'টিনের তলোয়ার' নাটকে বেণীমাধব চরিত্রটিকে দ্বন্দ্ব ও ত্যাগের মাহাত্ম্যে উজ্জ্বল করে গড়ে তোলা হলেও প্রায় সমপরিমাণ ত্যাগমাহাত্ম্যে ও উনিশ শতকের নাট্যচর্চাকে মাতৃস্নেহ লালনের গৌরবে বসুন্ধরা চরিত্রটিও অনবদ্য—আলোচনা করো।

উৎপল দত্তের 'টিনের তলোয়ার’ নাটকের বসুন্ধরা চরিত্র

উনিশ শতকের নাট্যমঞ্ঝের ইতিহাসে অভিনেত্রীর নাট্যপ্রতিভা ও অসামান্য ত্যাগ চিত্রিত হয়েছে 'টিনের তলোয়ার' নাটকের বসুন্ধরা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তা আলোচনা করো।


উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার' নাটকের একটি অন্যতম প্রধান নারীচরিত্র বসুন্ধরা। ঊনিশ শতকের বাংলার তথা কলকাতার রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে সে যুগের অভিনেত্রীদের ত্যাগ ও প্রতিভা যেন উন্মোচিত হয়েছে বসুন্ধরা চরিত্রটিকে আশ্রয় করে) উৎপল দত্ত চরিত্রটির মধ্যে সে যুগের একাধিক অভিনেত্রীর জীবন কথাকে সন্নিবেশিত করে গড়ে তুলেছেন এই তিলোত্তমা প্রতিমা। নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার সে যুগের নাট্যকর্মীদের প্রতি যে প্রণাম ও শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন, তার অনেকখানিই বসুন্ধরার প্রাপ্য।


গ্রেট বেঙ্গল অপেরার প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী বসুন্ধরা। একদা বারাঙ্গানা পল্লী থেকে তিনি অভিনয়জগতে প্রবেশ করেন। বারাঙ্গনাজীবনে তাঁর নাম ছিল আঙুর। অভিনেত্রীজীবনে তিনি পরিচিত হয়েছেন বসুন্ধরা নামে। বসুন্ধরা প্রথমে ছিলেন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনেত্রী। গ্রেট ন্যাশনালের অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি আর বেলবাবুর কাছে তাঁর অভিনয়শিক্ষা। তার জন্য বসুন্ধরার শ্রদ্ধাবোধ ও গৌরববোধও যথেষ্ট। অভিনেত্রী কামিনী গ্রেট ন্যাশনালের প্রতি তার এই শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে কটাক্ষ করলে বসুন্ধরা বলে—“আলবাৎ গুমোর।....আমায় শিখিয়েছে কে জানিস? আমার গুরু অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি আর বেলবাবু।” বসুন্ধরার অভিনয়প্রতিভার প্রতি দলের অভিনেতারা শ্রদ্ধাশীল। পাওনাদার মুদি বাকি টাকার জন্য বসুন্ধরাকে ‘বেশ্যা’বলে গালি দিলে অভিনেতা জলদ মুদিকে তিরস্কার করে বলে—“কাকে কি বলছেন? আপনার সামনে বাংলার শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী, পুণ্যশ্লোক অর্ধেন্দুশেখরের শিষ্যা বসুন্ধরা দেবী।” স্বয়ং বেণীমাধবও বসুন্ধরার অভিনয় প্রতিভার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ময়নাকে দিয়ে ‘ময়ূরবাহন’ নাটকের অনুরাধার পার্ট সম্ভব কিনা সে সম্বন্ধে প্রশ্ন তুললে বেণীমাধব বলেন— “এখানে কে অভিনয় করতে পারে? একজন ছাড়া, ঐ আঙুর, সে করে অভিনয়। আমরা জলে আঁক কাটি।”


