“নিজের চারিদিকে সে যে শিক্ষা ও সভ্যতার খোলটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছিল। কুসুম তাহাতে ফাটল ধরাইয়া দিয়াছে।" কার কথা বলা হয়েছে? অংশটির তাৎপর্য বুঝিয়ে বলো।

“পৃথিবীটা চিরকাল ঈশ্বরের রাজ্য। মানুষের এই বহুমূল্য সংসার সহজে যাইবার নয়। হাজার পাপ করিলেও নয়।"–উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

পৃথিবীর বুকে বসে মানুষ নানা পাপ-পুণ্যে জড়িত হয়। মানুষের সুকৃতির পাশাপাশি চলে দুষ্কৃতির কাহিনি। সুকৃতি ও দুষ্কৃতির জন্য মানুষ ফলভোগ করে। মানুষ অন্যায় কর্মের জন্য মনে মনে অপরাধবোধ করে। এই অপরাধবোধ মানুষকে শাস্তি দেয়, বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয় মানুষ। অপরাধবোধকে কেউ বাড়াতে চায় না, তাহলে অনেক সময় অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে, অনেক অঘটন এসে জীবনকে জটিল করে তোলে। পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টি। ঈশ্বরের বিধানই মানুষের কর্মজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষের জীবন কর্মফলের নামান্তর। জীবনের পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশ, সবকিছু খতিয়ান এই ঈশ্বরবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ঈশ্বর হয়তো মানুষের যুগযুগান্তের সংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের পাপ সীমাহীন, ঈশ্বরে বিশ্বাসও অসীম। মানুষ পাপ করে ঈশ্বরকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায়। ঈশ্বর মানুষের এমনই এক সংস্কার যার মূল দূর-নিহিত। এই দৃঢ়মূল সংস্কারপ্রিয়তার জন্য মানুষ বাঁচার পথ খোঁজে। যামিনী কবিরাজের স্ত্রীকে মরণাপন্ন রোগ থেকে বাঁচাবার জন্য শশী আপ্রাণ সেবা করেছে। এ ব্যাপারে শশীর সেবা ও যত্ন অনেকের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। স্বয়ং যামিনী কবিরাজ এ ব্যাপারে শশীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। এর পেছনে ছিল গোপালের উস্কানি। তাদের মনে পাপ ছিল, পাপ ছিল বলেই তারা শশীকে ভয় করত। শশী সরল, সহজ ও ঋজু। এইকারণে সে কাউকে গ্রাহ্য করে না। তার মনে কোনো পাপবোধ থাকে না। কিন্তু যারা অবচেতনে পাপী, তারা কিন্তু মনে করে পৃথিবী চিরকাল ঈশ্বরের রাজ্য। হাজার পাপকর্ম করলেও এই সংস্কার ও বোধ অপনীত হয় না। শশীর বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তায় তাই স্বচ্ছতা আছে। সে ঈশ্বর নামীয় কোনো কুসংস্কারের আড়ালে নিজেকে ঢাকা দেয় না। তার চিন্তা-কর্ম-আবেদন সবই স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও অকপট। কাপট্যের অন্তরালে যারা বাস করে, তারা কিন্তু স্পষ্ট ও সহজ হয় না। তাই তাদের প্রয়োজন হয় ঈশ্বর চিন্তার।



“নিজের চারিদিকে সে যে শিক্ষা ও সভ্যতার খোলটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছিল। কুসুম তাহাতে ফাটল ধরাইয়া দিয়াছে।" কার কথা বলা হয়েছে? অংশটির তাৎপর্য বুঝিয়ে বলো।

এখানে শশী ডাক্তারের কথা বলা হয়েছে।

সব সাফল্যের পেছনের ইতিহাস হয়তো অন্ধকারে মোড়া থাকে। শশী তার বাবা গোপালের অন্যায়-অর্জিত টাকায় লেখাপড়া শিখেছে। কলকাতায় গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে পড়ে ডাক্তারি পাশ করেছে। গ্রামে এসে ডাক্তারি করে তার পসার প্রতিপত্তি হয়েছে যথেষ্ট। অর্থ এবং যশের দৌলতে সমাজে তার একটা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠার জন্য তার যৎসামান্য গর্বও আছে। তাই ভিন্ন স্তরের মানুষকে সে একটু ঊনদৃষ্টিতে দেখে। হারু ঘোষের অবস্থা সচ্ছল ছিল। পরে তা অনেকটা নিম্নগামী হয়েছে। কুসুম হারু ঘোষের ছেলে পরাণের বৌ। কুসুম শশীর প্রতি দুর্বল। ডাক্তার হিসেবে শশী তার কাছে যায়। তাই কারণে-অকারণে সে শশীর সান্নিধ্য চায়, তাকে ডেকে পাঠায়। একদিন অসহ্য পেটের ব্যথা উপলক্ষে কুসুম শশীকে শীতের রাতে ডেকে পাঠিয়েছিল। শশী একটু বিরক্ত বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত প্রাণঘাতী ব্যথার কথা ভেবে কুসুমের বাড়ি চলে যায়। তার রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে শশীকে একটু বিভ্রান্ত হতে হয়। কুসুম শশীকে অনেক বক্র তীক্ষ্ণ কথা শোনায় যার থেকে তার মনের অবচেতনের অনেক ভাব ধরা পড়ে। কবে সে মতিকে ম্যালেরিয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পরীক্ষা করেছিল। সে সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর মন্তব্য করতে ছাড়ে না। শশী কুসুমকে ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিজে আর যায় নি। শশীর ওষুধ তুচ্ছ সাদা বড়ি। এটা ওষুধ না ছাই? ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমা সত্ত্বেও কুসুমের মন ওঠেনি। এতে শশী বিরক্তবোধ করে। 'কুসুমের মনটা শশীর বোধগম্য হয় না। শশীকে সে ভিজিট দিতে চায়। এই প্রসঙ্গে শশী প্রশ্ন করে এই ‘ভিজিট’ কোন চুরির টাকায় কিনা। এতে কুসুম ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে আক্রমণ করে। কুসুম বলে যে মোষের গলায় ছুরি দেওয়া পয়সায় তারা বড়লোক হয়নি। এই মন্তব্যে শশীর সামাজিক মর্যাদা আহত হয়। তার সাফল্যের বাতাবরণে যে অনৈতিক ইতিবৃত্ত আছে, তা কুসুম ফাঁস করে তাকে জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এতদিন যে মর্যাদার প্রাচীরে আবেষ্টিত ছিল শশী তা ভেঙে যায়। এই ঘটনায় শশী মর্মাহত হয়। কুসুমও শেষে কম অনুশোচনা করে না। লোকের গলায় ছুরি দিয়ে গোপন সচ্ছল হয়েছে একথা শশীও জানে। কুসুম সেই দুর্বল দিকে আঘাত করে শশীর সমাজের ভব্যতার মুখোশ ও গরিমাকে ভেঙে দিল।