'একরাত্রি' গল্পের নায়কের চরিত্রটি বর্ণনা করো।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের প্রকৃত স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে নানা ধরনের চরিত্র নানা ভাব ভঙ্গিমায় অনবদ্য হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘একরাত্রি' গল্পটি গল্প কথকের ভঙ্গিতে নায়ক বিবৃত করলেও তার চরিত্রটি নেপথ্য থেকে চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ যে কত বড় ও শক্তিশালী লেখক এখান থেকে তার পরিচয়ও পাওয়া যায়।


গল্পের প্রারম্ভে দেখা যায় নায়ক তার বাল্যসঙ্গী সুরবালার সঙ্গে একত্রে লেখাপড়া, খেলাধূলায় কাল যাপন করছিল। শৈশবেই সুরবালা তার আনুগত্য স্বীকার করেছিল এবং সুরবালার মাও নায়কের সঙ্গেই তার বিবাহের ইচ্ছা ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ করার ফলে নায়কের মনে সুরবালার প্রতি আধিপত্য এবং সুরবালার ঐশ্বর্য-নারীজীবনের ঐশ্বর্যের প্রতি নায়কের স্বাভাবিক তাচ্ছিল্য ছিল। তার রূপ, সৌন্দর্য সবই যেন কেবলমাত্র নায়কের জন্যেই বিধাতা সৃষ্টি করেছিল—এই ধারণা মনে বদ্ধমূল হওয়ার ফলে সুরবালার প্রতি অবহেলা ও অত্যাচার করতে তার মনে কোনো দ্বিধা জন্মায় নি। এবং তার হুকুম পালন করতেই যে সুরবালা তার পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেছে এ বিষয়েও নায়কের কোনো সংশয় ছিল না।


বাল্যকাল থেকেই অর্থের প্রতি নায়কের একটি মোহ ছিল। যার ফলে নায়কের পিতা নায়ককে জমিদারি সেরেস্তার নায়েব করতে চাইলে নায়ক রাজী হয় না। তার আদর্শ ছিল গ্রামের নীলরতন নামের একটি ছেলে, যে কলকাতায় লেখাপড়া করে কালেক্টর সাহেবের নাজির হয়ে কাজ করছিল। ছোটবেলা থেকে দেখেছে, আদালত জীবিদের প্রতি বিষয়ী লোকের অযাচিত শ্রদ্ধা। মাছটা-তরকারিটা, টাকাটা-সিকেটা তাদের কাছে প্রেরণ করে প্রায়ই অনুগ্রহ কামনা করত। যেন উক্ত আদালতজীবিরাই বাংলাদেশের পূজ্য দেবতা; তেত্রিশ কোটির ছোটো ছোটো নতুন সংস্করণ। বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে সিদ্ধিদাতা গণেশের চেয়েও এঁদের প্রতি বিষয়ী লোকেরা আন্তরিকভাবে নির্ভরশীল। এ ঘটনা থেকে সহজেই প্রমাণিত হয় নায়কের মধ্যে সততার কিছু কমতি ছোটবেলা থেকেই ছিল। সেই সঙ্গে তার অর্থলোভের প্রবণতাও প্রকট হয়ে পড়ে। নায়কের উচ্চমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অর্থলোভই ছিল প্রবল।


উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্যে নায়ক কলকাতায় পালিয়ে আসে। গ্রামেরই এক প্রতিবেশীর বাড়িতে থেকে এবং পিতার প্রেরিত অর্থ দিয়ে তার পড়াশোনা যথাযথ ভাবেই চলতে থাকে। এর মধ্যে কৈশোরের উন্মাদনায় স্বদেশ হিতব্রতে নায়ক আকৃষ্ট হয়। কলকাতায় সে সময় স্বদেশের হিত সাধনার জন্যে নানা সভা ও বক্তৃতা চলছিল। কিশোর নায়কের চিত্তে তারই আন্দোলন সাড়া জাগিয়েছিল। ফলে লেখাপড়ার চেয়ে সে স্বদেশের সেবাব্রতকেই জীবনে অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করল। কলেজের ক্লাসের চেয়ে মুখ্য হল চাঁদার বই বগলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘোরা। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে চাঁদা সংগ্রহ করা ছাড়াও, দলপতিদের বক্তৃতা করার জন্যে বেঞ্চ চেয়ার পাতা আর দলপতিদের বিরুদ্ধে কেউ কটূক্তি করলে কোমর বেঁধে লড়াই করতে নামা—এই সমস্ত কাজে সে ব্যস্ত হয়ে গেল। তার লেখাপড়া, অর্থলোভ কিছুই আর মনে রইল না। তখন একটাই চিন্তা দেশের সেবায় কিভাবে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া যায়।


এখানে একটা চিত্র পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছে যে, নায়কের চরিত্রে কোনো সংকল্প-দৃঢ়তা ছিল না। সে ছিল আবেগপ্রবণ। যখন যে আবেগ তাকে মথিত করেছে, তখন সেই স্রোতেই সে গা ভাসিয়েছে। ভবিষ্যৎ সে কখনও ভাবে নি। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখেছে মাত্র। তাই তার বাবা যখন জমিদারি সেরেস্তার নায়েব হিসেবে নিযুক্ত করার কথা ভেবেছিল, তখন তার দৃষ্টি ছিল আদালতজীবী হবার। কেননা জমিদারি সেরেস্তার নায়েবের চেয়েও তাদের সম্মান ও প্রতিপত্তি বেশি। তারপর যখন কলকাতায় লেখাপড়া করতে এল, তখন লেখাপড়া শেখা, নাজির হওয়া প্রভৃতি জীবনের লক্ষ্যগুলি সব ভেসে গেল—স্বদেশহিতব্রতের উন্মত্ত জোয়ারে। এবারে তার আদর্শ হল ইতালীয় বিপ্লবী মাটসিনী, গারিবালডি।


