'মহানগর' গল্পে রতন চরিত্রের উত্তরণের পর্যায়গুলিকে লেখক দেখিয়েছেন সতর্ক ও মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে। – রতন-চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে বক্তব্যটির যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করো।

'মহানগর' গল্পে নায়ক-চরিত্র হিসাবে কাকে অভিহিত করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়? উত্ত চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করে দেখাও।


প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘মহানগর’ গল্পে মহানগর কলকাতার বহুবিচিত্র জীবনের একটি খণ্ডাংশকে উপস্থাপিত করেছেন। এ-গল্পের বিষয়বস্তু একটি অল্পবয়সি বালকের মহানগরে হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে বের করবার কাহিনি। এই কাহিনিকে তুলে ধরা হয়েছে গ্রাম্য বালক রতনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। রতনকে লেখক হাজির করেছেন মহানগরের পটভূমিতে। রতন মহানগরে কেন এসেছিল, সেটি জানাবার পূর্বে লেখক মহানগর সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেছেন—'মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ আসে কত কিছুর খোঁজে কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ বা বিস্মৃতি। মৃত্তিকার স্নেহের মত শ্যামল একটি অসহায় ছেলে সেখানে এসেছে কিসের খোঁজে? লেখকের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি ছেলেটির অর্থাৎ রতনের মহানগরে সন্ধানের অনুসরণেই আলোচ্য গল্পের কাহিনিবিন্যাস করেছেন এবং গল্পের আদি-মধ্য-অন্ত্য জুড়ে মহানগরের প্রেক্ষিতে রতনকেই মুখ্য ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছেন। তার শিশুচক্ষের মধ্য দিয়েই গল্পের সমস্ত ঘটনা বিবৃত হয়েছে। অতএব 'মহানগর' গল্পে নায়ক-চরিত্র হিসাবে রতনকে অভিহিত করাই সর্বাধিক যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়।


আলোচ্য গল্পে রতন অভিজ্ঞতার ঘাট বেয়ে জীবনের নির্মম সত্যকে উপলব্ধি করেছে। নদী যখন মহানগরের নাগাল পেয়েছে, তখনই পাঠকের সঙ্গে রতনের প্রথম পরিচয়। বড় নদীতে যখন জোয়ারের টানে তাদের নৌকো ভেসে চলে, তখন রতন এসে হালে বসে থাকা পিতা মুকুন্দর পাশে এসে বসে। তার আশঙ্কা, বাবা হয়তো ধমকে তাকে দুই-এর ভিতরে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু রতনের তখন ভেতরে থাকা সম্ভব নয়, কারণ নৌকো মহানগরের নাগাল পেয়েছে। রতনের কল্পনাপ্রবণ শিশুমন ধারণা করে, আকাশের তারা জলের ওপর নেমেছে। সে আলো ছেটানো এই নগরের অন্ধকারকে দু'চোখ দিয়ে পান করে। তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে আনতে চায়নি। নৌকোয় এতটা পথ যাওয়া সোজা কথা নয়। শহরে গিয়ে রতনের কিছু করারও নেই। তবুও সে দুষ্টুমি না করার শর্ত মেনেই বাবাকে রাজি করিয়ে শহরে এসেছে। রতন ‘রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত শহর’ দেখতে চায়। কিন্তু এটাই তার শহরে আসবার একমাত্র কারণ নয়।


আসলে রতনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অন্য এক অভিপ্রায়। মহানগরে পৌঁছবার আগেই সে প্রশ্ন করেছিল, পোনাঘাটের থেকে উল্টোডিঙি কতদূর। তার কথা শুনে নৌকোর লক্ষ্মণ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল যে, রতন‌ উল্টোডিঙির খোঁজ করছে কেন! কিন্তু রতন চাপা স্বভাবের ছেলে। সে পেটের কথা বের করে না। তাই উল্টোডিঙির খোঁজ করার কারণকে সে তার লক্ষ্মণকাকার কাছে গোপন রাখে। বড় নদীতে মহানগরের বিরাট, জটিল রূপ দেখে রতন যেমন ভয় পেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি হতাশ হয়েছিল। কারণ এত প্রকান্ড মহানগরের ভেতর গিয়ে সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে রতন খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। তারপর তাদের নৌকো বাঁক নিয়ে নদীর শাখাপথে ঢুকলে সে তখন নদী তীরবর্তী পুরনো শহরতলি দেখে পুনরায় আশায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পোনাঘাটে পৌঁছবার আগে তার বাবা মুকুন্দ হাঁক দিয়ে সবাইকে ভুললে রতন উত্তেজনায় উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে। তার চাপা দুটি পাতলা ছোট ঠোঁট সংকল্পে দৃঢ় হয়ে ওঠে, বড় বড় দুটি চোখে ব্যগ্রতা প্রকাশ পায়। পোনাঘাটে নৌকো এসে লাগলে সে তার বাবার সঙ্গে সঙ্গে নৌকো থেকে জলে নেমে ডাঙায় ওঠে। মুকুন্দ রতনকে কোথাও না গিয়ে কদমগাছের তলায় দাঁড়াতে বলে।


