দলালের চাক্রটা রাতারাতি বাজিতপুরে পলাইয়াছিল। পরদিন মালিকের উদ্ধারে সে একেবারে পুলিশ লইয়া হাজির। নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কিছু কিছু শাস্তি অনেককেই দিতে পারিত—গম্ভীর বিষণ্ণ মুখে পুলিশকে কিন্তু সেই বিদায় করিয়া দিল। তারপর বউ লইয়া সেই যে সে কলিকাতায় গেল—গাওদিয়ার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখিল না।” গ্রামসমাজের প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা লেখক 'ডিটেলস'-এ করেননি, তিনি এইসব ঘটনাকে পল্লীচিত্র হিসেবে দেখেছেন, কিন্তু ‘পল্লীসমাজ' হিসেবে দেখেননি। অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘অরক্ষণীয়া’-তে যেমন এইসব নৈতিক ঘটনা দিয়ে নানা বিরোধ, নানা প্রতিক্রিয়া অঙ্কিত করা হত, এখানে তা নেই। এখানে লেখক এইসব ঘটনাকে পল্লীজীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবে দেখেছেন ও বর্ণনা করেছেন।


কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসে শশীর শিক্ষা ও রুচি পাল্টে দেয় তার বই ও বন্ধু। কুমুদের মত কবিমনস্ক ও রসিক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হয়। এই আলাপ থেকে পরে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কুমুদ হঠাৎ বিনোদিনী অপেরা পার্টির সঙ্গে যাত্রা করতে আসে। প্রবীর সেজে সে গাওদিয়ার মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। মতিরও মন জয় করে। এইসব ঘটনা গ্রামজীবনের বুকে বেশ উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। মতি-কুমুদ উপাখ্যান তাই গ্রামজীবনের এক নাটকীয় কাহিনী। এই উপাখ্যান গড়ে উঠেছে যে পল্লী-পরিবেশে সেই তালবনের বর্ণনা কিন্তু মানিক এই উপন্যাসে নানা প্রসঙ্গে বার বার করেছেন। কুমুদ শহরের ছেলে, সে শশীর ঘর গুছোনো দেখে বেশ খুশি হয়। গাঁয়ে থেকে শশী গেঁয়ো বনে যায়নি বলে খুশি হয়। সেই কুমুদের সঙ্গে গ্রাম্য বালিকা মতির তালবনের গভীর নির্জনতায় দেখা হয়। তালগাছগুলির প্রহরায় রক্ষিত আছে যুগাত্তের পুরাতন নিভৃত শান্তি। হারু ঘোষের বাড়ির পেছনে তালবনের ওপাশে মাটির টিলা। এই তালবনে কুমুদ মতির কানে মাকড়ি পরিয়ে দেয়। “রাজপুত্র প্রবীর দুপুরবেলা তালপুকুরের ধারে মাকড়িটা নিজের হাতে তাহার কানে পরাইয়া দিয়াছে শুনিলে বাড়িতে তাহাকে আর আস্ত রাখিবে না।” এই বর্ণনার মধ্যে লেখকের রোমান্টিক মনের স্পর্শ লেগেছে। এইসব ঘটনা রূপায়িত করার সময় লেখক গ্রাম্য পরিবেশের রোমান্টিকতাকে কাজে লাগিয়েছেন, কিন্তু 'পল্লী-সমাজের' যে কদর্য গালাগালি ও সমালোচনা 'পল্লীসমাজ'-এ রমা রমেশের কাহিনীর মধ্যে ধুমায়িত বাষ্পের মত সমাবৃত করেছে তাদের প্রেমের সুনীল আকাশ, এখানে কিন্তু তা নেই। কুমুদ প্রবীরের মত এসে মতিকে নিয়ে গেছে, চলে গেছে হনিমুনে, সেখানে প্রশ্ন শুধু একটাই—“কোথায়। গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, তাকে লইয়া কুমুদ চলিল হনিমুনে।” কিন্তু “কিছু টাকা চায় যে শশী”। পরানের কাছে এ ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকে। কনেবৌকে নিয়ে নিরুদ্দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে যাওয়া। এই রীতি গ্রামজীবনের মানুষের পক্ষে দুর্বোধ্য। গাওদিয়ার গ্রামজীবনের মামুলি একঘেয়ে ধারায় তাই উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কুমুদের সঙ্গে মতির বিয়েতে পরানের আনন্দ হয়নি, “শুধু শশীর মুখ চাহিয়া সে সম্মতি দিয়াছিল।” শশীর এতখানি প্রভাব গ্রামজীবনে যে কোন দরদী উদারপন্থী চিকিৎসকের প্রভাবের সমতুল্য। গ্রামজীবনের পরিবেশেই কুমুদ-মতির প্রেম গড়ে ওঠে। সে কথা মানিক বর্ণনা করেছেন একটি মাত্র বাক্যে ঃ “তারপর কুমুদ তালপুকুরের পাড়ে অবোধ গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তার ভালবাসার জন্ম ইতিহাস ধীরে ধীরে শশীকে শুনাইয়া দিল।”—এই একটি মাত্র বাক্যে কুমুদ-মতির ভালবাসার ইতিহাস বর্ণিত হল। মতি সরল গ্রাম্য মেয়ে, তাই কুমুদের কাছে এই ভালবাসার মূল্য বিরাট—“সরল মনের স্নেহ ছাড়া, আর সবই যে ফাঁকি মানুষের জীবনে, মতি কুমুদকে এ শিক্ষা দিয়াছে।”—গ্রামজীবনে, গ্রাম্যমানুষের এটা ইতিবাচক দিক। তবু শশী শহরের ছেলের চোখে এই মহাকাব্য রচনাকে সংযমের চোখে দেখেছে–“মতি? ওই একরত্তি নোংরা মেয়েটা গোপনে গোপনে এত ভালোবাসিয়াছে কুমুদকে? শশীর মনে হয় সব কুমুদের বানানো—দিবাস্বপ্ন, কল্পনা? মুখে মুখে গীতগোবিন্দের মতো যে মহাকাব্য কুমুদ রচনা করিয়া চলিয়াছে, মতি কি কখনো তার নায়িকা হইতে পারে?"


