‘মুক্তধারা’ নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলি কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছে কি না আলোচনা করো।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে যে প্রেক্ষাপট বা পটপরিবর্তন রচয়িতা নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে, বর্ণনার মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন, নাটকের ক্ষেত্রে প্রায়শই সেই উদ্দেশ্য সাধন করতে নাট্যকার প্রধান প্রধান চরিত্রগুলির পাশাপাশি অনেক অপ্রধান চরিত্র সৃষ্টি করেন। এই চরিত্রগুলির সৃষ্টি হয় কোনো না কোনো জরুরী কারণে, তাই দেখা যায় প্রতিটি অপ্রধান চরিত্রেরই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নাটকের মধ্যে থেকে যায়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের নাটকের অপ্রধান চরিত্রগুলিকে বিচার করতে গেলে দেখা যায়, এর কোনো চরিত্রই অবাঞ্ছিত নয়। প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছে। কোনো চরিত্রই অনাবশ্যক নয়, এমনকি কোনো একটি অপ্রধান চরিত্রকে বাদ দিলে নাটকের কোনো না কোনো অংশ পঙ্গু হয়ে পড়তে পারে- এমনই অমোঘ ভাবে প্রযুক্ত হয়েছে আলোচ্য নাটকে অপ্রধান চরিত্রগুলি।


আমাদের আলোচ্য ‘মুক্তধারা' নাটকে অপ্রধান চরিত্রের সংখ্যা অনেক। ভৈরবপন্থীর দল, মন্ত্রী, সুমনের মা অম্বা, বটু, বিশ্বজিৎ, সঞ্জয়, জনতা, দূত প্রভৃতি চরিত্রগুলি আলোচ্য নাটকের অপ্রধান চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে।


আলোচ্য নাটকের শুরুতেই দেখতে পাই ভৈরবকীর্তন রত একদল ভৈরবপন্থী সাধককে। এঁরা সাধারণ ভাবে ভৈরবপন্থীর দল অভিধায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সমগ্র নাটকে বহুবার তারা একই গান বৈচিত্র্যহীন ভাবে গেয়েছে দুটি ভাগে ভাগ করে। আপাতদৃষ্টিতে তাদের দেখলে মনে কোনো রেখাপাতই করে না। কিন্তু একটু গভীর ভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের গান প্রতিবারে নাটকের সংকট মুহূর্তে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের ভৈরবের বরাভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করেছে। নাটকের পরিণতিতেও আমরা দেখি প্রলয়-রুদ্রতার মধ্যে দিয়েই ভৈরবের কল্যাণ-হস্ত প্রসারিত হয়েছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে মানবকল্যাণকামী শক্তিই বরাবর দেবতা রূপে বন্দিত হয়েছেন। সেই মানবকল্যাণের আগাম বিজয় বিঘোষক রূপে আলোচ্য নাটকে ভৈরবের কীর্তনকারী ভৈরবপন্থীদের অবদান অনস্বীকার্য।


