'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদির জীবন ও সম্পর্ক কতখানি জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তার ঔপন্যাসিক রূপটি লিপিবদ্ধ করো।

যামিনী কবিরাজ ও সেনদিদি' পুতুল নাচের ইতিকথা'র এমন এক দম্পতি যাদের চরিত্র ও আখ্যান উপন্যাসে নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছে এবং পাঠকের কাছে নানা প্রশ্ন নিয়ে এসেছে। চরিত্র ও সম্পর্কের দিক থেকে এই দুইজন বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র।


গোপাল দাসের ব্যবসাগত কলঙ্কের একমাত্র জীবিত স্মৃতি সেনদিদি। জনশ্রুতি আছে যে এককালে গোপাল দাস জীবন্ত মানুষের কেনাবেচার ব্যাপারেও দালালি করত। তিনটে বৃদ্ধের সে বৌ জুটিয়ে দেয়। যামিনী কবিরাজ এই ইতিহাসে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি যে কলঙ্কিত ঘটনার দৃষ্টান্ত। যামিনী কবিরাজের সেনদিদি অপুত্রবর্তী ও পরমাসুন্দরী। গ্রামে কলঙ্কিণী নারী হিসেবে সেনদিদির কুখ্যাতি সর্বত্র। তার সঙ্গে গোপালের সম্পর্কের একটা অখ্যাতি আছে। লোকের সন্দেহ গোপালের সঙ্গে সেনদিদির অবৈধ সম্পর্ক আছে। এই বদনাম যদি অসত্য হয়ে থাকে, তবে একথা সত্য যে প্রতিমার মত সুন্দরী কিশোরীকে সে বৃদ্ধ যামিনী কবিরাজের বৌ করে দিয়েছিল। গোপালের সেনদিদির প্রতি একটি প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ হয়তো ছিল, তাই শশী যে যত্নে ও নিষ্ঠায় সেনদিদিকে নানা ব্যাধি থেকে বাঁচিয়ে তুলেছে, সেই যত্ন ও নিষ্ঠাকে গোপাল বার বার সন্দেহ করেছে। তাই পিতাপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।


যামিনী কবিরাজ নামী কবিরাজ। যামিনী যে চ্যবনপ্রাশ তৈরী করে তা সেবন করলে বৃদ্ধের দেহে যুবকের শক্তি সঞ্চার হয়। যামিনী মকরধ্বজ মৃতপ্রায় রোগীর দেহে জীবনদান করে। তৈরী করে রাখলেই এই ওষুধের তেজক্ষমতা লুপ্ত হয়। মহাকপিলাদি বাটিকা সেবনে লোকের অনেক উপকার হয়। যামিনীর মকরধ্বজের তেজে মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার হলেও মহাকপিলাদি বাটিকার অভাবে প্রাণটুকু সব সময় টিকে থাকে এমন নয়।


যামিনী কবিরাজের বৌ সেনদিদি কখনো স্বামীর ওষুধ খায় না। অসুখ হলে বিনা চিকিৎসায় ভাল হয়েছে। এবারে জ্বরে পড়ে সে শশীকে ডেকে পাঠাল। গোপাল কিন্তু তাকে যেতে বারণ করে। গোপালের যুক্তি এই যে যামিনী কবিরাজ যখন এত বড় কবিরাজ, তখন শশীর এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। যামিনীর স্ত্রী যুবতী, তাই গোপাল নানারকম কুৎসাও শুনতে পান। এই মন্তব্য শশী চকিতে বলে এসব তার বানানো কথা। গোপাল তাকে বলে যে উঠতি পসারের সময় এই সব দুর্নাম তার ক্ষতি করবে। “এই তোমার উঠতি পসারের সময় এখনই একটা বদনাম রটে গেলে—এও কি তোমায় বলে দিতে হবে।” শশী ও গোপালের মধ্যে বিতর্ক শেষ পর্যন্ত মতান্তরে পৌঁছয়। মতান্তর শেষ পর্যন্ত মনান্তরে দাঁড়ায়। সেনদিদির প্রসঙ্গ তাদের জীবনকে ও সংসারকে জটিল করে তোলে।