কিন্তু তার বয়স যৌবন অতিক্রম করায় বসুন্ধরা আর নাটকে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ের যোগ্য নন। গ্রেট বেঙ্গল অপেরার নায়িকা হিসাবে এতকাল প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন বেণীমাধবের হাতে গড়া অভিনেত্রী মানদাসুন্দরী। বারাঙ্গনা পল্লী থেকে আগত মানদাসুন্দরী বেণীমাধবের অভিনয় শিক্ষার দৌলতে জনপ্রিয়তা অর্জন করায় প্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যদল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার মানদাসুন্দরীকে ভাঙিয়ে নিয়ে যায়। ফলে গ্রেট বেঙ্গল অপেরা যে সংকট ও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, তার সমস্ত দায়িত্ব যেমন নট-নির্দেশক বেণীমাধবকে বহন করতে হয়েছে, তেমনি বেণীমাধবের তথা সমগ্র দলের সমস্ত সমস্যার অংশভাগী হয়েছে বসুন্ধরা। নাট্যকার বসুন্ধরা চরিত্রটিকে এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যে, পাঠক বা দর্শক তাঁর মধ্যে প্রথমাবধিই আবিষ্কার করেন এক বাৎসল্যময়ী মাতৃমূর্তিকে। গ্রেট বেঙ্গল অপেরা বেণীমাধবের কাছে যেমন ধ্যান জ্ঞান, তেমনি এই নাট্যদল যেন বসুন্ধরার কাছেও এক আপন সংসার। সেই সংসারের সমস্ত সদস্যের ভালোমন্দের প্রতি এই মাতৃসমা নারীর সজাগ দৃষ্টি, দলের সমস্ত সমস্যা-সংকটে তাঁর আত্মিক কল্যাণকামনা যেন পরম শুশ্রূষার মতো সিঞ্চিত।


সমস্ত নাট্যদল যখন তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত, তখন এতগুলি সদস্যের অন্নসংস্থান ও অন্যান্য সুখ-সুবিধার প্রতি গৃহস্থ পরিবারের মায়ের মতো পরম মমতায় সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন আঙুর তথা বসুন্ধরা। পুরোনো অব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি করে কোনোক্রমে নিয়মিত অন্নসংস্থানের আয়োজনটুকু করে চলেছেন তিনি। নটবর, যদু, জলদেরা যখন ‘ময়ূরবাহন' নাটকের মহলায় ব্যস্ত, তখন বেণীমাধব নিদ্রামগ্ন হলেও যথাসময়ে বসুন্ধরা হাজির হন মুড়ির ঠোঙা হাতে–“নাও, নাও, খেয়ে নাও বাবারা, বড্ড বেলা হয়ে গেল।” নটবরকে মধ্যাহ্নের খাবার ব্যবস্থা করতে তিনি বাজার পাঠান মাত্র আট আনা পয়সা দিয়ে। কিন্তু এই দুরবস্থা যাতে অন্যেরা শুনতে না পায়, সেজন্য সতর্ক করেন নটবরকে। পুরোনো সেজবাতিটা বিক্রি করতে না পারলে আর তাঁর সংসার চলে না। কিন্তু সেজবাতিটা কেউ কিনতে রাজি নয়। কিন্তু সেই অভাবের জন্য নটবর দল তুলে দেবার কথা বললে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। কারণ দলের ওপর অদ্ভুত মায়া বসুন্ধরার। অভিনয় ও নাট্যদলকে তিনি জীবন দিয়ে রক্ষা করতে চান—“বেঙ্গল অপেরা ওঠে না, তুলে দেওয়া যায় না।”


নাট্যদলে সংগীতশিল্পী যদুগোপাল। তার গানের গলা যাতে সুস্থ ও সুন্দর থাকে, সেজন্যও বসুন্ধরা সর্বদা সচেতন। জিরে, রসুন, ঘি জাল দিয়ে তার কণ্ঠের শুশ্রূষা ও যত্নে ব্যস্ত হন বসুন্ধরা—“তোমায় গাইতে হয় বাবা, গলা ভাল রাখতে হয়।” হরবল্লভবাবুকেও তিনি যথাসময়ে ওষুধ খাওয়ান।


