“বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনটির বিষয়বস্তু হলো হানিফ ও অন্যদের হাতে ভক্তপ্রসাদের লাঞ্ছনা'। —আলোচনা করো।

প্রহসনকার মধুসূদনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মধ্বজী চরিত্র অঙ্কন করে তাকে পরিহাস করা। অবশ্য কোনো গুরুতর সমাজসংস্কার করা মধুসূদনের উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি মূলত ভক্তপ্রসাদবাবুর ন্যায় ভণ্ড, ধর্মধ্বজী চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন এবং নিপীড়িত প্রজাদের হাতে তার লাঞ্ছনা ঘটানোই মধুসূদনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। প্রহসনটির মূল বিষয় গড়ে উঠেছে হানিফ ও অন্যদের হাতে ভক্তপ্রসাদের লাঞ্ছনাকে কেন্দ্র করে। ভক্তপ্রসাদবাবু ভণ্ড ও পরনারীলোলুপ; অথচ বাইরে তিনি ধার্মিক সেজে ঘুরে বেড়ান। প্রহসনের সূচনাতেই তার মালা জপনিরত মূর্তি দেখা যায়। মধুসূদন এই ধর্মধ্বজীদের প্রতি ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ-বাণ নিক্ষেপ করেছেন।


ভক্তপ্ৰসাদ মালা জপ করে অথচ গদাধর তাকে হানিফের বৌয়ের খবর এনে দিলে সে এমন আচরণ করে যা হাস্যোদ্রেক করে। যেমন-

‘গদা। ও বেটা এবার যে ছুড়ীকে নিকে করেছে তাকে কি আপনি দেখেছেন?

ভক্ত। না।

গদা। মশায়, তার রূপের কথা আর কি বলবো! বয়স বছর উনিশ, এখনও ছেলেপিলে হয় নি, আর রঙ যেন কাঁচা সোনা।

ভক্ত। [ মালা জপিতে জপিতে ] অ্যা? — অ্যা? — বলিস কি রে?'


ভক্তপ্রসাদের চরিত্রগত স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য প্রথমে পাঁচীর প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। প্রথম অঙ্কেই পাঁচীর শেষ ও প্রথম আবির্ভাব। অনেকের মতে, এ প্রসঙ্গটি অবতারণা নাও করা যেত; কিন্তু ভক্তপ্রসাদের চরিত্র-স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য পাঁচী প্রসঙ্গের অবতারণা স্বীকার করে নিতে হয়। ভক্তপ্রসাদ বৃদ্ধ হলেও তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নারীলোলুপতার ভাব বজায় আছে এবং পরস্ত্রী দর্শনে তা জাগ্রত হয়। পাঁচীকে দেখে ভক্তপ্রসাদ কামজর্জর হয়ে কবিতা বলেছে—

“মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া।

অদ্যাপি কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া ৷৷

আহা! কুঁচ হৈতে কত উচ্চ মেরু চূড়া ধরে।

শিহরে কদম্ব ফুল দাড়িম্ব বিদরে৷৷"


গদাধর ভক্তপ্রসাদের এই জাতীয় আচরণকে বুড়ো বয়সের ‘লোভাত্তি' বলেছে। ভক্তপ্রসাদের নির্লজ্জ আচরণও তার উক্তিতে প্রকাশিত হানিফের স্ত্রীর প্রসঙ্গে—“আঃ, এ ছুড়ীকে যদি হাত কত্যে পারি।' প্রথমাঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে ভক্তপ্রসাদ অনুপস্থিত হলেও তার ভণ্ডামি ও অধর্মাচরণের কথা শোনা যায় পুঁটি ও হানিফের সংলাপে -

‘পুঁটি। বাবু এদিকে আবার পরম বৈষ্টব। মালা ঠকঠকিয়ে বেড়ান্। ফি সোমবারে হবিষ্যি করেন— আ মরি, কি নিষ্ঠে গা।'


আবার হানিফের কথায়— 'শালা রাইওৎ বেচারীগো জানে মারে, তাগোর সব লুটে লিয়ে, তার পর এই করে। আচ্ছা দেখি, এ কুম্পানির মুলুকে এনছাফ আছে কি না।'


বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন উক্তির মাধ্যমে শুধু যে ভক্তপ্রসাদকে বিদ্রূপ করা হয়েছে তাই নয়, তার জন্য চরম লাঞ্ছনার, অপদস্থ করার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এর প্রধান কর্মকর্তা হলো হানিফ, তার বৌ ফতিমা ও বাচস্পতি। হানিফের পরামর্শে ফতিমা পুঁটির কাছ থেকে টাকা গুণে নেয় ও মাঝরাতে বাড়ির বাইরে আসতে সম্মত হয়। কিন্তু হানিফ তাকে সাবধান করে - ‘দেখিস্ ফতি, যা কয়ে দিচ্ছি, যেন ইয়াদ থাকে, আর তুই সমঝে চলিস্ বেটা বড় কাফের, যেন গায়-টায় হাত না দিতি পায়।


হানিফ ও ফতিমার পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে বাচস্পতি। কেননা ভক্তপ্রসাদ তার ব্রহ্মত্র জমি কেড়ে নিয়ে তাকেও বঞ্চিত করেছে।


প্রথম অঙ্কের শেষে পুঁটি ফতিমাকে সাঁঝের বেলা আমবাগানে যেতে রাজি করায়। ফতিমার স্বামী হানিফ প্রস্তুতি নেয় এবং বাচস্পতি হানিফকে সাহায্য করে।


দ্বিতীয় অঙ্কে দু'টি গর্ভাঙ্ক আছে। প্রথম গর্ভাঙ্কের ঘটনাস্থল ভক্তপ্রসাদের বৈঠকখানা। ভক্ত অভিসারে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। হানিফের বৌকে রাজি করানো গেছে জেনে সে খুশী হলেও পাঁচীকে যে পাওয়া শক্ত এটা বুঝে সে বেদনা বোধ করে— “দীনবন্ধো, তোমারই ইচ্ছা। পুঁটি বলে যে পঞ্চী ছুঁড়ীকে পাওয়া দুষ্কর, কি দুঃখের বিষয়! এমন কনকপদ্মটি তুলতে পারলেম না হে!”


এই দৃশ্যে ভক্তর চরিত্রের আরেকটি হাস্যকর দিকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। ভক্ত বাইরে ধ্বজাধারী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অধর্মাচারী। অথচ নিজের ছেলে অম্বিকা সম্বন্ধে তাকে বলতে শোনা যায়— “আমার বোধ হয় অম্বিকাপ্রসাদ কখনই এমন কুকর্ম্মাচারী হবে না- সে আমার ছেলে কি না।”


এ কথা শুনে বোঝা যায় সবচেয়ে বড় অধর্মাচারী আবার ধর্মের বড়াই করে। আরও মজা হল, ভক্ত হিন্দু ধর্ম আর জাতবিচার নিয়ে বড় চিন্তিত। আবার আনন্দকে সে প্রশ্ন করে— “শুনেছি- কল্‌কেতায় না কি বড় বড় হিন্দু সকল মুসলমান বাবুর্চী রাখে?”


এই প্রশ্নের উত্তরে ব্যঙ্গবিদ্ধ হয়েছে ভক্তবাবু। গদাধর বলেছে— “নেড়েদের ভাত খেতে জাত যায়, কিন্তু তাদের মেয়েদের নিলে কিছু হয় না। বাঃ! বাঃ! কত্তাবাবুর কি বুদ্ধি।”


কিন্তু গদাধরের এই উক্তি স্বগত এবং তা দর্শকদের কর্ণগোচর হয় না এমন নয়।


দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্ক প্রকৃতপক্ষে ভক্তপ্রসাদের হাস্যকর আচরণেরই ছবি। এই দৃশ্যে ভক্তর পুনঃপ্রবেশ ঘটে। গদাধরের বর্ণনায় - “ইস! আজ বুড়র ঠাট্ দেখলে হাসি পায়! শান্তিপুরে ধুতি, জামদানের মেরজাই, ঢাকাই চাদোর, জরির জুতো, আবার মাথায় তাজ। হা! হা! হা!”