আলোচ্য নাটকে অপ্রধান অথচ অন্যতম বলিষ্ট চরিত্র রূপে চিত্রিত হয়েছে মন্ত্রী চরিত্রটি। তিনি বরাবর যথাসময় যথাযোগ্য মন্ত্রণা দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রনীতি আমাদের অস্ত্র, মানুষের মন নিয়ে আমাদের কারবার।' তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক মত ও পরামর্শ তাই সর্বদাই প্রজাকল্যাণকারী। শিবতরাইয়ের প্রজাদের রাজাভিমুখী করার অভিপ্রায়ে তিনিই রাজা রণজিৎকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যুবরাজ অভিজিৎকে শিবতরাই অঞ্চলের শাসক রূপে নিযুক্ত করার জন্যে। এবং অভিজিৎ শিবতরাই অঞ্চলের শাসনভার নিয়ে তাদের খাজনা মকুব করে দিলে, রাজা যখন বিরক্ত হলেন, তখন মন্ত্রী তাঁকে বুঝিয়েছিলেন ‘খাজনার চেয়ে বড় জিনিস’ যেখানে লাভ হচ্ছে সেখানে এই নীতি মেনে নেওয়াই সঙ্গত। কিন্তু রাজার অর্থলিপ্স মন সে কথায় ভরসা না করে বিভূতির যন্ত্রশক্তিকে আশ্রয় করেছিল। কূটনীতিতে অভিজ্ঞ বিচক্ষণ মন্ত্রী উত্তরকূটের অভিজিৎ-বিদ্রোহী প্রজাদের বাচাতুর্যে পরাস্ত করতে পারেন। শিক্ষাব্যবস্থা রাজ্যের স্বার্থানুযায়ী হবার জন্যে আত্মস্বার্থলোভী অল্পবুদ্ধি শিক্ষক নিযুক্ত করেন। রাজ-স্বার্থে এত কিছু করা সত্ত্বেও প্রজাশোষণের জন্যে বিভূতির বাঁধ প্রকল্পকে তিনি সমর্থন করতে পারেন নি। রাজার চেয়ে যুবরাজের হৃদয়বৃত্তীয় নীতিতে তিনি অধিক আস্থা স্থাপন করেন।


আলোচ্য নাটকের প্রথম দিকে অম্বা নামে এক সন্তানহারা জননীর হাহাকারে মন ব্যথিত হয়ে ওঠে। সুমনের মা অম্বার বাড়ি জনাই গাঁয়ে। উত্তরকূটের ভৈরব মন্দিরে অম্বা পূজো দিতে এসেছিল, বাড়ি ফিরে সে দেখে তার সুমনকে নিয়ে গেছে। লোকেরা বলে, তাকে নিয়ে গেছে গৌরীশিখরের পশ্চিমে— যেখানে কারো দৃষ্টি পৌঁছয় না, সেইখানে। সেখান থেকে সুমন আর ফেরে নি। অম্বা জীবন দিয়ে দেখেছে, ভৈরব মন্দিরে যে পূজো পাঠানো হয় তা ভগবানের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। পথের মাঝে সে পূজো লুঠ করে নেয় তারা— যারা সুমনকে নিয়ে গেছে। তার সংলাপ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এখানকার শাসকরা শোষণ চালায় ধর্মকে হাতিয়ার করে। তাদের পানীয়, তাদের ক্ষেতের জল সরবরাহ, তাদের শিক্ষা সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ভৈরবের দোহাই দিয়ে। এমনকি রাজা একথাও বলেছেন যে, তৃষ্ণার শূলে বিদ্ধ করে তিনি (ভৈরব) শিবতরাইয়ের প্রজাদের রাজসিংহাসনের তলায় এনে ফেলবেন। অর্থাৎ সমস্ত রকমের শোষণ তিনি চালাচ্ছেন ভৈরবের দোহাই দিয়ে। অম্বা না থাকলে উত্তরকূটের এই শোষণ-বিম্বন সহজে ধরা পড়ত না পাঠকের চোখে।


মোহনরাজ তথা রণজিতের পিতৃব্য বিশ্বজিৎকে আলোচ্য নাটকে অভিজিৎপ্রেমী হিসেবে দেখা গেলেও প্রথম দিকে ছিলেন অত্যাচারী, পরে তিনি বিবেকবান হয়ে উঠেছিলেন। রাজার কাছে তিনি সেই কথাই ব্যক্ত করেছেন, 'চণ্ডপত্তনে যখন তুমি বিদ্রোহ শুরু করেছিলে সেখানকার প্রজার সর্বনাশ করে সে বিদ্রোহ আমি দমন করি নি? শেষে কখন ঐ বালক অভিজিৎ আমার হৃদয়ের মধ্যে এল আলোর মতো এল। অন্ধকারে না দেখতে পেয়ে যাদের আঘাত করেছিলুম তাদের আপন বলে দেখতে পেলুম।' নিজে আলোকিত হয়ে বিশ্বজিৎ চেয়েছিলেন সমস্ত রাজ্যে মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তুলতে। তাই তিনি বলেছিলেন, 'রাজচক্রবর্তীর লক্ষণ দেখে যাকে গ্রহণ করলে তাকে তোমার ঐ উত্তরকূটের সিংহাসনটুকুর মধ্যেই আটকে রাখতে চাও?’ বস্তুত, তিনি অভিজিৎ তথা মনুষ্যত্বকে রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত। তিনি চান মনুষ্যত্ববান হয়ে নিজে যেমন আনন্দিত হয়েছেন, সমগ্র রাজ্যবাসীও তেমনই আনন্দিত হয়ে উঠুক। তাই বন্দী অভিজিৎকে উদ্ধার করতে তিনি শিবিরে আগুন ধরানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানতে পারি অভিজিতের ব্রত ও সংকল্পের কথা।