নায়ক যে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ চরিত্রের ছিল, তার প্রধান প্রমাণ হল যখন যে লক্ষ্য বা আদর্শকে সে তার জীবনে মুখ্য বলে মনে করেছে, তখন তাকেই একাগ্রচিত্তে সে বরণ করেছে। অন্যান্য যা কিছু সবই তার কাছে তুচ্ছ ঘটনা বলে মনে হয়েছে। তাই কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় যখন স্বদেশ হিতব্রতে আত্মনিয়োগ করে দেশোদ্ধারের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেবার কথা ভাবছে, সেসময় পিতার পত্রে সুরবালার সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব এলে সেই প্রস্তাবকে সে হেলায় ফিরিয়ে দেয়। পড়াশোনা শেষ না করে সে বিবাহই করবে না—এই বার্তা নায়ক তার পিতাকে লিখে পাঠায়। এবং সুরবালার অন্যত্র বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার সংবাদ তার কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয়। অথচ এই সুরবালাকে নিয়েই যখন তার বাল্যের দিনগুলি কেটেছিল তখন সুরবালার প্রতি যে তার বিশেষ অধিকার আছে একথা বুঝতে ও বোঝাতে কোনো অন্যথা করে নি। এবং জগতে শুধুমাত্র তার হুকুম মানতেই যে সুরবালার জন্ম এ ধারণাও তার মনে ছিল বদ্ধপরিকর।


পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পর তাকে অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় যখন বেরুতে হল তখন তার এতদিনের যত আদর্শ সবই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। কোনোরূপ বদ্ধপরিকর সিদ্ধান্ত না থাকায় তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহও পাঠকের চিত্তে কোনো বেদনার সৃষ্টি করল না।


নোয়াখালি বিভাগের একটি ছোট শহরের এন্ট্রান্স স্কুলে সেকেণ্ড মাস্টারির কাজ পেয়ে নায়ক প্রথমে ভেবেছিল এক একটি ছাত্রকে উপদেশ দিয়ে দেশের এক একটি সেনাপতি হিসেবে গড়ে তুলবে। সেইমত সে কাজ শুরু করল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরেই তার সেই উৎসাহে ভাঁটা দেখা দিল।


শিক্ষক জীবনে এসে বাস্তবতার ছোঁয়ায় নায়কের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। সে পরিবর্তন তার মানসিক পরিবর্তন। ক্রমে আবেগ প্রবণতার ভাব কমে আসায় সে বুঝতে পারে মনুষ্যজীবন একটি ভ্রমের জাল। জীবনে এতদিন সে কেবল ভুলই করে এসেছে। ভুলের সংশোধনও তার কাছে ভুলেরই মতো পরিণতি দান করেছে।


শিক্ষক জীবনে আবার তার সামনে এসে পড়ে সুরবালার প্রসঙ্গ। সেই একান্ত বাল্যসঙ্গিনী আজ পরস্ত্রী। হেলায় তাকে হারিয়ে নায়ক আক্ষেপ করে। এই আক্ষেপের মধ্যে থেকেই উঠে আসে নায়কের সমাজনীতি সম্বন্ধে প্রশ্ন এবং নারী প্রগতির ভাবনা। এতদিন যে ছিল সুখদুঃখের খেলার সঙ্গী আজ বিবাহের পর সে নারী এতই পর হয়ে গেল যে তার মুখ দেখাও অন্যায়, তার সঙ্গে কথা বললেও সমাজ কলুষিত হবার আশঙ্কা। এ প্রশ্ন তার বিক্ষুব্ধ প্রেমিক চিত্ত থেকে উত্থিত হয়ে, পাঠককে ভাসালেও, নায়ক সমাজের সঙ্গে সমঝোতাই করেছে শেষ পর্যন্ত। তবু সমাজের দায়ে সে হৃদয়বৃত্তির কতর্ব্য বোধকে অস্বীকার করতে পারে নি। তাই দুর্যোগের রাত্রে সুরবালা তার ঘরে একা আছে জেনেও প্রথমে সমাজের অনুশাসনের জন্যে সুরবালার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করতে তার দ্বিধা হলেও, পরে নিজেই বেরিয়েছিল সুরবালাকে নিজের আস্তানায় নিরাপদে রাখার বাসনায়। ওই অন্ধকার দুর্যোগের মধ্যে পৃথিবী যখন নিদ্রামগ্ন তখন বাঁচার তাগিদে একটি মাত্র ঢিবির অদূরে কেবলমাত্র নায়ক এবং সুরবালা আবস্থান করছিল। কোনো দোষ ছিল না যদি একে অন্যের সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু নায়ক এখানে তার সংযম এবং সুরবালার প্রতি তার কল্যাণকামী প্রেমের পরিচয় দিয়েছে কোনো কথা না বলে, এতদিনের রুদ্ধ আবেগকে আত্মস্থ করে। এখানেই নায়কের চরিত্রের সার্থকতা। শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত সে আবেগপ্রবণ ছিল ঠিকই কিন্তু যৌবনে তার সে আবগ প্রশমিত হয়ে তাকে সংযমী ও বাস্তববুদ্ধি মণ্ডিত করে তুলেছে।