“নাটকীয়তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ঘটনার প্রত্যক্ষতা ও সংঘর্ষে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' বিশেষভাবে সমৃদ্ধ”- আলোচনা করো।

কেন্দ্রীয় ঘটনাদ্বন্দ্ব নাট্যকাহিনীর প্রাণস্বরূপ এই প্রধান দ্বন্দ্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছে ভক্তপ্রসাদ-বাচস্পতির সংঘর্ষ। ভক্তপ্রসাদ বাচস্পতিকে ব্রহ্মত্র থেকে বঞ্চিত করেছে, হানিফের সঙ্গে পরামর্শ করে সুযোগ বুঝে বাচস্পতি তার শোধ তুলেছে। ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের ব্যাপকতর পরিচয় বাচস্পতির সংস্পর্শে আসায় পাঠক লাভ করেছে। বাচস্পতির কাহিনী হানিফ প্রসঙ্গ থেকে যথেষ্ট স্বতন্ত্র। যদিও দুটি সূত্রেরই মূল ভক্তপ্রসাদের চরিত্রে- তার জমিদারী শোষণ ও কামুক লালসাবৃত্তিতে। বাচস্পতির স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ দ্রুত হানিফের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছে। ভক্তপ্রসাদ-বাচস্পতির দ্বন্দ্বে কোনো পৃথক আবর্ত সৃষ্ট হয়নি, ভক্তপ্রসাদ হানিফ-ফতেমার মূল কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাচস্পতির অস্তিত্ব মূল কাহিনীর পটভূমিকেই কিছু বিস্তৃতি দিয়েছে; এবং জটিল করে তুলেছে।


এ কাহিনীর মধ্য দিয়ে নব শিক্ষাদীক্ষার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল শ্রেণীর বকধার্মিকতার স্বরূপ উদ্ঘাটনের ইচ্ছা মধুসূদনের থাকলেও নব্য ও প্রাচীনের দ্বন্দ্ব গ্রহসনে যথেষ্ট বড় হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ এর সমাজচেতনায় সেই ভাবদ্বন্দ্বের প্রতিই নাট্যকারের ব্যঙ্গ-বাণ উদ্যত। একে বর্তমান প্রহসনের ত্রুটি বলা যাবে না। সামাজিক ভাব-দ্বন্দ্বটিকে নাট্যকার ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। ফলে প্রহসনটি শুধু একটি ব্যক্তির চরিত্রদৌর্বল্যের পরিবর্তে হয়ে দাঁড়াল একটি শ্রেণীর ভণ্ডামির প্রতিনিধি। ভক্তপ্রসাদের ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একটি বিশেষ যুগের শ্রেণী স্বভাবের ব্যঞ্জনাও যুক্ত হল, মধুসূদন এই ভাবদ্বন্দ্বটিকে প্রহসনের একটি দৃশ্যে আনন্দবাবুর সঙ্গে কথোপকথনে প্রকাশ করেছেন


“ভক্ত। অম্বিকাকে দেখচি আর বিস্তর দিন কলকেতায় রাখা হবে না। 

আনন্দ। আজ্ঞে এখন অম্বিকাকে কালেজ থেকে ছাড়ান কোনমতেই উচিত হয় না। 

ভক্ত। বল কি, বাবু? এর পরে কি ইংরাজী শিখে আপনার কুলে কলঙ্ক দেবে? আর ‘মরা গরুতেও কি ঘাস খায়' এই বলে কি পিতৃপিতামহের শ্রাদ্ধটাও লোপ করবে?”


এই অংশে প্রহসনটি প্রত্যক্ষ ঘটনার স্থানে বিবৃতির প্রাধান্য লক্ষ্যগোচর। কিন্তু এ বিবৃতির ফলে নাট্যরসের হানি হয়নি। দুটি বিপরীত ভাবের সংঘর্ষ কথোপকথনে প্রকাশিত হয়েছে। বিবৃতি কোথাও নিস্তরঙ্গ না হয়ে বিপরীতমুখী ব্যক্তিত্বের স্পর্শে সংক্ষুব্ধ ও তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছে। কেননা ভক্তপ্রসাদের এ আলাপ শুধুমাত্র আলোচনা নয়, এর সঙ্গে তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব জড়িত।


প্রহসনের প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে ভগী-পঞ্চীকে অবলম্বন করে যে অংশ স্থান পেয়েছে ফতেমা-হানিফের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। ফতেমার প্রতি লোলুপতা যে তার স্বভাবের কোনো আকস্মিক ও বিশিষ্ট ঘটনা নয়, এ বিষয়ে সে যে চরম পাপিষ্ঠ, কিশোরী পঞ্চীর প্রতি তার লোভ সে-কথার প্রমাণ দেয়। মূল কাহিনীর সঙ্গে একটা সমান্তরাল ভাব সৃষ্টি করার ফলে এই অংশ একদিকে যেমন নাট্যকৌতূহল বাড়িয়েছে, তেমনি ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের সব মহল একেবারে স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছে।


দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে ভক্তবাবুর অনুপস্থিতির সুযোগে গদা ও রাম চাকরের বাবু বাবু খেলা উপভোগ্য রঙ্গরস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্রহসনের মূল গল্পের সঙ্গে যোগাযোগ দুর্লভ।


প্রহসনটি দুটি অঙ্কে বিভক্ত। এই অঙ্ক-বিভাগ অনিবার্য ছিল না। চারটি দৃশ্য চারটি ভিন্ন স্থানে ঘটেছে। স্থানগত ঐক্যের দিকে লক্ষ্য রাখলে মনে হয় অঙ্ক-বিভাগ অপ্রয়োজনীয়। ঘটনার দিক থেকেও এ প্রহসনে অঙ্ক-বিভাগের সুযোগ নেই। প্রথম তিনটি দৃশ্যেই কেন্দ্রীয় ঘটনার প্রস্তুতি চলেছে, চতুর্থ দৃশ্যে তার অনুষ্ঠান। কাজেই প্রথম তিনটি দৃশ্যকে এক অঙ্কে এবং চতুর্থ দৃশ্যটিকে অন্য অঙ্কে স্থাপন করা যেতে পারত। নাট্যকার যেভাবে অঙ্ক-বিভাগ করেছেন তার পিছনে কোনো মনোভাব আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত মধুসূদন অভিনয়কালীন বিরতির কথা ভেবে অঙ্ক-বিভাগের পরিকল্পনা করেছেন, নাটকের অভ্যন্তরের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।


এ গ্রহসনেও কালগত ঐক্য বজায় রাখা হয়েছে। প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য— [“পুঁটি ....... তা তুই রাত চার ঘড়ীর সময় ঐ গাছতলায় দাঁড়াস। .......ফতে। (স্বগত) দেখি, আজ রাত্তির বেলা কি তামাশা হয়।” ] দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্য [ “ভক্ত। (স্বগত) আঃ! বেলাটা আজ কি আর ফুরবে না? ....ইঃ। এখনও না হবে তো প্রায় তুই-তিন দণ্ড বেলা আছে। কি উৎপাত!”] এবং দ্বিতীয় দৃশ্য [ “ফতে। না ভাই, যে আঁদার, বড় ডর লাগে।” ] একই দিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘটেছে। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটির সঙ্গে অপর তিনটি দৃশ্যের কালগত ঐক্য স্থাপন করেননি মধুসূদন, এখানে একটু দ্বিধার ভাব আছে। [“ভক্ত...... অ্যা? আজ রাত্রে ঠিকঠাক কত্যে পারবি তো? গদা, আজ্ঞে, আজ না হয় কাল পরশুর মধ্যে করে দেব।” ] অথচ চারটি দৃশ্যই একদিনের ঘটনা এবং সংহত আবেদন সৃষ্টিতে কালগত এই ঐক্য অবশ্য সহায়তা করেছে।


নাট্যকার ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'র যে দৃশ্যে ঘটনার শীর্ষবিন্দুটি স্থাপন করেছেন, যেখানে ভূত সেজে এসে হানিফ কর্তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে গেল সেখানে উত্তেজনা চরমে . পৌঁছেছে। প্রথম দৃশ্যের গদা যখন ভক্তপ্রসাদকে ফতেমার রূপের কথা বলল, তখন থেকে এই মুহূর্তের দিকে লক্ষ্য করেই যেন ঘটনাস্রোত প্রবাহিত। পুঁটির দৌত্য, ভক্তবাবুর সাজসজ্জা ও আকুল প্রতীক্ষা সব-কিছুই শীর্ষের দিকে প্রহসনটিকে নিয়ে গিয়েছে। তার পরবর্তী অংশ অবরোহন এবং ঘটনার শেষ উত্তেজনার তীব্রতা এই অংশে ক্রমশ হ্রাস পেয়ে যবনিকাপাত ঘটেছে।