বৃদ্ধের এই হাস্যকর সাজ ও অভিসারে যাত্রা স্বভাবতই কৌতুকপ্রদ। তাজ মাথায় দিয়ে ভক্তর টিকিটা ঢাকা পড়েছে এ সংবাদেও দর্শকের হাসি পায়। এমনিভাবেই ভক্তর পরনারী সন্দর্শনে যাত্রা প্রহসনোচিত লঘু হাস্যের পরিবেশ রচনা করে। ভক্ত যেভাবে আরসিতে মুখ দেখে আতরের শিশি ট্যাকে রেখে দেয় তাও যথেষ্ট কৌতুকপ্রদ। এত কাণ্ডের পরে ভক্তর লাঞ্ছনাদৃশ্য তাই যথোপযুক্ত হয়ে ওঠে পরের দৃশ্যে। ভক্তর যে আর তর সইছে না এই ভাব এই দৃশ্যের কয়েকটি কথোকপথনে চমৎকার ফুটে উঠেছে।


দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে এই প্রহসনের ঘটনার সমাপ্তি। দৃশ্যের প্রথমেই বাচস্পতি ও হানিফের কথোপকথন। হানিফের কথায় ক্রোধ প্রকাশ পায় - “...লেকিন্ আমার সামনে যদি আমার বিবির গায়ে হাত দেয়, কি কোন রকম বেইজ্জৎ কত্তি যায়, তা হলি তো আমি তখনি সে হারামজাদা বেটার মাথাটা টান্যে ছিঁড়ে ফেলবো!”


এই ক্রোধ অকারণ নয়। প্রথম অঙ্কে হানিফকে যতটা ক্রোধহীন শাস্তশিষ্ট মনে হয়েছিল, দ্বিতীয় অঙ্কে তা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে ওঠে। অত্যাচারের ভয় আছে জানলেও এবং জমিদারের জমিতে বসবাস করে রক্ত গরম করা যায় না বুঝেই সে বলেছে - “আমার তো এখনে আর কোন ভয় নেই; আমি দোস্রা এলাকায় ঘরের ঠ্যাক্‌না করিছি।”


হানিফ ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, যদিও এই আত্মবিশ্বাস প্রথম অঙ্কে ছিল না। অবশ্য বাচস্পতি তাকে শান্ত করে এবং দুজনে কাছাকাছি একটা গাছে উঠে চুপ করে বসে থাকে।


ফতিমাকে নিয়ে পুঁটি অকুস্থানে এসে পৌঁছায় একটু পরেই। এখানে তাদের কথাবার্তায় এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে যাতে ভূতবেশী হানিফের আগমন সহজ হয়। আকস্মিকতা দোষ থেকে নাটকের কাহিনীকে মুক্ত করতেই অন্ধকার ও ভূতের প্রসঙ্গ এসেছে ফতিমা ও পুঁটির সংলাপে।


হানিফ ভূতবেশে মঞ্চে এসে গদাকে চপেটাঘাত করে ভক্তের পিঠে বসে মুষ্ট্যাঘাত করে এবং পুঁটিকে পদপ্রহার করে দ্রুত প্রস্থান করে। এইসময় বাচস্পতি প্রবেশ করে। ফলে মুখরক্ষার জন্য ভক্তপ্রসাদকে বলতেই হয়— “আমি কল্যই তোমার সে ব্রহ্মত্র জমি ফিরে দেবো, আর দেখ তোমার মাতৃশ্রাদ্ধে আমি যৎসামান্য কিঞ্চিৎ দিয়েছিলেম, তা আমি তোমাকে নগদ আরও পঞ্চশটি টাকা দেবো, কিন্তু এই কম্মটি করো যেন আজকের কথাটা কোনরূপে প্রকাশ না হয়।"


শেষ পর্যন্ত অপমানিত ভক্ত জাত খোয়াবার ভয় পায়। হানিফকে দুইশত টাকা দিতে স্বীকার করে। ভক্তকে বলতে শোনা যায় - ‘‘আমি বিবেচনা করে দেখলেম যে এ কর্ম্মের দক্ষিণান্ত এইরূপেই হওয়া উচিত। যা হোক ভাই, তোমাদের হতে আমি আজ বিলক্ষণ উপদেশ পেলেম। এ উপকার আমি চিরকালই স্বীকার করবো। আমি যেমন অশেষ দোষে দোষী ছিলেম, তেমনি তার সমুচিত প্রতিফলও পেয়েছি।”


এইভাবেই ভক্তর স্বীকারোক্তির দ্বারা নাটকের সমাপ্তি ঘটে। এবং হানিফ ও বাচস্পতির হাতে ভক্তপ্রসাদের লাঞ্ছনা যে প্রহসনের বিষয়বস্তু তা প্রমাণিত হয়।