কিন্তু রতন ভেতরে ভেতরে আপন লক্ষ্যে পৌঁছতে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। শুধু একস্থানে স্থির হয়ে থাকবার জন্য সে শহরে আসেনি। কদমতলায় দাঁড়িয়ে উৎসুকভাবে রতন চারিদিকে তাকায়। তার বাবাকে কাজে ব্যস্ত দেখে সে একসময় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে রাস্তার একটা দিক ইচ্ছেমতো ধরে সে এগিয়ে যায়। এইসময় অল্পবয়সি রতন উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দেয়, যখন একটি লোক সন্দেহবশত সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে কিনা জানতে চায়। রতন ভয়ে ভয়ে বলে ফেলে, সেখানে আমার দিদি থাকে'। এ কথা বলেই রতন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যায়। তার চিন্তা হয়, লোকটা যদি আরও কিছু জিজ্ঞাসা করে, লোকটা যদি রতনের বাবার কাছে তাকে ধরে নিয়ে যায়।


আলোচ্য গল্পের এই অংশে এসে আমরা বুঝতে পারি, রতন তার দিদিকে খুঁজতে মহানগরে এসেছে। রতন গ্রামের ছেলে। শৈশবে সে মাকে হারায়। দিদিই ছিল তার মায়ের মতো। একসময় দিদির বিয়ে হয় পাশের গাঁয়ে। রতন মাঝেমধ্যেই দিদির কাছে গিয়ে থাকত। বাড়িতে ফিরতে চাইত না। তার বাবা গিয়ে তাকে জোর করে নিয়ে আসত। দিদি যেখানে থাকতে পারে দিনের পর দিন, সেখান তার বেশিদিন থাকাটা কেন যে দোষের, সরল বালক রতন তা বুঝতে পারত না। একদিন খবর এল, দিদির বাড়িতে গোলমাল। কেন গোলমাল, তা রতন জানতে পারে না। একদিন রতনদের বাড়িতে দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছিল, থানা থেকে পুলিশও এসেছিল। রতন শুনতে পেল, তার দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেমানুষ বলে তাকে এসব ব্যাপারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এ সংবাদে রতন খুব কেঁদেছিল। মায়ের মতো দিদির প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসা চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিল। তার সংবেদী শিশুমন কল্পনা করে, যারা দিদিকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা হয়তো তাকে খুব মারছে, হয়তো দিদিকে খেতে দিচ্ছে না। দিদিও হয়তো তাকে দেখবার জন্য কাঁদছে। বাবাকে দিদির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেও সে কোনো প্রত্যুত্তর পায়নি। রতন বুঝতে পারে, কিছু একটা ঘটেছে, যা বাবা তার কাছে লুকোতে চায়। দারোগা-পুলিশের আবির্ভাব এবং বাড়িতে দিদির নাম-উচ্চারণে নিষেধ থাকায় রতনের মনে সংশয়ের বোধটি আরও দৃঢ় হতে থাকে। সে যে ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠছে, তা বোঝা যায় তার এ-সময়ের অনুভূতিগুলো থেকে।


ব্যাকুল ও শোকাতুর রতন একদিন শোনে যে, তার দিদিকে পাওয়া গেছে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও দিদি কেন বাড়ি আসে না, রতন তা বুঝতে পারে না। দিদির ওপর তার রাগ হয়। একদিন সকালে সে দিদির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু সেখানে দিদি নেই। সেখানে কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। কাঁদো কাঁদো মুখে রতন সেদিন বাড়ি ফিরে আসে। বাবার কাছে দিদিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলে ধমক খায়। রাত্রে সে চুপিচুপি শুধু দিদির জন্য কাঁদে। রতন যদি জানত, তার দিদি কোথায় আছে, তাহলে সে নিজে গিয়েই তাকে নিয়ে আসত। অবশেষে রতন একদিন কোথা থেকে জানতে পারে, তার দিদি থাকে শহরে, জায়গাটার নাম উল্টোডিঙি। অতঃপর সে অসীম সাহসিকতা আর দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে একলা মহানগরের পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তার দিদিকে খুঁজে বের করে।