নাটকের এই শীর্ষবিন্দু-এর পূর্বাভাস দৃশ্যের প্রথমে থাকায় এর নাট্যকৌতূহল অনেকটা ৰিনষ্ট হয়েছে এরূপ অভিমত কেউ কেউ প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কের গোড়ায় হানিফ-বাচস্পতির আলাপ থেকে জানা যায়, তারা কাছেই লুকিয়ে আছে। “কিন্তু হানিফ রাগে আত্মহারা, পূর্ব পরামর্শ ও পরিকল্পনা ভুলে গিয়ে ভক্তপ্রসাদকে আক্রমণ করতে চাইছে, বাচস্পতি তাকে বুঝিয়ে কৌশলানুযায়ী কাজ করতে রাজী করাচ্ছে। কিন্তু ঠিক কি পরিকল্পনা এরা করেছে, পাঠক-দর্শক তা জানতে পারে না। ভক্তপ্রসাদের কামুক রসিকতা উপভোগ করতে করতেও পিছনে এদের লুকিয়ে থাকা সর্বদাই একটা অজ্ঞাত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের উৎকণ্ঠ করে রাখে। ভক্তপ্রসাদের লোলুপতা ও বাক্‌বিন্যাসের পিছনে অনুপস্থিত হানিফ বাচস্পতির অদৃশ্য ছায়াপাত একটা বিশিষ্ট নাট্যাবেদন সৃষ্টি করে। শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গা শিবমন্দির থেকে যেন রুদ্রের ক্রোধোন্মক্ত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, আর ছদ্মবেশী হানিফের খাঁটি ভূতের মত আবির্ভাব ঘটে। এ একান্ত স্বাভাবিক। অথচ ঠিক এমনটি ঘটবে কে জানত! একে বলা চলে অনিবার্যভাবে আকস্মিক।


গল্পের পূর্ণতায় ও দ্বন্দ্বমূলক প্রকৃতিতে, সংলাপের প্রাণচাঞ্চল্যে, চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' নাট্যরসে সমৃদ্ধ। তার মধ্যে আবার দুই একটি বিশিষ্ট নাট্যমুহূর্ত গঠনে নাটকীয় কলাকৌশল মধুসূদনের কতটা আয়ত্ত হয়েছিল তার প্রমাণ মিলবে।”


প্রথম অঙ্কের, প্রথম দৃশ্য, হানিফ গদার সাহায্যে পুরো খাজনার হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা করল। গদা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারও করল। একটু আত্মপ্রসাদের ভাব নিয়ে হানিফ বাড়ি ফিরল [“(স্বগত) বাঁচলাম। বারো গণ্ডা পয়সা তো গাঁটি আছে, আর আট সিকি কাছায় বান্ধ্যে আনেছি, যদি বড় পেড়াপেড়ি কত্তো তা হলে সব দিয়ে ফ্যালতাম।”]। কিন্তু গদা কি উপায়ে তাকে সাহায্য করল এবং ভক্তবাবু কেন তাকে রেহাই দিল তা জানলে সে এতটা উল্লসিত হতে পারত না। ফলে হানিফের আনন্দে তারা এক জাতীয় কৌতুক অনুভব না করে পারে না। প্রথমত ঘটনাটি প্রকাশ পেলে হানিফের এই আনন্দের কিরূপ রূপান্তর ঘটবে তা আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না। পাঠক-দর্শকের মনের এই ভাব নাট্যগুণসমৃদ্ধ।


দ্বিতীয় অঙ্কের, দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে। ভক্তপ্রসাদ ভাঙ্গা শিবমন্দির তার অনাচারের স্থানরূপে বেছে নেয়। “(চিন্তিতভাবে) অ্যা—মন্দিরের মধ্যে? – হ্যাঁ; ভগ্নশিবে তো শিবত্ব নাই, তার ব্যবস্থাও নিয়েছি। বিশেষ এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্য হিন্দুয়ানি ত্যাগ করাই বা কোন ছার?” ঠিক তখনই নেপথ্যে বাচস্পতির গম্ভীর স্বর শোনা যায় –“বটে রে পাষণ্ড নরাধম দুরাচার?” ‘এর নাটকীয় প্রতিক্রিয়া ভক্তপ্রসাদের ত্রাসে, পুঁটি ও গদার কম্পনে ধরে রেখেছেন নাট্যকার।


ঐ একই দৃশ্যে হানিফের প্রহারে ভক্তপ্রসাদ যখন প্রায় অচেতন ঠিক তখনই “মায়ের এই তো বিচার বটে, বটে বটে গো আনন্দময়ী – এই তো বিচার বটে” রামপ্রসাদী গাইতে গাইতে বাচস্পতির আগমন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। গানটির নির্বাচন যথেষ্ট সময়ানুগ।


ঐ-একই-দৃশ্যে বাচস্পতির সঙ্গে যখন ভক্তবাবুর একটা নিষ্পত্তি হয়ে গেল। সে যখন ভক্তবাবুকে নিশ্চিত্ত করল [“তার জন্যে নিশ্চিত্ত থাকুন”]। ঠিক সেই মুহূর্তে ‘কত্তাবাবু সালাম করি” বলে হানিফের প্রবেশ যে কি পরিমাণ নাটকীয় ভক্তবাবুর ব্যাকুল আর্তনাদে তা ধরা পড়েছে।