শশীর প্রতি যামিনী কবিরাজের বৌয়ের বাৎসল্যের শেষ নেই। অসহায় সেনদিদি চোখ মেলতে পারে না। চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। যামিনী তার অসুখের কথা গোপন করে। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা সে করে না। মলিন দুর্গন্ধযুক্ত চাদর দিয়ে তার দেহ ঢাকা। কেউ তাকে দেখে না, রোগ হলে শশীকে খবর দেবার লোকও নেই। যামিনীর “বিকৃত নিষ্ঠুর অবেহলা” মানিকের জীবনরহস্যসন্ধানী মানষের আর এক ফলশ্রুতি। বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার প্রতি সে মনস্তাত্বিক বিকৃতি আছে, তা এই সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। সেনদিদি অসাধারণ রূপসী, তাই হয়ত তার চারদিকে খাপছাড়া কাণ্ড ঘটেছে। শশীর সেবাপরায়ণতার প্রতি যামিনীর সংশয়, গোপালের সন্দেহ, সবই তার সঙ্গে পবিত্র সম্পর্কের ওপর একটা প্রশ্নের ছায়া বিস্তার করে। সুন্দর মানবীয় সম্পর্ক জটিল ওঠে। অথচ অসাধারণ রূপের মর্যাদা ত’ তার প্রাপ্য ছিল—“যে রূপের জন্য পৃথিবীর লোক উন্মাদ, স্ত্রীর যে সৌন্দর্য মানুষ তপস্যা করিয়া পান না, যামিনী তাই পাইয়াছে। বুড়া বয়সে সে তো স্ত্রীর দাস হইয়া থাকিবে। কি জন্য তাহার এই বিকৃত নিষ্ঠুর অবহেলা? কে জানে, হয়তো সীতা আর হেলেন আর ক্লিওপেট্রার মতো যার অসাধারণ রূপ থাকে তাহাকে ঘিরিয়া অনেক খাপছাড়া কাণ্ডই ঘটিতে থাকে জগতে।


যামিনী কবিরাজ নামী চিকিৎসক। রোগনির্ণয়ে তার তীব্রদৃষ্টি অব্যর্থ। তাই শশী যখন তাকে বলে যে সে রোগ নির্ণয় করতে পারনি, তখন যামিনী কবিরাজের অহংকারে আঘাত লাগে। শশীর মতে সেনদিদির বসন্ত হয়েছে। যামিনী কবিরাজের মতে ওনার হয়েছে ম্যালেরিয়া। শরৎকালে বসন্ত বলে শশীর রোগনির্ণয়কে ব্যঙ্গ করেছে যামিনী। শশী সেনদিদির চিকিৎসার ভার নেয়। যামিনীকে অভিযোগ করে শশী বলে যে এতদিন সে কিছুই করেনি সেনদিদির জন্য। যামিনীর অনুযোগ যে সে কী তার ওষুধ খায়। সাতগাঁয়ের বসন্তরোগীকে যামিনী কবিরাজের ছাত্র ভূপতিচরণ ছাড়পত্র লিখে দিয়েছিল। শশী তাকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ঘটনায় অহংকৃত যামিনী শশী সম্পর্কে বলেছিল "আমার ছাত্র যাকে ছাড়পত্র লিখে দিল তাকে বাঁচাবে শশী, আমাদের শশে।” দুই চিকিৎসাপদ্ধতির দ্বন্দ্ব এখানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে জটিলতা এনেছে তাতে শশী ও যামিনী কবিরাজ দুজনেই প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। যামিনী কবিরাজের চিকিৎসা সেনদিদি গ্রহণ করে না। যামিনীও নিরুৎসুক সেনদিদি সম্পর্কে। শশীর চিকিৎসায় যামিনীর শ্রদ্ধা নাই। আবার চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাও নেই। এছাড়া ভুলভাবে শশীর ওষুধ খাইয়ে দিয়ে সেনদিদিকে অসুস্থ করে তোলেন যামিনী। গুটি পেকার সময় গুটি বসানোর ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যামিনী তার ক্ষতি করেছে। শশী যামিনীকে বলে যে সে বড় অন্যায় করেছে। আর যেন এমন কাজ ভবিষ্যতে না করে। যামিনী বিশ্বাস করে যে শশীর ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ কেবল মদ আর সিরাপ, এসবে সে বিশ্বাস করে না। শশীকে তিনি এবাড়িতে আসতে বারণ করেন। শশী বলে যে যামিনী যেসব কাণ্ড করেছেন, পুলিশ ডাকলে তার দশ বছর জেল হবে। তাদের কলহ শুনে সেনদিদি যামিনীকে চলে যেতে বলে। যামিনী বাঁচার আশায় শশীর কাছে কাতর আবেদন করে। সেনদিদির সহিষ্ণুতা দেখে অবাক হয়ে যায় শশী। সেনদিদি ও যামিনীর দাম্পত্যসম্পর্ক জটিল ও শূন্যগর্ভ। সেনদিদি শশীকে ছেলের স্বীকৃতি দেন। শশীর প্রতি তার বাৎসল্য ভাব। “পেটের ছেলের চেয়ে তোমাকে বেশী ভালবাসি শশী।” এই কথা শশীকে বিচলিত করে। বারো বছর বয়স থেকেই শশী এই ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে। গ্রাম্য নারী সেনদিদি-তার প্রবল আবেগের ভঙ্গী তার মধ্যে বালকত্বের অনুভূতি এনে দেয়। শশীর প্রতি বাৎসল্য এই আখ্যান এক স্বতন্ত্র মাত্রা এনে দেয়। উপন্যাসে থাকে সম্পর্কের জটিলতা। নরনারীর সম্পর্কের এই জটিলতা থেকেই জীবন ও সমাজের রূপ ফুটে ওঠে। যামিনী কবিরাজ-সেনদিদি-গোপাল-শশী এরা প্রত্যেকেই এই জটিল সম্পর্কের আকর। পরস্পরের সঙ্গে আকর্ষণ-বিকর্ষণের মধ্যে দিয়ে এদের জটিল ও দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতাও সুপ্রচুর।


