'পয়লা নম্বর' গল্পে রবীন্দ্রনাথের নানা বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়েছে— এই মত সাপেক্ষে আলোচনা করো।

রবীন্দ্রসাহিত্যে হাস্যরস একটি অত্যুজ্জ্বল সম্পদ। গল্প উপন্যাস নাটক প্রভৃতির মধ্যে এমনকি চিঠিপত্রের মধ্যে তাঁর পরিহাসপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। আলোচ্য ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের মধ্যেও সেই পরিহাসপ্রিয়তা ধরা পড়েছে। এখানে নিজেকে গল্পকথক হিসেবে উপস্থাপন করে বিদ্রুপের ছুরিতে শান দিয়েছেন লেখক।


আলোচ্য গল্পের গল্পকথকের নাম অদ্বৈতচরণ। অর্থাৎ একটি মাত্র পা যাঁর। সেই খোঁড়া মানুষের সংসার যে কি ভাবে চলে তারই নমুনা দিয়েছেন গল্পকার। গল্পকথক কাণ্ডজ্ঞানহীন গ্রন্থকীট। তিনি সংসার দেখেন না, সমাজ দেখেন না, নিজের স্ত্রীর প্রতি কোনো কর্তব্য করেন না। এইরকম কান্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তির মুখ দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রূপ করেছেন গল্পকার। সে বিদ্রূপের মধ্যে হাস্যরসের প্লাবন থাকলেও তার তীক্ষ্ণ ফলাটা যেন সরাসরি বেঁধে পাঠকদের শিক্ষিত মনে। যেমন নিজের পাশ না করার কারণ হিসেবে অদ্বৈতচরণ বলেছেন, “ছেলেবেলা থেকেই এত অসম্ভব-রকম বেশি বই পড়েছি যে পাস করতে পারি নি। যতখানি কম পড়া পাস করার পক্ষে অত্যাবশ্যক তার সময় আমার ছিল না।"—অর্থাৎ সরাসরি ভাবেই বলেছেন যে বেশি বই পড়ে বিদ্যাচর্চা প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার অনুকূল নয়। জ্ঞানের চেয়ে নম্বরের ওপর বেশি কদর সেখানে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ছাপ মারা ছাত্রের ও জ্ঞানের পরিধি নোটভিত্তিক— সীমিত। এর পরেই আবার আঘাত করেছেন এই বলে, “আমি ফেল করা ছেলে বলে আমার একটা মস্ত সুবিধে এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় বিদ্যার তোলা জলে আমার স্নান নয়-স্রোতের জলে অবগাহনই আমার অভ্যাস। আজকাল আমার কাছে অনেক বি. এ. এম. এ. এসে থাকে। তারা যতই আধুনিক হোক, আজও তারা ভিক্টোরীয় যুগের নজরবন্দী হয়ে বসে। আছে।..... বাংলাদেশের ছাত্রের দল পুত্রপৌত্রাদিক্রমে তাকেই যেন চিরকাল প্রদক্ষিণ করে থাকবে।” বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা যে এক জায়গায় এসে স্থাণু হয়ে বসে গেছে তাকেই বিদ্রূপ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এই ভাবে।


এর পরেই অদ্বৈতচরণের জবানীতে বিদ্রূপ করেছেন, বাংলাদেশের সাময়িক পত্রপত্রিকাগুলির লেখকগোষ্ঠীকে। লিখেছেন, “দেশের চারিদিকে সাময়িক ও অসাময়িক সাহিত্যে যে সমস্ত কথাবার্তা শুনি তা একদিকে এত কাঁচা, অন্য দিকে এত পুরোনো যে মাঝেমাঝে তার হাঁফধরানো ভাপসা গুমোটটাকে উদার চিন্তার খোলা হাওয়ায় কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। অথচ লিখতে কুঁড়েমি আসে।”—এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। প্রথমত পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীর প্রাচীন ধারানুসারি আলোচনা, সেই সঙ্গে ফুটকাটা সমালোচকদের মতো যাদের লেখার ক্ষমতা নেই অথচ সমালোচনার খই ফোটে মুখে–ঠিক মাঠে না নেমে খেলার সমালোচক হওয়ার মতো মানসিকতাকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন।


অনিলা সম্বন্ধে অদ্বৈতচরণের বরাবরই একটা অবজ্ঞা ছিল। তারই প্রকাশ পেয়েছে অনিলার নাম প্রকাশ করার আছিলায়—“আমার স্ত্রীর নাম অনিলা। ঐ শব্দটার মানে কী তা আমি জানি নে, আমার শ্বশুরও যে জানতেন তা নয়।” এই অবজ্ঞা শুধু স্ত্রীর প্রতি নয় শ্বশুরের প্রতিও। সমাজে তাদের স্থান যে কতটা হীনমূল্য ছিল তারই প্রমাণ পাওয়া যায় এই কথায়। হাসির মোড়কে বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়েছে এখানে।


সেইসঙ্গে মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে আমাদের ধারণাকে কটাক্ষ করেছেন এইভাবে–“দেখেছ মেয়েদের কেমন একটা সহজ বোধ আছে? তাই যে-সব জিনিস প্রমাণযোগে বোঝা যায় তা ওরা বুঝতেই পারে না, কিন্তু যে-সব জিনিসের কোনো প্রমাণ নেই তা বুঝতে ওদের একটুও দেরি হয় না।'


কানাইলাল হেসে বলল, 'যেমন পেঁচো, ব্রহ্মদৈত্য, ব্রাহ্মণের পায়ের ধূলোর মাহাত্ম্য, পতিদেবতা পূজার পুণ্যফল ইত্যাদি ইত্যাদি।”


বস্তুত, সমগ্র গল্পটাই গল্পকার রচনা করেছেন কটাক্ষপাতিক বাতাবরণে। সেই জন্যেই সুকুমার রায় প্রবর্তিত মণ্ডা ক্লাবে গল্পটি পাঠ করার পর রাত একটা পর্যন্ত তর্ক করে কাটিয়েছিলেন সেই সভা উপস্থিত শ্রোতারা।