রতন চরিত্রের এই উত্তরণের পর্যায়গুলিকে লেখক দেখিয়েছেন সতর্ক ও মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে। উল্টোডিঙির পতিতাপল্লীতে সে হঠাৎই খুঁজে পেয়েছিল তার দিদিকে। পরিস্থিতির চাপে রতনের বোধ-বুদ্ধিতে পরিণতির ছাপ পড়তে শুরু করলেও দিদি কেন এমন স্থানে রয়েছে, সেটা সে বুঝতে পারেনি। দিদিকে আবিষ্কার করার মুহূর্তে রতনের কষ্ট হয় তাকে চিনতে। তার মনে হয়—“দিদি যেন কেমন হয়ে গেছে। দিদি চপলা ছুটে এসে তার প্রিয় ভাইকে বুকে চেপে ধরে যখন জানতে চায় সে একা এসেছে কিনা, তখন রতন কিছু না বলে দিদির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। বোঝা যায়, এতদিন পরে সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় দিদিকে খুঁজে পেয়ে রতন অনির্বচনীয় আনন্দে স্তব্ধ হয়ে আছে। নগরের পরিবেশে দিদির ঘরের সম্পদ-সামগ্রী দেখে সে বিস্মিত হয়। অবশ্য তার মূল উদ্দেশ্য, দিদিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সে একটুও ভোলে না। তখনও রতনের মধ্যে কাজ করে চলেছে সরল শিশুহৃদয়। তাই সে গোরুর গাড়ি ডেকে দিদির জিনিসপত্র তুলে ফেরার উদ্যোগের কথা বলে। চপলা কাতর মুখে যখন জানায় যে, তার ফেরার উপায় নেই, তখন বাড়িতে তার বাবার রাগের কথা রতনের মনে পড়ে। দিদিকে খুঁজে পেয়েও তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে না পারার বেদনায় সে কাতর হয়। তারপরেই হঠাৎ সে উজ্জ্বল মুখে বলে—আমিও তাহলে যাব না দিদি'। কিন্তু চপলা সে স্থানে তার থাকার নিষেধের কথা বললে রতনের অত্যন্ত অভিমান হয়। পিছুটান, তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তা—সবকিছুকে সে অগ্রাহ্য করে দিদির সঙ্গে থেকে যেতে চেয়েছিল। তবু তাতেও যখন দিদির আপত্তি, তখন সে চলেই যাবে। বাবার মতো সেও আর কখনও দিদির নাম করবে না। চপলা রতনকে চার টাকা দিলে সে বিমূঢ় অবস্থায় সেই টাকা নিতে অস্বীকার করতেও ভুলে যায়। গভীর দুঃখে তার সমস্ত বুক যেন ভেঙে গেছে।


একবেলার এই অভিজ্ঞতাতেই রতন যেন জীবন সম্বন্ধে অনেক পরিণত বোধ অর্জন করে। বিদায় নিয়ে বড় রাস্তার কাছে গিয়েও হঠাৎ সে ফিরে এসে দিদিকে বলে—‘বড় হয়ে আমি তোমায় নিয়ে যাব দিদি। কারুর কথা শুনব না'। গল্প তথা রতন-চরিত্রে এটাই চরম মুহূর্ত। এখানেই তার শিশু-ব্যক্তিত্বে পরিণতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে রতন অনুভব করেছিল, দিদির গ্রামে ফেরার পথে প্রধান অন্তরায় বড়রা। সমাজ তো বড়দের নিয়েই। রতন তাই অঙ্গীকার করে, সে বড় হয়ে নিষেধের বন্ধনকে অগ্রাহ্য করেই দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এ-কথা বলেই সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চিত্তে সবল ভঙ্গিতে মহানগরের গলির মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। মহানগরের অন্ধকার, কুটিল স্থানে এসে আলোচ্য গল্পে এভাবে রতন চরিত্রের উত্তরণ ঘটেছে।