কিন্তু দলের কাছে যিনি ‘দিদি’ হলেও প্রকৃতপক্ষে মাতৃসমা, জনসমাজে তিনি বাজারের ‘কসবি’ আঙুর এবং ঘৃণ্য। মুদিও সেই ঘৃণা তার সামনেই নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করে। কিন্তু দলের স্বার্থে এই অপমান বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নেয় বসুন্ধরা। প্রতিবাদী জলদকে থামিয়ে দিয়ে বসুন্ধরা বলেন—“কি করছো? ও পাওনাদার। টাকা পাবে—”। মুদি তাকে বেশ্যা বলে গালি দিলেও সেই মুদিকে তোয়াজ করে কথা বলেন বসুন্ধরা, যেন সমস্ত দায় তাঁর—“শুনুন, বাবু দয়া করুন, টাকাটা জোগাড় হয়নি এখনো।” আরো বলেন—“আপনি ছাড়া আমাদের কে দেখবে বাবা, পুলিশে খবরটা দেবেন না। যে করে হোক আপনার টাকা শোধ করে দেব।” শেষপর্যন্ত সেই অবিক্রিত সেজবাতিটি মুদিকে দিয়ে তখনকার মতো অবস্থা সামাল দেন বসুন্ধরা।


মানদাসুন্দরীর পরিবর্ত হিসাবে বেণীমাধব ময়নাকে অনুরাধার ভূমিকায় অভিনেত্রী হিসাবে তৈরী করে নিতে চাইলে অন্যান্য সহঅভিনেতাদের সঙ্গে বসুন্ধরাও কিছুটা সংশয়ী হয়। কিন্তু বেণীমাধরের অভিনয় শিক্ষার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তাই বেণীর কথামতো আলুওয়ালি ময়নাকে স্নান করিয়ে ভালো কাপড় পরিয়ে প্রস্তুত করে আনেন বসুন্ধরাই। আর প্রথম থেকেই ময়নাকে সে বাৎসল্যদৃষ্টিতে দেখে। করণীয়-অকরণীয় সম্বন্ধে নির্দেশ দেন, বকেন, সস্নেহ আদর করেন।


কিন্তু কোনো পাওনাদার সম্বন্ধে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সতর্ক বসুন্ধরা। প্রিয়নাথ মল্লিকেও বসুন্ধরা কোনো পাওনাদার ভেবে সমীহ করে কথা বলে। তাকেও সে জলখাবারের মুড়ি দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চায়। তার দেওয়া ‘পলাশীর যুদ্ধ' নাটকের পাণ্ডুলিপি বেণীমাধবের উদাসীনতায় নষ্ট হয়ে গেলে বসুন্ধরা বলেন—“তুমি কিছু ভেবো না বাপু, এখুনি পাতা মিলিয়ে আবার ঠিক করে দিচ্ছি।” কিন্তু আস্তাকুড় থেকে নাটকের সবটুকু উদ্ধার করা বসুন্ধরার আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও আর সম্ভব হয় না। প্রিয়নাথ ক্রুদ্ধ হলে বসুন্ধরা মাতৃসমা সারল্যে তার ক্রোধ প্রশমনের জন্য সান্ত্বনাবাণী দেন—“সকাল থেকে কিছু খায়নি কিনা, তাই অমন রেগে যাচ্ছে। বাপ-মারও বলিহারি বাবা! এমন হীরের টুকরো ছেলে, সায়েবদের কলেজে পাশ দিয়ে বেরিয়েছে, কথায় কথায় ইংরেজি লাইন ঝাড়ছে, তাকে খেতে দেয় না।” বেণীমাধব প্রিয়নাথের উদ্ধত ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হলে বসুন্ধরাই বেণীকে বুঝিয়ে বলেন— “.... বেচারার নাটকটা সবাই মিলে নষ্ট করলাম, আবার ওকে টুইয়ে দিচ্ছ।” গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী বীরকৃয় দাঁর প্রতি বেণীমাধবের আচরণে ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ পেয়ে গেলেও বসুন্ধরা নাট্যদলের স্বার্থে তাঁর সঙ্গেও অনুগত ব্যবহার বজায় রাখেন—“আপনার চরণ ভিন্ন অনুগতদের গতি নেই।”


নাট্যমঞ্চের প্রতি বসুন্ধরার শ্রদ্ধা অপরিসীম। কেননা এই নাট্যমঞ্চই তাঁর ও তাঁদের ক্ষুধার অন্ন এবং বাঁচার প্রেরণা দেয়। এই মঞ্চই তাঁকে অভিনেত্রী হিসাবে সর্বসমক্ষে পরিচিতি দিয়েছে। তাই ময়না প্রথম মঞ্চে প্রবেশ করার সময় সেই শ্রদ্ধাবোধ তিনি ময়নার মনেও সঞ্চারিত করতে চান—“এস্টেজকে নমস্কার কর।” ময়নার প্রতি অপরিসীম মমতা অনুভব করেন বসুন্ধরা। তাকে কন্যাসমা মনে হয় বলেই কামিনীর মতো কোনো ঈর্ষার দ্বারা তাড়িত হন না। বসুন্ধরা, বরং তার ভবিষ্যৎ জীবন গৌরবের হবে বলে মঙ্গলকামনা করেন—“ও আমার চেয়ে অনেক ওপরে উঠবে, হরবাবু, অনেক অনেক ওপরে।” বেণীমাধব ময়নাকে ভর্ৎসনা করলে মায়ের স্নেহ নিয়েই তিনি ময়নাকে সান্ত্বনা দেন ও বেণীকে তিরস্কারের জন্য অনুযোগ করেন। ময়না যে বেণীবাবুর শিক্ষাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করার জন্য এই ক'দিন অসামান্য সাধনা করেছে, সে ব্যাপারে বেণীকে আবেগময় ভাষায় অবহিত করেন বসুন্ধরাই—“দু’মাস ধরে ওর দুর্জয় তপস্যায় তোমার সিংহাসন টলেনি, দেবতা? দিনে রাত্রে না খেয়ে না ঘুমিয়ে ওর এই সাধনা। এমন তাপসী তুমি দেখেছ কখনো দেবরাজ?”


এহেন কন্যাসমা ময়নাকে যখন বীরকৃষ্ণ রক্ষিতা হিসাবে কিনে নিতে চায়, এবং বেণীমাধব স্বাধীন থিয়েটারের লোভে তাতে সম্মত হন, তখন প্রিয়নাথের সঙ্গে প্রতিবাদে গলা মেলান বসুন্ধরাও। বসুন্ধরা বেণীমাধবকে বাধা দেন নারীত্বের সম্মান রক্ষার প্রশ্নে। ময়নার সঙ্গে প্রিয়নাথের মধুর সম্পর্কের প্রতি সম্মান জানিয়ে বসুন্ধরা প্রিয়নাথকে অনুরোধ করেন ময়নাকে গ্রহণ করতে, এক স্থূলরুচি ধনী বাবুর রক্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকার অসম্মান থেকে তাকে উদ্ধার করতে। বেণীকে এমন সিদ্ধান্তের জন্য তীব্র তিরস্কার করে বসুন্ধরা বলেন—“যাকে ময়না ঘেন্না করে তার সঙ্গে জোর করে গাঁটছড়া বেঁধে দেয়ার চেয়ে মেয়েটাকে মেরে ফেললেই তো পারো। নিজের মেয়ে হলে একাজ করতে পারতে না বাবু।”


যথার্থই বেণীমাধবের কাছে না হলেও ময়না বসুন্ধরার কাছে নিজের মেয়ে। আসলে নিজের অপমানিত জীবনের লাঞ্ছনা ও যাবতীয় অতৃপ্তি অপূর্ণতা থেকে ময়নাকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন বসুন্ধরা। নিজের অপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন তিনি পূর্ণ করে তুলতে চেয়েছেন ময়নার সার্থক জীবনের মধ্য দিয়ে—“ঘর বাঁধো ময়না! আমি ঘর বাঁধতে পারিনি।” ময়নার কাছে এই আকৃতির মধ্যেই তিনি প্রকাশ করেন নিজের লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণার ইতিহাস। পনেরো বছর বয়সে কোনো এক রাজাবাহাদুর তাঁকে অপহরণ করে রক্ষিতা হিসাবে রাখেন। পরে শখ মিটে গেলে পতিতাবৃত্তি করে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন বসুন্ধরা। পতিতাবৃত্তির ঘৃণ্য জীবন থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন অভিনেত্রী হয়ে। তাই আজ ময়নাকে অভিনেত্রীজীবন থেকে রক্ষিতা বা পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দেওয়াকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। বসুন্ধরা তাই ময়নাকে বলেন—“তুমি আমার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, ময়না, তোমার সংসার হোক, কোলে রাঙা ছেলে আসুক, তোমার মধ্যে আমি পূর্ণ হই।”


