'অন্তঃসলিলা' গল্পটির মধ্যে লেখিকা অসামান্য দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন অনেকগুলি গৌণ চরিত্রও—মন্তব্যের আলোয় ‘অন্তঃসলিলা' গল্পের গৌণচরিত্রগুলি সৃষ্টিতে সাবিত্রী রায়ের নৈপুণ্য বুঝিয়ে দাও।

‘অন্তঃসলিলা' সাবিত্রী রায়ের একটি অসামান্য ছোটোগল্প। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অসামান্যা গৃহবধূর আখ্যান সাবিত্রী রায়ের 'অন্তঃসলিলা'। প্রফেসর সেনের স্ত্রী শকুন্তলা দেবী বৃহৎ সংসারের প্রাত্যহিক বোঝা ঠেলেও সাহিত্যসাধনা করেন, এখানেই তাঁর অসামান্যতা। আসলে সাবিত্রী রায় এই গল্পে দেখাতে চান, পুরুষশাসিত এই সমাজে সৃষ্টিশীল নারীর সৃষ্টিবাসনাও কেমনভাবে তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সংসারের যাবতীয় দায়, পরিবারের সদস্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দায় সামলানোর পরেও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে কারও কাছে এতটুকু উৎসাহ বা প্রশংসা পান না শকুন্তলা। তবু সার্বিক এই উপেক্ষা, উদাসীনতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেই কোনো আশ্চর্য অলৌকিক প্রেরণায় অব্যাহত থাকে তাঁর সাহিত্যচর্চা। সহস্র বাধার মধ্যেও একটি নারীর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও সৃষ্টিশীলতার আখ্যানই ‘অন্তঃসলিলা' গল্পের মূল বিষয়। আর ছোটোগল্পের শর্ত মেনেই যেন গল্পটি একান্ত ভারহীন, আখ্যানের জটিলতাহীন এবং চরিত্রবাহুল্যহীন। গল্পটির প্রধান চরিত্র শকুন্তলা সেন, গৃহবধূ এবং লেখিকা। এ ছাড়া শকুন্তলার -আবিষ্কর্তা বা সেই প্রধান চরিত্রের স্রষ্টা রাধারাণী পাবলিশার্সের দেবব্রত। দেবব্রতও যেন এই গল্পের গৌণ চরিত্র। শকুন্তলাই এই গল্পের প্রধান ও একমাত্র আকর্ষণকেন্দ্র।


কিন্তু তা বলে সাবিত্রী রায় যে শকুন্তলার পারিপার্শ্বিক বা সমাজকে বিস্মৃত হয়ে দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে ফেলেছেন, তা নয়। সমাজ ও পরিবারের অন্যান্য চরিত্রগুলির প্রতিও তিনি সমানভাবেই সজাগ, কেবল ছোটাগল্পের স্বার্থে ও দৃষ্টিকেন্দ্রকে সংহত রাখার প্রয়োজনে তিনি অন্য চরিত্রগুলিকে প্রায় স্কেচের মতো সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছুঁয়ে গেছেন মাত্র। অথচ কলমের জাদুতে সেই সংক্ষিপ্ত গৌণ চরিত্রগুলিও যেন নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে আশ্চর্য দীপ্তিমান।


গল্পের সূচনাতেই কফিহাউসের আড্ডায় আমরা পেয়ে যাই লেখক শিবনারায়ণ ব্যানার্জী এবং বিশিষ্ট মানুষ রঞ্জন রায়কে। এঁরা বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের অগ্রগণ্য মানুষ। কিন্তু দেবব্রতর সঙ্গে তাঁদের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন বা সান্নিধ্যের পরিসরেই আমরা দেখতে পাই একটি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দর্পিত ছবি। মহিলাদের লেখালেখি সম্পর্কে পুরুষ সাহিত্যিকদের তথা বিদগ্ধ পাঠকসমাজের একটা তীব্র উপেক্ষা ও অবজ্ঞাই মূর্ত হতে দেখি শিবনারায়ণ ব্যানার্জীর মন্তব্যে—“মেয়েদের লেখা আবার উপন্যাস।” প্রথমত -মেয়েদের লেখা, দ্বিতীয়ত ‘আনকোরা’ লেখিকা, ফলে রাধারাণীর লোকসানের সম্ভাবনাটির দিকে ইঙ্গিত করে শিবনারায়ণ ব্যানার্জী মেয়েদের ভাবনাচিন্তার গভীরতা, তাদের যাবতীয় সারস্বত সাধনার উদ্যোগকেই অর্থহীন প্রতিপন্ন করতে চান। এমনকি শকুন্তলার লেখায় নতুন কোনো টেকনিকেরও একান্ত অভাব আছে বলেও তাঁর অভিমত। শকুন্তলার স্বামী প্রফেসর সেনের দিকে কটাক্ষ করেন রঞ্জন রায়—“তোমার বৌ তো এনতার লিখছে হে! এরকম ঘষতে ঘষতেই হাত পেকে যাবে।” অর্থাৎ, শকুন্তলার হাত যে এখনও পরিণত নয়, যেন সে কথাটাই ইঙ্গিতে বলতে চান রঞ্জন রায়। এরকম সংকীর্ণমনা অথচ বুদ্ধিজীবী আরও একটি চরিত্র শিবেশ রায়, যিনি কোনো সাহিত্যালোচনা সভায় সমকালীন সাহিত্যিক মহারাজের বাণী উদ্ধৃত করে নিজের প্রগতিশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় জাহির করেন।


