কোন একজন সমালোচক রবীন্দ্রনাথের 'নিশীথে' গল্পটির মধ্যে মার্কিন কবি ও গল্পকার এডগার অ্যালান পো-র কোন কোন গল্পের 'ঘনিষ্ঠ ও অক্ষম' অনুকরণ লক্ষ্য করেছেন। সমালোচকের এরূপ পর্যবেক্ষণ কতদূর যুক্তিসঙ্গত আলোচনা করো।

শ্রী প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের রহস্য গল্প প্রবন্ধে 'নিশীথে' গল্পটির সঙ্গে এডগার অ্যালান পো-র ‘লিজিয়া’ ও ‘মোরেল্লা' গল্পটির আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। তিনি পো-র গল্প এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্প বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, উভয়ের মধ্যে শুধু চরিত্রগত বা ঘটনাগত মিলই নেই, ভাষাগত মিলও রয়েছে। 'নিশীথে’ গল্পের বহু বর্ণনায় বা সংলাপে পো-র গল্পের বর্ণনা বা সংলাপের হুবহু মিল দেখা যায়।


Leigia ও নিশীথে দুটি গল্পই নেশাখোরের কাহিনী- Leigia গল্পের বিত্তশালী নায়কের আফিং-এর নেশা, নিশীথে গল্পের জমিদার দক্ষিণাচরণের মদের নেশা। দুই নায়কেরই রোগ এক—দোজবরে syndrome, প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে নানা অশান্তিতে ভোগেন এবং নেশার মাত্রা বাড়িয়ে চলেন। দুটি গল্পের মধ্যেই একটা রহস্যময় অতীন্দ্রিয় ও ভৌতিক আবহ রয়েছে।


'নিশীথে' গল্পের নায়ক দক্ষিণাচরণ গল্পের মূল কথক, যদিও গল্প শুরু করা হয়েছে একজন ডাক্তারের জবানীতে যার কাছে নায়ক মূল কাহিনীটি বলছেন। দক্ষিণাচরণের প্রথমা স্ত্রী গৃহিণী হিসাবে ‘অতি দুর্লভ', গম্ভীর শান্ত প্রকৃতির, স্বল্পভাষিণী। একটি মৃত সন্তান প্রসবের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন; দক্ষিণাচরণ অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে লাগলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর দু’জনেই বুঝলেন রোগ সারবার নয়। বায়ু পরিবর্তনের জন্য দক্ষিণাচরণ স্ত্রীকে এলাহাবাদে নিয়ে গেলেন। সেখানে হারাণ ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে দক্ষিণাচরণের ঘনিষ্ঠতা দেখে দক্ষিণাচরণের স্ত্রী একদিন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন যাতে দক্ষিণাচরণ ডাক্তারের মেয়ে মনোরমাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারেন। দক্ষিণাচরণ মনোরমাকে বিয়ে করে তাঁর বরানগরের বাগানবাড়িতে নিয়ে এলেন, কিন্তু তাঁরা সুখী হতে পারলেন না। মনোরমার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লেগেছিল। সে হাসত না, গম্ভীর হয়ে থাকত, দক্ষিণাচরণের প্রেমালাপের চেষ্টায় সাড়া দিত না। দক্ষিণাচরণ বরাবরই মদ্যপায়ী ছিলেন, তাঁর মদের নেশা আরও বেড়ে গেল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় মনোরমাকে আদর করার চেষ্টা করতেই হঠাৎ কেন যেন হেসে উঠল। তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। পরে মনোরমা তাঁকে বোঝাল ওটা একঝাক হাঁসের পাখা নেড়ে উড়ে যাওয়ার শব্দ। আর একদিন পদ্মানদীর নির্জন তীরে মনোরমাকে চুম্বন করার সময়ে কে যেন বলে উঠলঃ ‘ও কে, ও কে, ও কে!' রাত্রে মশারির পাশ থেকে ঘুমন্ত মনোরমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল—ও কে, ও কে, ও কে গো!” দক্ষিণাচরণ বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালতেই মশারি কাঁপিয়ে বোট দুলিয়ে সেই ছায়ামূর্তির বিকট হা হা হাসি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।


পো-র Leigia গল্পের নায়কই কথক। লিজিয়া নায়কের প্রথমা স্ত্রী রূপে, গুণে, বংশগৌরবে, পাণ্ডিত্যে অতুলনীয়া, কিন্তু শান্ত : 'Outwardly calm, over placid'। নায়কের প্রতি লিজিয়ার গভীর ভালোবাসা, কিন্তু নায়ক মনে করে যে এই ভালোবাসা ‘unworthily bestowed। দক্ষিণাচরণ বলছেন : “তাঁহার সমস্ত প্রেম....আমার এই অযোগ্য প্রাণটাকে যেন বক্ষের শিশুর মতো দুই হস্তে ঝাঁপিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছিলেন।' পো-র নায়কও বলছেন ‘Without Leigia I was but as child groping benighted' । লিজিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং কিছুদিন পরে মারা গেল।