বেঙ্গল অপেরার কাপ্তেনবাবু বহুমুখী চাপের মুখে প্রিয়নাথের প্রস্তাবমতো যখন নাট্যদল-রক্ষার তাগিদে জাতীয়তাবাদী বা স্বদেশানুরাগমূলক বিদ্রোহাত্মক নাটক মঞ্চস্থ করতে পারেন না, তখনও স্পষ্টভাবে সম্মতি বা প্রতিবাদ না করলেও বোঝা যায় বসুন্ধরার প্রাণেও দেশমাতৃকার বন্ধনমুক্তির জন্য একটা তীব্র আকুলতা আছে। অবস্থাবিপাকে সেই স্বপ্নপূরণ না হলেও বসুন্ধরার অন্তরে আছে ব্যক্তিজীবনের ব্যর্থতার যন্ত্রণার মতোই এক তীব্র জ্বালা। সেজন্যই ‘তিতুমীর’ নাটকের অভিনয়ে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজের স্বরূপ উচ্চারণ করেন—“এরা হার্মাদ, জলদস্যু ! এয়েছে লুঠ করতে। নারীর সতীত্ব নাশ করে, সোনার ভারতেরে ছারখার করে চলে যাবে সপ্তডিঙা ভাস্যে!” এই সংলাপ শুধু প্রিয়নাথের বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশক নয়, এ মনোভাব বসুন্ধরারও যেন নিজের তিনি নিজে নারী, ঔপনিবেশিক শাসনে বিদেশী প্রভু আর তাদের বশংবদ স্বদেশি প্রভুদের কাছে নারী কেবল সম্ভোগের উপকরণ। বসুন্ধরা এই সম্ভোগপ্রবণ সমাজব্যবস্থার শিকার। তাই বসুন্ধরার চেতনায় দেশমাতৃকাও ইংরেজের শাসনপাশে ধর্ষিতা নারীরূপে তাঁর নিজ জীবনাভিজ্ঞতারই সমসূত্রে গ্রথিত হয়ে যায়। 'তিতুমীর' নাটকের সংলাপ উচ্চারণের মধ্য দিয়েই বসুন্ধরার বাদ-প্রতিবাদহীন নিরুচ্চারতা যেন প্রতিবাদী ভাষা লাভ করে।


সমগ্র নাটকে বসুন্ধরা যেন বাংলা থিয়েটারের মাতৃসমা ধাত্রীরূপেই পরিকল্পিত হয়েছেন। সমাজের নিম্নভাগের পঙ্কস্তূপ থেকে পবিত্র পঙ্কজরূপেই যেন তাঁর জন্ম। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চূড়ান্ত লোভ ও কামনার শিকার হয়েও দেশীয় সংস্কৃতির তথা নাট্যকর্মীদের জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ। ময়নার মতো নতুন প্রতিভার মধ্যেই তিনি স্বপ্নপূরণের আশ্বাস খুঁজে পান। এবং নাটকের শেষভাগে বসুন্ধরাই হয়ে ওঠেন পরাধীন ধর্ষিতা দেশমাতৃকার শরীরীমূর্তি। “নারীর প্রতিবাদী বা বিদ্রোহিনী মূর্তিতে উত্তরণের মধ্যে দিয়েই বসুন্ধরা যেন ব্যক্তি নারীর, সমগ্র নারীসমাজের এবং স্বদেশপ্রতিমার যথার্থ মুক্তির সম্ভাবনাটিকে স্পষ্ট করে তোলেন।