শকুন্তলা দেবীর ৮/৭ বি নম্বর বাড়িতে পৌঁছে প্রথমেই দেখা হয় এক মহিলার সঙ্গে। “ভিতর হতে দুয়ারের খিলটা খুলে যায়। মস্ত এক শব্দ করে একটি মেয়েমানুষ বের হয়ে আসে, কতকগুলি তরকারির খোসা আর কুচো চিংড়ির আঁশ এনে ঢেলে দিয়ে যায় গলির একধারে।" এই বিবরণেই সাবিত্রী রায় রেখে যান শকুন্তলার বাসস্থানের অপরিচ্ছন্ন অস্বাস্থ্যকর রুচিহীন পরিবেশের সংকেত। সেই মহিলাটিই দেবব্রতকে সাত ভাড়াটের এই অপরিসর বাড়িতে শকুন্তলা দেবীদের অবস্থানটি কোনদিকে, তা দেখিয়ে দেয়।


শকুন্তলা দেবীর নির্দিষ্ট দরজায় পৌঁছে প্রথম দেবব্রত সাক্ষাৎ পায় বছর সাতেকের একটি বালিকার, শকুন্তলার কন্যা। তার কাছেই শোনা যায়—“মা রান্না করছেন।” কিন্তু শুধু এই সংবাদটুকু নয়, সৌজন্যবোধ ও ভদ্রতাবোধ আছে এই বালিকাটির। কেননা সে দেবব্রতকে ভেতরে এসে বসতে অনুরোধ করে। আবার ঘরে ঢুকেও দেবব্রতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে “ওকি, আপনি দাঁড়িয়েই আছেন। বসুন না লক্ষ্মীটি। মা এক্ষুণি আসবেন। পত্রিকা এনে দেব?” বোঝা যায়, মেয়েটির শালীনতাবোধও এই বয়সে যথেষ্ট। পত্রিকা এনে দেবার প্রস্তাবে রয়েছে সাহিত্যিক মায়ের সাহচর্যে তৈরি হওয়া সারস্বত রুচির পরিচয়। দেবব্রতর মনে হয়—"অপরিমিত যত্নে বেড়ে ওঠা কৃশ একটি ছোট্ট মেয়ে—কিন্তু সুস্থ একটি প্রাণ রয়েছে উজ্জ্বল চোখদুটিতে।” ‘কৃশ' শব্দে ফুটে ওঠে আর্থিক দুর্বলতার পরিচয় এবং উজ্জ্বল প্রাণময় চোখের বর্ণনা স্পষ্ট হয় চরিত্রটির এই বয়সেই ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য। আবার ভিতর থেকে ঠাকুমার ডাকে তার ছুটে চলে যাওয়ার মধ্যে লেখিকা ফুটিয়ে তোলেন পারিবারিক আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধের ছবিও। খানিক পরে দেবব্রতকে চা দিয়ে যায় মেয়েটি। তাতে বোঝা যায় সাংসারিক কাজেকর্মে সে তার মাকে যথাসাধ্য সাহায্যও করে থাকে। দেবব্রতর আবার মনে হয়—“যেন একটি সোনালি রোদের রেখা জোর করেই ঢুকে পড়েছে এ আবদ্ধ ঘরে।"


অন্তঃপুর থেকে ভেসে আসা প্রাচীনাদের কণ্ঠস্বরেও ফুটে ওঠে স্পষ্ট চরিত্র। একজন শকুন্তলার শাশুড়ি, অন্যজন হয়তো কোনো প্রতিবেশিনী। তাঁদের কথোপকথনে ঝরে পড়ে পরচর্চা, কুৎসা এবং নানা অনুযোগ। শাশুড়ি যখন আক্ষেপ করেন এই বয়সেও তাঁকে চাল বাছতে হয় বলে, সংসারের খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে, কিংবা তিনি যখন শিশুকন্যার কান্না থামাতেও প্রাচীনা বধূকেই ডাক দেন, তখন বোঝা যায় শকুন্তলা দেবীকে সংসারের শতপাকে জড়িয়ে তার সৃষ্টিশীলতাকে থামিয়ে দেওয়াই তাঁর আসল লক্ষ্য। প্রাচীনা শাশুড়ি তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত করেন বধূটির সাহিত্য-অনুরাগের প্রতিই—“বিদ্বান ছেলের বিদুষী বৌ।” এই শাশুড়ি চরিত্রটি নেপথ্যে থাকলেও সাবিত্রী রায় চরিত্রটিকে ঠিক একমাত্রিক রাখেন না। একদিকে পুত্রবধূর সাহিত্যচর্চার প্রতি সামন্ততান্ত্রিক বিদ্বেষ, রক্ষণশীল প্রাচীনতার স্বভাবসুলভ বধূপীড়নের মানসিকতা, আবার অন্যদিকে যেন আর্থিক অসংগতির জন্য অসহায়তা এবং পুত্রবধূর প্রতি কিছুটা করুণারও আভাস তাঁর চরিত্রে ফুটে ওঠে। কেননা কলতলায় কাঁথা কাচতে যাওয়ায় উনুনে ডাল পুড়ে যাওয়ার প্রতি প্রতিবেশিনীটি যখন শাশুড়িকে পুত্রবধূর প্রতি আরও বিরূপ করে তুলতে চায়, তখন শাশুড়ি বলেন—“না গিয়েই বা করবে কি। একটু বেলা হতে না হতেই যা ভিড় লেগে যায় কলতলায়। এক বাড়িতে সাত ভাড়াটে।” কিন্তু তবু পুত্রবধূর প্রতি সহানুভূতি বা বাৎসল্যের বদলে বিদ্বেষটাই যেন স্পষ্ট শাশুড়ি চরিত্রে। আর প্রতিবেশিনী প্রাচীনা চরিত্রে ঈর্ষাকাতরতা ও বধূবিদ্বেষ লক্ষণীয়।


গল্পে আর এক পার্শ্বচরিত্র শকুন্তলার দেবর। যার নাম সম্ভবত সুকু। যিনি স্নান করে খেতে বসার আগে পর্দা সরিয়ে ঘরের বাইরের অংশে বসা দেবব্রতকে একবার কৌতূহলী চোখে দেখে যায়। এভাবে দেখার মধ্যে রুচির অভাবটি স্পষ্ট হয়। তারপর বৌদির প্রতি তার কৌতুকময় মন্তব্যে মিশে যায় তীব্র শ্লেষাত্মক ও কুৎসিত ইঙ্গিত–“গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই আবার গল্পের নায়িকা হয়ে পড়ো না যেন।


গল্পের অপর গৌণ চরিত্র শকুন্তলার স্বামী প্রফেসর সেন। কফি হাউসেও এই মানুষটির নীরব উপস্থিতি আমরা গল্পের সূচনায় দেখেছি। রঞ্জন রায়ের তির্যক মন্তব্যেও তিনি নীরব ছিলেন। এই নীরবতা সম্মতির লক্ষণ কি না সংশয় থাকে। তবে সেই সংশয় মুছে যায় গল্পের শেষাংশে। কেননা শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার পিছনে অধ্যাপক সেনের উৎসাহ ও প্রেরণা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু শকুন্তলার গল্প তিনি পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি দেবব্রতকে বলেন—“গল্পটা পড়ার কি আর ফুরসত আছে।...এককালে ছিল ওসব সাহিত্য-টাহিত্যের উৎসাহ।” তিনি অধ্যাপক হয়েও সাহিত্যব্যাপারে উদাসীন। বিশেষত স্ত্রীর সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে, এটা সত্যিই বেদনাদায়ক। তিনি সাংসারিক চাপে টিউশনের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। তাঁর সাংসারিক দায় ও আর্থিক দুরবস্থার প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকলেও স্ত্রীর প্রতি এই উপেক্ষা একজন অধ্যাপকের কাছে মোটেই প্রত্যাশিত নয়।


গল্পের শেষে আরও একটি চরিত্র পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। সে শকুন্তলার ভাই সুব্রত। সে তার দিদির কাছে কিছু টাকা চাইতে এসেছে। শকুন্তলা তাকে কথা দিয়েছিল লিখে কিছু টাকা সাম্মানিক হিসাবে পেলে তা থেকে সুব্রতকে টাকাটা দিতে পারবে। কিন্তু সাম্মানিক শকুন্তলা না পাওয়ায় সুব্রতকে ফিরিয়ে দিতে হয় খালি হাতে। সুব্রতর সংলাপে বোঝা যায়, দিদির প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল—“আমি ওদের আশা দিয়ে এসেছি-দিদির কাছে ঠিক পাব—কথা যখন দিয়েছে সে।" তার এই টাকার চাহিদা তার চরিত্রের প্রতি আমাদের কৌতূহলী করে। সংলাপে বোঝা যায়, সুব্রত সমাজসেবী ও রাজনৈতিক কর্মী। তাদের রাজনৈতিক বন্দি নেতা অরুণদা জেল থেকে বেরিয়েছে দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে। তাঁকে স্যানিটোরিয়ামে পাঠাতে হবে চাঁদা তুলে। তাই তার টাকার প্রয়োজন। প্রফেসর সেনের সংসার সর্বস্বতার বিপরীতে সুব্রত চরিত্রটি সমাজের আরও একটি স্বার্থত্যাগী সংগ্রামী অংশের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।


অর্থাৎ ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পে প্রধান ও কেন্দ্রীয় চরিত্র শকুন্তলা হলেও এবং গৌণ চরিত্রগুলি অত্যস্ত সংক্ষিপ্ত হলেও সাবিত্রী রায়ের অসামান্য লেখনীকৌশলে সেই গৌণ চরিত্রগুলিকেও সজীব ও স্পষ্ট করে তুলেছে।