কমেডির সংজ্ঞা নির্দেশ করে যে কোনও একটি রসোত্তীর্ণ বাঙলা কমেডি সম্পর্কে আলোচনা কর।

কমেডি নাট্যসাহিত্যের একটি সুপ্রাচীন শাখা হলেও তার পশ্চাদপটে যে ধরনের জীবনদৃষ্টি বিদ্যমান থাকে তা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়, যেমন উপন্যাসেও প্রকাশিত হতে পারে। কমেডির স্বরূপবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিভিন্ন মতভেদ বর্তমান। দর্শক বা পাঠকের মানসে কমেডির প্রতিক্রিয়া বা ফলশ্রুতির ভিত্তিতে তার সম্পর্কে দুটি প্রধান তত্ত্ব প্রচলিত। দার্শনিক হস্-এর আলোচনায় প্রথম তত্ত্বটিকে পাওয়া যায়। এই তত্ত্ব ফরাসী দার্শনিক বের্গস, ইংরেজ নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক মেরিডিথ প্রভৃতি অনুসরণ করেছেন। এই তত্ত্বানুযায়ী, আমরা যখন অপরের কোনও দুর্বলতা ত্রুটি-বিচ্যুতির তুলনায় নিজেদের যোগ্যতর বা শ্রেষ্ঠতর মনে করি, তখনই কমেডির হাস্যরস সৃষ্ট হয়। কিন্তু অপরের দুর্বলতা ত্রুটিবিচ্যুতি সব সময়ই হাস্যরসাত্মক হয় না, অথবা কোনো চরিত্রের ত্রুটিবিচ্যুতিঘটিত বিড়ম্বনায় আমরা অবিমিশ্রভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ববোধের চরিতার্থতা অনুভব করি না। সেরভান্তেসের বিখ্যাত নায়ক ডন কুইকসোট নিজেকে মধ্যযুগীয় নাইট বা বীরযোদ্ধা মনে করে নানা ভুলভ্রান্তি করে এবং নিজেকে হাস্যকর করে তোলে, আমরা তার সম্পর্কে কিছুটা আত্মগত শ্রেষ্ঠত্বও অনুভব করতে পারি, কিন্তু তা অবিমিশ্র নয়। ডন কুইকসোট বাফুন বা ভাঁড় নয়, সে আমাদের কাছে হাস্যকর হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে আমরা তার আদর্শবাদের ও সরলতার জন্য তাকে ভালবাসি এবং তার প্রতি সহানুভূতি বোধ করি। মেরেডিথের মতে, হাস্যরস সাধারণ বুদ্ধির ক্ষুরধার তরবারি ; তার সাহায্যে মানুষের নির্বুদ্ধিতা ছিন্নভিন্ন করা হয়, অর্থাৎ তার আলোকে মানুষের চারিত্রিক দুর্বলতা বিশ্লেষণ করে আমরা একধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করি। মেরিডিথের এই আলোচনায় নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পেয়েছে। কমেডি আমাদের মধ্যে সে রসানুভূতি জাগ্রত করে, এই তত্ত্বের সাহায্যে যথার্থভাবে তার স্বরূপ নির্দেশ করা সম্ভব নয়।