লিজিয়ার মৃত্যুর পরে নায়ক সোনালী চুল, নীল নয়না Lady Rowena-কে বিয়ে করলেন। কিন্তু এ বিয়ে সুখের হল না। Rowena নায়কের মধ্যে একটা তীব্র বিষণ্ণতা লক্ষ্য করে তাকে ভালোবাসতে পারল না, এড়িয়ে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে নায়ক আফিমের নেশা ধরেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই Rowena-র অসুস্থতা দেখা দিল ; চারপাশে যেন কি সব অস্পষ্ট শব্দ, কে যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। নায়ক কিন্তু এসব শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। Rowena-র রাগ বাড়তেই লাগল। একদিন সে বলল-পর্দায় যেন কিসের ফিস্ ফিস্ শব্দ, যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। নায়ক তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন এসব বাতাসের শব্দ। কিন্তু Rowena হঠাৎ মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়ল। নায়ক তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শমতো একটু মদ গেলাসে ঢেলে Rowena-র মুখের কাছে ধরলেন, যে নিজেই কিছুটা সামলে নিয়ে গ্লাসটা ধরল। কিন্তু যেই গ্লাসটা তুলে ঠোঁটে লাগাতে যাবে, কোথা থেকে যেন উজ্জ্বল লাল রঙের তিন চারটে বড় বড় ফোঁটা গ্লাসের মধ্যে পড়ল। এই বিষাক্ত মদ খাওয়ার পরেই Rowena-র অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে গেল এবং কয়েকদিন পরে সে মারা গেল। নায়ক সারারাত Rowena-র মৃতদেহের পাশে বসে রইলেন এবং সমস্ত রাত ধরে দেখলেন Rowena-র শবদেহের মধ্যে লিজিয়ার বেঁচে ওঠার ব্যাকুল চেষ্টা—একবার করে মৃতদেহের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন ও উত্তাপ ফিরে আসছে, পর মুহূর্তেই শরীর ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। রাত যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন Rowena-র মৃতদেহ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে লিজিয়ার ঘন কালো চুলের রাশ আর কালো চোখের বন্যতা নিয়ে।


স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। পো-র লিজিয়ার মত নিশীথে গল্প পুরোপুরি ভৌতিক গল্পরূপে গড়ে না তুলে দক্ষিণাচরণের মনোবিকারের ইঙ্গিতটুকু রেখে দিয়েছে।


কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পো-র লিজিয়ার গল্পটিকেই শুধু নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে মোরেল্লা (Morella) গল্পটিকেও বিশ্বস্তভাবে অনুকরণ করেছেন। স্ত্রীর শুশ্রুষা করার ব্যাপারে দক্ষিণাচরণের ক্লান্তির প্রসঙ্গটি Leigia গল্পে নেই, আছে Morella গল্পে। দক্ষিণাচরণ বলছেন, “এই আরোগ্য আশাহীন সেবাকার্যে আমি মনে মনে পরিশ্রান্ত হইয়া গিয়াছিলাম।....চিরজীবন এই চিররুখকে লইয়া দিন যাপন করিতে হইবে এ কল্পনাও আমার কাছে পীড়াজনক হইয়াছিল।” দীর্ঘদিন অসুস্থ Morella-কে সেবা করার পর পো-র নায়ক বলছেন, “I longed with an earnest and cousuming desire for the moment of Morella's desease.....But the fragile spirit clung to its tinement of clay for many days....until my tortured nerves obtained mastery over my mind, and I grew furious through delay, and the heart of a fiend cursed the days and the house, and the bitter moments which seemed to lengthen and lengthen as her gentle life declined'।


‘নিশীথে'র মত পরাশ্রয়ী বা derivative গল্প রবীন্দ্রনাথ খুব কমই লিখেছেন। গল্পটি Leigia-র এত ঘনিষ্ঠ এবং অক্ষম অনুকরণ যে পো-র গল্পের সঙ্গে তুলনায় মর্যাদা পাবারও অযোগ্য। Pastiche-এর অসহায় দুর্বলতা গল্পটির সর্বাঙ্গে জড়ান। স্ত্রী কথাবার্তা আচার-আচরণের মধ্যে মৃত্যুর পরেও নায়কের কাছে ফিরে আসার (যেমন পো করেছেন লিজিয়ার মধ্যে) পক্ষে যথেষ্ট motivation বা আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি না করতে পারার ফলে দ্বিতীয় অংশের কাহিনীর মধ্যে 'মহামায়া' গল্পের মতই একটা আলগা নিরুদ্দেশ গতিহীনতা এবং ভাবালু প্রকৃতিবর্ণনা-বাহুল্য এসেছে। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই বুঝতে পারছেন যে Leigia গল্পের তীক্ষ্ণ একাগ্রতা এবং তীব্রতা তাঁর গল্পে কিছুতেই আসছে না। তবে গল্পের স্বরভঙ্গির মধ্যে একটা নিছক ধ্বনিগত প্রগাঢ়তা বা heightening আনার জন্যে অনর্গল বিশেষণ বাড়িয়ে চলেছেন।


রবীন্দ্রনাথ এডগার অ্যালান পো-র 'Leigia' গল্পটি তাঁর 'নিশীথে' গল্পটিতে অনুকরণ করতে গিয়ে ভুল করেছেন, কারণ পো-র ব্যক্তিজীবনের মদ ও অন্যান্য ড্রাগের নেশা, স্নায়বিক অসুস্থতা, অবক্ষয়ী শবচেতনা, স্ত্রী ভার্জিনিয়ার চিররুণ্নতা, তাঁর macabre amorality-এ সব কিছুই Leigia গল্পের সঙ্গে এমন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে যে, এ মানসিকতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না পারলে কোন লেখকের পক্ষে Leigia গল্পের অনুকরণ করা সম্ভব নয়। পো শুধু কবি বা গল্প লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃত কাপালিক। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পুত্রের পক্ষে পো-র psychedelic জগতে স্বচ্ছন্দে নিঃশ্বাস ফেলা সম্ভব ছিল না কোনমতেই।