কুসুম রহস্যময়ী মেয়ে। তালবনের পুকুরধারে শশী-কুসুমের রোমান্স গ্রামজীবনের আর এক রোমান্টিক অধ্যায়। কুসুম শণীর ঘরে নির্জনে যায়। গোলাপের চারা পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিয়ে কুসুম শশীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। চারাটি মাড়িয়ে দেবার কথা বলায় কুসুম উত্তর দেয়—“ইচ্ছে করেই দিয়েছি ছোটবাবু, চারার জন্য এত মায়া কেন?” এই সব উক্তি রহস্যময়ী কুসুমের। লেখক তালপুকুরে শশী-কুসুম মিলনের বর্ণনা এইভাবে করেছেন। “শশী তালপুকুরে গেল। কনকনে শীতে তালগাছগুলি পর্যন্ত যেন অসার হইয়া গিয়াছে। পুকুরের অনেকখানি উত্তরে একটা তালগাছ মাটিতে পড়িয়াছিল, শশীকে কুসুম সেইখানে লইয়া গেল। নিজে তালগাছটার গুঁড়িটিতে জাকিয়া বসিয়া হুকুম দিয়া বলিল, 'বসুন ছোটবাবু, অনেক কথা, সময় নেবে বলতে।” এই ভাবে বিন্দুর কথা শোনার আগ্রহ নিয়ে এসে কুসুম অভিসারিকার মত চলে আসে। বিন্দুর কথা শোনাতে শোনাতে শশীর কুসুমকে ‘রহস্যময়ী' বলে মনে হয়। কুসুমের খাপছাড়া ব্যবহার। তার পাগলামি সবই তার প্রণয়ের উপচার। শসী-কুসুম প্রণয়ের এই সৌন্দর্য যেন নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ—গ্রামজীবনের পটভূমিতে তা ফুটে উঠেছে, কিন্তু কোন বেণী গাঙ্গুলীর শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে তা হয়ে ওঠেনি ‘পল্লীসমাজের’ আর একটি দোসর। লেখক শশী-কুসুমের প্রণয়লীলাকে শেষ পর্যন্ত এভাবে নিখুঁত করে এঁকেছেন। সেই কারণেই এই প্রণয়চিত্র এই উপন্যাসে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে। “কুসুমের সংস্পর্শে সে বছরের পর বছর কাটাইয়া দিয়াছিল, একদিনও সে কি টের পাইত না কুসুম কি চায়? একটি নারী মন ভুলাইতে চাহিতেছে, এটুকু বুঝিতে কি সাত বছর সময় লাগে মানুষের?” একজন সমালোচক শশী-কুসুমের অবৈধ সম্পর্ক প্রসঙ্গে অনুরূপ কথা বলেছেন : “শশী-কুসুমের সম্বন্ধ অবৈধ প্রণয়-সম্পর্ক সন্দেহ নেই, তাই একে ঘিরে স্বভাবতই কিছু গোপনতার স্বাদ-সৌরভ সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, সামাজিক শাসন বা দুর্নাম এমনকি কানাকানির কথাও শোনা যায়নি গাওদিয়া গ্রামে। আসলে শশী-কুসুমের যে আকর্ষণ, তার সবটুকুই তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটাই ঘটেছে তাদের দুজনের মনের নিভৃতে, বাইরের সমাজে নয়।” (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবনদৃষ্টি ও শিল্পরীতি)। এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, শশী-কুসুম আখ্যায়িকা এই উপন্যাসের রোমান্টিক আখ্যায়িকা। গ্রামসমাজের বাস্তবতার বর্ণনার মধ্যেও লেখক একটা 'romantic tone' এনে রেখেছেন বলেই এখানে বাস্তবতার স্বাদ ও সৌরভ স্বতন্ত্র। উপন্যাসে পল্লী-পরিবেশের কাহিনীর মধ্যে পল্লী-জীবনের চিত্র আছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘পল্লীসমাজে’-র মত সমাজ-সমালোচনার গ্রন্থ এটা নয়।