দ্বিতীয় তত্ত্বটির মূল ভিত্তি অসঙ্গতি, অ্যারিস্টটল তার মুখ্য প্রবক্তা। কান্ট, শোপেনহাওয়ার প্রমুখ দার্শনিকেরাও কমেডির স্বরূপ নির্দেশে এই তত্ত্বকে অনুসরণ করেছেন। অ্যারিস্টলের মতে, জীবনের যে কৌতুকাবহ দিকটি পীড়ন করে না, ব্যথা দেয় না, হাস্যরস সৃষ্টি করে, তাই কমেডির উপজীব্য : “A comedy is an imitation of men worse than the average; worse, however, not as regards any and every sort of fault, but only as regards particular kind, the ridiculous, which is a species of the ugly. The ridiculous may be defined as a mistake or deformity not productive of pain or harm to others." এই কৌতুকের জন্ম ইচ্ছার সঙ্গে অবস্থার, আকাঙ্খার সঙ্গে প্রাপ্তির, উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায়ের, কথার সঙ্গে কাজের, বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনা বা ধ্যানধারণার অসঙ্গতিতে। অসঙ্গতি, ট্র্যাজেডি ও কমেডি দুইয়েরই মূল ভিত্তি। ট্র্যাজেডিতে নায়কের সঙ্গে তার পরিবেশের অসঙ্গতিকে মর্মস্পর্শী বেদনা ফুটিয়ে তোলে, আর কমেডির নায়ক বা পাত্রপাত্রীর সঙ্গে আমাদের সাধারণ জগতে অসামঞ্জস্য বা বৈষম্য সেই অসঙ্গতিকে কৌতুকরসসিক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একান্ত স্থূল বা নির্বোধ ব্যক্তি যখন নিজেকে বুদ্ধিমান প্রতিপন্ন করতে চায়, অজ্ঞানী যখন জ্ঞানের দম্ভে স্ফীত হয়, কুচক্রী যখন নিজেকে সরলরূপে প্রতিপন্ন করতে চায়, নিজস্ব ধ্যানধারণা স্বপ্ন কল্পনার জগতে বন্দী থেকে যখন কেউ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে গিয়ে বিড়ম্বিত বা লাঞ্ছিত হয়, তখন আমরা কৌতুক অনুভব করি। এই কৌতুকের মধ্যে পরপীড়নেচ্ছা পরিমিত মাত্রায় থাকতে পারে। অপরের বিড়ম্বনা, লাঞ্ছনা, দুর্গতি ইত্যাদিতে আত্মপ্রসাদ লাভ করার বাসনা মানুষের একটি সাধারণ মনোবৃত্তি। কমেডির পাত্রপাত্রীদের দুর্গতি, বিড়ম্বনা, অসঙ্গতির লাঞ্ছনা ইত্যাদিকে এমন একটি মাত্রায় সীমিত রাখা দরকার যাতে আমাদের সেই পরপীড়নেচ্ছা একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম না করে। অসঙ্গতিজনিত আঘাত যখন মনের অনতিগভীর স্তর অতিক্রম করে গভীর স্তরে পৌঁছয়, তখন হাসি অশ্রুতে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের 'হাস্যকৌতুকে'র আলোচনা অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, কেউ আছাড় খেলে আমরা হেসে উঠি, কিন্তু সেই দুর্ঘটনায় সে আহত হলে নিশ্চয়ই আমাদের মনে কৌতুকবোধ সঞ্চারিত হবে না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন : “কমেডি এবং ট্র্যাজেডি শুধু পীড়নের মাত্রাভেদ। কমেডিতে যতটুকু নিষ্ঠুরতা প্রকাশ হয় তাহাতেও আমাদের হাসি পায় এবং ট্র্যাজেডিতে যতদূর পর্যন্ত যায় তাহাতে আমাদের চোখে জল আসে ... অসঙ্গতির তার অল্পে অল্পে চড়াইতে চড়াইতে বিস্ময় ক্রমে হাস্যে এবং হাস্য ক্রমে অশ্রুজলে পরিণত হয়।”


সাধারণতঃ কমেডিতে কোনও মতামত বা পক্ষপাতিত্বের উগ্রতা পরিহার করে মধ্যপন্থার মানদণ্ডকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। কমেডির নির্মল প্রসন্ন কৌতুকরসের নির্ঝরে মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি দুর্বলতা, সংকীর্ণতা প্রভৃতি গ্লানিকলুষ ধৌত হয়ে গিয়ে একটি অনাবিল আনন্দের জ্যোতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য কোনও কমেডিতে বিদ্রুপাত্মক সমাজ-সমালোচনা কিংবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমালোচনা প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে, কিন্তু সেই সমালোচনা কখনই নির্মম হয়ে আমাদের হৃদয়কে বিদ্ধ করে না। ট্র্যাজি-কমেডি রচনায়ও শেক্সপিয়ারের কৃতিত্ব অতুলনীয়। The Merchant of Venice, As You Like It, Much Ado About Nothing প্রভৃতি তাঁর মধ্যবর্তী যুগের রোমান্টিক কমেডিগুলির বিষয়বস্তু প্রেম। জীবন ও আনন্দের উৎসরূপে প্রেমের মহিমা এই নাটকগুলিতে চিত্রিত হয়েছে। এই রোমান্টিক কমেডিগুলিতে ব্যঙ্গের কোনও তীব্রতা বা জ্বালা নেই, আছে লঘু হাস্যপরিহাস, সহানুভূতির স্নিগ্ধস্পর্শ। কিন্তু তাদের লঘু হাস্যপরিহাসের পশ্চাপটে নাট্যকারের বলিষ্ঠ জীবনাদর্শের উদ্ভাস আমরা লক্ষ্য করি, সামগ্রিক সুন্দর জীবন লাভ করতে হলে তার জন্য মূল্য দিতে হয়, এই প্রত্যয় হাস্যপরিহাসকে অর্থের গভীরতা দান করেছে। শেক্সপিয়ারের রোমান্টিক কমেডির নায়ক নায়িকারা এই মূল্য দিতে দ্বিধা বোধ করেনি। মধ্যযুগে মানুষের জীবন ও তার আবেগ-অনুভূতি ছিল মৃত্যুর বিভীষিকায় আড়ষ্ট, ধর্মযাজকেরা সব সময়েই এই শিক্ষা দিতেন যে প্রেম এবং জীবনকে ভালবাসা অপরাধ। রেনেসাঁসের প্রভাবে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে মানুষ তার জীবন, বাসনা কামনা, আবেগ অনুভূতির এক নতুন মর্যাদা লাভ করতে থাকে। শেক্সপিয়ারের রোমান্টিক কমেডিগুলিতে আমরা তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করি। The Merchant of Venice-এর নায়িকা পোর্সিয়া, As You Like It এর নায়িকা রোজালিল্ড, Much Ado About Nothing-এর নায়িকা বিয়াত্রিচ প্রভৃতি নারীচরিত্রগুলি সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মক্ষমতায়, রসিকতাবোধ ও বাগ্-বৈদগ্ধ এবং ভাবাবেগে আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। সকলের প্রিয়, প্রীতি ও স্নেহের পাত্রী এই নারীচরিত্রগুলি শেক্সপিয়ারের কমেডিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। শেক্সপিয়ারের All Well That Ends Well, Troilus and Cressida ও Measure For Measure সমস্যামূলক কমেডিরূপে অভিহিত, এই নাটকগুলির মোহমুক্তি, তিক্ততা, ব্যর্থতা পাওয়ার গ্লানি, অবিশ্বাস ও কামনার অন্ধকার জগতে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎস্ফুরণের মতই মনুষ্যত্বের আলোক ঝলকিত হতে দেখা যায়।


রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’কে একটি সার্থক বাঙলা কমেডি বলা যায়। এই কৌতুক নাটকটি ক্ষুদ্রায়তন, মাত্র তিনটি দৃশ্য সংবলিত। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র বৈকুণ্ঠ, সে তার নিজের লেখায় ভর্তি খাতা সম্পর্কে বাতিকগ্রস্ত। তাঁর ধারণা, এই খাতার মধ্যে অনেক মূল্যবান সম্পদ আছে, অন্য লোকের তাতে আগ্রহ থাকুক বা নাই থাকুক সে সকলকে ধরে তা শোনাবেই। তার নিজের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান খাতাটিই অপরের কৌতুকের খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখেছি, একজন ব্যক্তির উক্তি ও আচরণ যদি অন্যান্য সকলের সাধারণ ও পরিচিত আচরণ থেকে ভিন্ন হয়, তবেই তা হাস্যরস সৃষ্টি করে। সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, বাতিকগ্রস্ত বৃদ্ধটির উৎকেন্দ্রিক আচরণকে কেন্দ্র করে কৌতুকরস সৃষ্ট হয়েছে।


বৈকুণ্ঠের ছোট ভাই অবিনাশ অধিক বয়সে বিবাহ করে বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তার বাতিক স্ত্রীকে কেন্দ্র করে। সে-ও যখন নিজের আবেগের উচ্ছ্বাসপূর্ণ লেখা অন্যান্যদের শোনাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে, তখন সমগ্র নাটকটির কৌতুকরস আরও বৃদ্ধি পায়। নাট্যকার দেখিয়েছেন, বিশেষ অবস্থায় পড়লে সকলেই বাতিকগ্রস্ত হয়ে অন্যান্যদের কৌতুকের খোরাকে পরিণত হতে পারে। কেদার ও তিনকড়ি চরিত্র দুটিও অত্যন্ত সজীব, কেদার সুবিধাবাদী, স্বার্থসর্বস্ব ও প্রবঞ্চক, তিনকড়ি আত্মসুখসন্ধানী ও পরনির্ভরশীল হলেও একেবারে মনুষ্যবোধ বর্জিত নয়। বৈকুণ্ঠের বাতিক হাস্যরস সৃষ্টি করলেও তার উদার, আত্মভোলা ভাব ও ভাইয়ের প্রতি স্নেহ মমতাপরায়ণ স্বভাব আমাদের সহানুভূতিকে আকর্ষণ করে। শেষকালে বৈকুণ্ঠ নিজের লেখার বিফলতা বুঝতে পেরেছে। তাকে সকলের কাছে অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত হতে দেখে তার সম্পর্কে আমরা গভীর বেদনাবোধ করি, কমেডির সঙ্গে ট্র্যাজেডির যে মৌলিক বিরোধ নেই, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে; বৈকুণ্ঠের সম্পর্কে আমাদের কৌতুকবোধ বিষাদে মিশে যায়। কিন্তু বৈকুণ্ঠ গৃহত্যাগ করে চলে গেলে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ট্র্যাজেডিতে পরিণত হত। উপসংহারে দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন তা হতে দেয়নি, নাটকটির কমেডির বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছে।