'একরাত্রি' গল্পে গীতিপ্রাণতা বা লিরিকধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করো।

‘একরাত্রি' গল্পে একটা বক্তব্য আছে। কিন্তু এই বক্তব্য কোনো সাংসারিক বা সামাজিক সমস্যাজাত নয়। কোনো তত্ত্বকথাও এর মধ্যে স্বপ্রধান হয়ে ওঠে নি। কোনো চরিত্রায়ন সেই গল্পে একেবারেই গৌণ। এই গল্প-কাহিনীর মধ্য দিয়ে কোনো রূপক অর্থও আমাদের কাছে ধরা দেয় নি। কাহিনির প্রথমাংশে কাহিনীর বিস্তার ঘটলেও, গল্পের প্রয়োজনে এতে কিছু কিছু ঘটনার বিন্যাস ঘটলেও কাহিনির পরিণাম ঘটনাগত নয়, ভাবগত। একটি শান্ত ত্যাগে, জীবনের পরম লগ্নকে লাভ করবার রোমান্টিক তৃপ্তিকে এক অপরূপ সুর-ঝঙ্কার গল্পটিতে বেজে উঠেছে। লৌকিক প্রয়োজনের কোনো চরিতার্থতা গল্পটিতে নেই। এর মধ্যে বেজে উঠেছে বাঁশির সুরের আনন্দময় মুক্তি। গল্পের এই কাব্যধর্মী আবহই গল্পটিতে এনে দিয়েছে গীতিপ্ৰাণতা।


গল্পটিতে বহিরঙ্গগত আয়োজন ছিল, একেবারে গল্পের নায়ক ও নায়িকার বাল্যবয়স থেকে সে কাহিনীর বিস্তারও ঘটেছিল। তারপর তার বাল্য, কৈশোরে পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা, একসঙ্গে এক পাঠশালায় পড়া, বউ বউ খেলা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পরিচয় হল আরো নিবিড়। এর মধ্যেই লেখাপড়া শিখে আদালতের নাজির বা হেডক্লার্ক হওয়ার উচ্চাশা নায়ককে নিয়ে এল কলকাতায়। কলকাতায় এসে তার জীবনের ধারা বদল ঘটল। ‘গ্যারিবার্ল্ডি’ বা ‘ম্যাৎসিনি’ হওয়াকেই সে জীবনের বৃহত্তর লক্ষ্য বলে মনে করল। পড়াশোনার সঙ্গে দেশের কাজে করল প্রাণমন সমর্পণ।


এর মধ্যে সুরবালার জীবনবৃত্ত থেকে গল্পের নায়ক অনেকখানি দূরে সরে এসেছে। নায়কের বাবা ও সুরবালার বাবা এদের দুজনের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি করে ফেললেও নায়কের অনিচ্ছায় এ সম্বন্ধ ভেঙে গেল। সুরবালার বিয়ে শেষ পর্যন্ত হল অন্যত্র। এন্ট্রান্স ও এফ. এ. পাশ করবার পর হঠাৎ পিতৃবিয়োগের মধ্য দিয়ে নায়কের জীবনে আবার পালাবদল ঘটল। বিধবা মা ও দুটো বোনের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে তাকে জুটিয়ে নিতে হল নোয়াখালি অঞ্চলে একটা স্কুলের সেকেণ্ড মাস্টারি।


স্কুলের সেকেণ্ড মাস্টারের নিঃসঙ্গ জীবনেই আবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটল সুরবালার। সে তখন সরকারী উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী। স্কুলের অদূরে পুকুরের ওপারে তাদের বাড়ি। এককথায় প্রতিবেশিনী। দেখা না হলেও রামলোচনের বাসায় রামলোচনের সঙ্গে গল্প করার সময় কানে আসে অন্তরালবর্তিনীর কাপড়ের একটুখানি খস্থস, পায়ের একটু শব্দ, জানলার ফাঁকে কৌতূহল ভরা দৃষ্টির অনুভূতি। ‘ঘরেতে এল না সে যে মনে তার নিত্য যাওয়া আসা।'


অপ্রাপনীয়ের যন্ত্রণার সেই হল আরম্ভ, গ্রামের একান্তে মাস্টারি জীবনের নিঃসঙ্গতা, উদাস প্রকৃতি, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ, ঈষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিম্ন-মঞ্জুরির সুগন্ধ, সুপারি নারিকেলের অর্থহীন মর্মরধ্বনি—সবকিছু মিলে মিশে মনের এই একাকীত্বের যন্ত্রণাকে আরো বাড়িয়ে তুলল। একদিন সামান্যমাত্র ইচ্ছে করলেই সুরবালা তার “কি না হইতে পারিত। কিন্তু আজ চোখের দেখাও পাপ।


তারপর এল সেই 'একরাত্রি। স্কুলের চালাঘরে নায়ক একা। রামলোচনের বাড়িতে সুরবালাও একা। মাঝখানে এক বড় পুষ্করিণীর ব্যবধান। রাত্রে ঘনিয়ে এল প্রচণ্ড দুর্যোগ, ঝড় ভেঙে পড়ল সাইক্লোন হয়ে। মাঝরাতে সমুদ্রের দিক থেকে ছুটে এল নদী-নালা-গ্রাম-গঞ্জ ছাপানো প্রলয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস।


মহা-দুর্যোগের ঘন অমারাত্রে প্রাণ বাঁচাতে স্কুলের লাগোয়া ঘর ছেড়ে দশ বারো হাত উঁচু পাড়ের ওপর আশ্রয় নিল মাস্টার। আর ঠিক তখনি অপর পাড় হতে উঠে এল আর একটা মানুষ। মাস্টার নায়ক সমগ্র সত্তা দিয়ে বুঝতে পারল, সে আর কেউ নয়, স্বয়ং সুরবালা। জলমগ্ন পৃথিবীর বুকে পাঁচ ছয় হাত সেই ছোট্ট দ্বীপে মুখোমুখি দণ্ডায়মান দুটি প্রাণী। দুজনেই নিঃস্তব্ধ। দু’জনের দৃষ্টি প্রসারিত অন্ধকারের দিকে। চলার পথে বাল্যের কোন একদিন দু’জনের একত্র দেখা হয়েছিল। তারপর গ্রন্থির বন্ধন আলগা হয়ে গিয়েছিল। দু'জনের পথ হয়েছিল আলাদা। আজ আবার দুর্যোগের ভয়ঙ্কর রাতে দুজনেই আবার যেন একটা বিন্দুতে এসে পরস্পরের মুখোমুখি। আর একটা ঢেউ এলেই মধ্যবর্তীকালের এ বিচ্ছেদের বৃত্ত থেকে খসে দু’জনে আবার এক হয়ে যেতে পারে।


কিন্তু না। সে মিলন কামনা নায়কের কাম্য নয়। কামনা-বাসনা ছোট্ট ঘেরা দ্বীপে দাঁড়িয়েও সঙ্গলিপ্সা আসঙ্গলিপ্সায় আবর্তিত হতে গিয়েই, সেই পরম ক্ষণে নায়কের মনে নিঃশব্দ প্রার্থনার মতো উচ্চারিত হ’ল- “স্বামী সংসার নিয়ে সুরবালা সুখে থাকুক।" প্রলয়ের দুর্লগ্ন পার হয়ে গেল-বানের জল নামল, সুরবালা ঘরে গেল, নায়ক ফিরে এল আবার সেই নিঃসঙ্গ চালাঘরে।


সুরবালাকে না পাওয়ার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আর তার মনে নেই। নেই শূন্যতার অনুভূতিটুকুও। এ-যেন বৈয়ব কবিতার ভাবসম্মিলন। এক অপরূপ প্রাপ্তির তৃপ্তিতে তার মন আচ্ছন্ন। ক্ষণকালের, ক্ষণিকের বিন্দুতে অনন্তের প্রতিভাস। লৌকিক 'দেনা-পাওনা'র লৌকিক প্রয়োজনের কোনো চরিতার্থতা নয়, একটি শান্ত ত্যাগে জীবনের পরম লগ্নকে লাভ করবার এক রোমান্টিক তৃপ্তির অপরূপ সুরঝঙ্কারই এতে বেজে উঠেছে।


ভাবনার এই উত্তরণের মধ্যে ঘটেছে নায়কমনের আনন্দময় মুক্তি। ঘটনা নয় ভাবনার এই আনন্দময় পরিণতিতেই হয়েছে গল্পের পরিসমাপ্তি। আর এইদিক দিয়েই গল্পটি কাব্যধর্মী। আখ্যান বা প্লট দিয়ে গল্প শুরু হলেও, প্লটের বৃত্তে গল্পটি যেন এক অখণ্ড সুরের বহমানতাই গল্পের উৎস, গতি ও প্রাণ।


রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছে’র এই জাতীয় গল্পগুলিকে বলা যেতে পারে 'আবহপ্রধান’ গল্প। এই প্রসঙ্গে শ্রীবুদ্ধদেব বসু বলেছেন, এই ধরনের গল্পে আমরা এমন একটা স্তর পাই, যেখানে গল্প তার বস্তুঘনতা বিসর্জন দিতে দিতে প্রায় একটা কবিতা হয়ে ওঠে। যথা পরিমিত গল্পের দেহে এই আবহ-প্রাধান্যের দোলা কবি-আত্মার অবচেতন বাসনার একমাত্র সৃষ্টি। সত্তর বছরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে আত্মপরিচয় বিবৃত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “জীবনের দীর্ঘ চক্রপথ ভ্রমণ করতে করতে নিজেকে নানা খানা করে দেখেছি, নানাকর্মে প্রবর্তিত করেছি, তাতে নিজের কাছে নিজের অভিজ্ঞান আচ্ছন্ন হয়েছে।.... আজ বিদায় বেলায় সেই চক্রটিকে যখন সম্পূর্ণ করে দেখতে পেলুম, তখন একটি কথা বুঝেছি, একটি পরিচয় আমার কাছে, সে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র।” অর্থাৎ সৃষ্টির সকল প্রকরণের মধ্য দিয়েই কবি যাকে মুক্তি দিয়েছেন, সে–সে তাঁর কবি-আত্মা। এই অর্থে রবীন্দ্রনাথের সকল রচনাই কবি-কর্ম। আর, যেখানে শিল্পীর কবি-আত্মা রচনায় উপকরণ বা উপলক্ষ্যের সীমায় পূর্ণাঙ্গ মুক্তি পেয়েছে, সেখানে আপনা থেকেই তা হয়ে উঠেছে কবিতা, সুর, গান। 'একরাত্রি' গল্পের প্রসঙ্গে এ কথাই বলা চলে।


‘একরাত্রি' গল্পে বর্ষণ-আকুল ঝড়ের রাতের নিসর্গ-সংহতি পরিণামী আবহ রচনায় সহায়তা করেছে। যেখানে এক ভাঙ্গা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের জীবনে তার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি মাত্র রাত্রিই তার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা সম্পাদন করেছে। আমরা গল্পের সেই বিশেষ মুহূর্তটিকে অপূর্বভাবে পাই কালরাত্রির সেই ভয়াল জল গর্জনের মধ্যে যখন মাত্র পাঁচ ছয় হাত দ্বীপের উপর কেবল দুটি প্রাণী, যে-কোনো মুহূর্তেই একটা প্রকাণ্ড ঢেউ এসে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর সেই পটভূমিতে—সেই লগ্নে দুজন প্রাণীর নিঃশব্দ প্রতীক্ষা। গল্পটিতে এ ছাড়া আর কোনো মহামুহূর্ত নেই।


গল্পের দীর্ঘ প্রথম অংশ প্রধানত বর্ণনা-নির্ভর। কেবল শেষের ছোট-বড় এগারটি অনুচ্ছেদের পরিবেশ বর্ণনা ধাপে ধাপে ঘনীভূত হয়ে আখ্যানের উপরে সুরের আবরণ রচনা করেছে। ধীরে ধীরে গল্পাংশের প্রাধান্য ক্রমস্ফীত সেই আবহ অতলে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে। 'একরাত্রি'তে প্রথম ভাগের ব্যাপক বর্ণনা পরিণামে হয়ে উঠেছে ভাব-বিকল্পিত সুর-লীন। চৈত্রের নির্মমঞ্জুরীর গন্ধ মাখা উদাস প্রকৃতি, ঝড়ের রাতের প্রলয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস, ঝড়-জল-বন্যার অন্তে শান্ত প্রকৃতি যেন নায়ক মনের ভাবনার ওঠা-পড়ারই এক আবহ সঙ্গীত। শাক্ত-প্রকৃতির পুনরাবর্তন যেন নায়কমনে স্বর্গচ্যুতির অশান্ত মানসিকতার অন্তে শান্তির স্বর্গে পুনঃস্বর্গ লাভ। ‘Paradise Lost'-এর পর অভিনব Paradise Regained'। বিচ্ছেদের অন্তে অনন্ত প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি। “রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনব্যাপী প্রেমসাধনা এই অবন্ধনার রূপ শৃঙ্গারেই কৃত-কৃতার্থ। দেহ-প্রেমের খণ্ড ক্ষুদ্রতাকে তিনি চিরকালই ‘অন্তর্ধান পটে'র উপর ধ্যানের ‘চিরন্তনতা’ তে বিন্যস্ত করতে চেয়েছেন—এই তাঁর ‘শেষের কবিতা’। তাই ‘একরাত্রি'র নায়ক যখন বলে, 'এই ক্ষণটুকু হোক সেই চিরকাল'—তখন লেখকের প্রেম-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে তার সর্বোত্তম প্রাপ্তিকেই পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক যুগের তুঙ্গ-শিখরে এই গল্পের অবস্থান। কবি-মনের এই ভাবনা একদিকে এই গল্পটির বিষয়, অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কবি-জীবনেরও ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয়। গল্পকার রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথ এখানে একই বৃত্তে বিধৃত।”