সেনদিদি নিঃসঙ্গ। শশী তার সহায়। শশীর কাছে সেনদিদির নানা আবদার। গ্রামের একটি বৃদ্ধের চোখের ছানি কেটে সম্প্রতি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে। তা দেখে শশীকে সে কাতর অনুরোধ করে। শশী বলে যে তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, ও আর সারবে না। সেনদিদিকে সবাই কানী বলে, তা অসহ্য হয়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে শশী বলে যে কাচের চোখ দিয়ে সেনদিদি আসল চোখের চেহারা নিতে পারে।


সেনদিদির চোখের ক্ষতি হয়েছে, রূপ চলে গেছে। ফলে শশী ও সেনদিদির সম্পর্কের বৃত্তটাও বদলে গেছে। “কিন্তু যামিনী কবিরাজের বৌ-এর রূপের খ্যাতি আর রহিল না। রূপই গেল নষ্ট হইয়া, রূপের খ্যাতি।...একটা চোখও তার নষ্ট হইয়া গিয়াছে। এই ক্ষতিটাই যামিনী কবিরাজের বৌকে কাবু করিয়াছে সবচেয়ে বেশি। শুধু ক্ষতচিহ্নে ভরিয়া রূপ নষ্ট হওয়াটাও তাহার কাছে সহজ ব্যাপার নয়। রূপ তাহার তেত্রিশ বছরের আত্মীয়, তেত্রিশ বছরের অভ্যাস। একগোছা চুল কাটিতে মেয়েরা কাতর হয়, এতো তাহার সর্বাঙ্গীন সৌন্দর্য, আসল সম্পত্তি। তবু এটা তাহার সহ্য হইত। মনকে সে এই বলিয়া বুঝাইতে পারিত যে আর তাহার কি ছেলেবেলার বয়স আছে? ছেলে-ভোলানো রূপ দিয়া এখন সে করিবে কি? কিন্তু চোখ কানা হইয়া যাওয়া। এতো রূপ নষ্ট হওয়া নয়, এ যে কুৎসিত হওয়া, কদর্য হওয়া তাহাকে দেখিলে এবার যে লোকের হাসি পাইবে?” এই মানসিক প্রতিক্রিয়া কেবল যামিনী কবিরাজের বৌ-এর মানসিকতায় পবরিবর্তন আনে নি, শশীর মানসিকতায় ও পরিবর্তন এনেছে। “কিন্তু সেনদিদির দাম যে কমিয়াছে তাতে সন্দেহ নাই। শশী অবশ্য বুঝিতে পারে না, সেনদিদির আকর্ষণ যতখানি কমিয়াছে সহানুভূতি দিয়া তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়াছে। সেনদিদি হাসি আর দেখিবার - মতো নয়। তাহার একটি চোখে এখন গভীর স্নেহ রূপ নেয় না, তাহার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিবার সাধ্য এখন আর কাহারও নাই। সেনদিদির মুখের কথা, তাহার স্নেহ ও পক্ষপাতিত্ব আজ আর অমূল্য নয়। তাহার জন্য শশীর দুঃখ হয় কিন্তু শশীকে সে আর তেমনভাবে টানিতে পারে না।" শশী আজকাল সেনদিদিকে দেখতে আসার সময় পায় না। যে সেনদিদিকে সেবার জন্য সে গোপালের কাছ মৃদু ভর্ৎসনা লাভ করেছে, সেই সেনদিদি আজ শশীকে আকর্ষণ করে না। গোপাল তাকে বলেছে—“সবাই কি তোমায় বলছে তেমার কানে যায় না—আমার কানে আসে। যামিনী খুড়োর বৌ-য়ের অসুখে তোমার এত দরদ কেন?”—এ-সব উক্তির দ্বারা পিতাপুত্রের সম্পর্ক যেমন জটিল ও বিষাক্ত হয়েছে, তবু যে কোন কারণেই হোক শশী সেনদিদির প্রতি কর্তব্যে অবিচল থেকেছে। কিন্তু সেই সেনদিদি যখন আবার বীতশ্রী হয়েছেন, তখন তার প্রতি শশীর আকর্ষণও কমেছে। জীবনদৃশ্যের এই দিক সম্পর্কে লেখক আমাদের সচেতন করে তুলবার জন্য আখ্যানটির রূপচিত্র অঙ্কিত করেছেন। উপন্যাসের শেষে সেনদিদি আর এক বিস্ময় সৃষ্টি করে উপন্যাসের গতিকে তীব্র ও নাটকীয় করে তুলেছে। অসম্ভব হলেও সম্ভব হয়েছে সেনদিদির পুত্রবর্তী হওয়ার সংবাদ। একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে যেমন সংসার রঙ্গমঞ্জ থেকে বিদায় নিয়েছে, তেমনি সৃষ্টি করে রেখেছে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র এক গভীর জীবনরহস্য। জীবন ও সম্পর্কের জটিলতাকে পরিস্ফুট করার জন্যই হয়ত এই আখ্যানটির প্রয়োজন লেখকের কাছে এত বেশী ভাবে ছিল।