সরল, সত্যবাদী রাজকুমার সঞ্জয অভিজিতের সঙ্গ কামনা করেন। অভিজিতের ভালো মন্দের দায় ভার নিতে চান। অভিজিতের ব্রতয় ব্রতী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু নিজের মধ্যে কোনো গোপনতা তিনি রাখতে পারেন না বলে অভিজিতের সহকর্মী হতে তিনি পারেন না। সব মিলিয়ে সঞ্জয় মানবতায় পূর্ণ রাজকুমার। ঐশ্বর্য তাঁর মনুষ্যত্বকে গ্রাস করেনি। তাই তিনি মনুষ্যত্ব রূপী অভিজিতের সারথির পদ নিতে প্রস্তুত ছিলেন।


জনতার দল মুক্তধারা নাটকের এক অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকেই একাধিক জনতা আছে। কিন্তু মুক্তধারার জনতা অনেক— ইহার প্রায় অর্ধাংশই জনতার কথোপকথন। নাটকটি পথের কাহিনী, স্বভাবতই ইহার যোগ্য পাত্রপাত্রী পথিক, মুক্তধারার জনতা পথিক জনতা। নাটকের চরম সংকটের মুহূর্তে শিবতরাই ও উত্তরকূটের হাজার হাজার পথিক পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এই পথিক অধিকাংশই নাম পরিচয় ও ব্যক্তিত্বহীন। পথিকের আবার পরিচয় কি? জনতার আবার ব্যক্তিত্ব কি? মানুষ যখন এক তখন তাহার ব্যক্তিত্ব থাকে, কিন্তু যখন সে জনতার মধ্যে আত্মনিমজ্জন করিয়া দেশের এক হইয়া যায় তখন তাহার ব্যক্তিত্ব ঘুচিয়া যায়; সমষ্টির পরিচয়েই তখন তাহার একমাত্র পরিচয়। কাজেই মুক্তধারার জনতার ব্যক্তিপরিচয় নাই, কিন্তু চমৎকার সমষ্টি আছে।”


আলোচ্য নাটকে যুবরাজ অভিজিতের দূত-এর কাছ থেকেই পাঠক প্রথম জানতে পারে যে, যন্ত্ররাজের বাঁধ যুবরাজ অভিজিৎ ভাঙবেন। রাজপ্রহরীরা যতই পাহারা দিক না কেন, অভিজিতের তাতে বাঁধ ভাঙার অসুবিধে হবে না। কেন না, দৃঢ় করে বাঁধা সেই বাঁধকে সামনে থেকে ভাঙা অসম্ভব। তাই যুবরাজের বাঁধ ভাঙার পরিকল্পনার কথা বিভূতিকে জানাতে এসে দূত বলেও দেয় যে, ‘ভাঙনের যিনি দেবতা তিনি সবসময় বড়ো পথ দিয়ে চলাচল করেন না। তাঁর জন্যে যে-সব ছিদ্রপথ থাকে সে কারও চোখে পড়ে না। অর্থাৎ যুবরাজ যে বাঁধ ভাঙবেন বাঁধের কোন দুর্বল ক্ষুদ্র অংশকে অবলম্বন করে তার আগাম সংবাদটি দূত পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সর্বাগ্রে। নাট্য পরিণতিতে হয়েছিলও তাই।


মুক্তধারা নাটকে সবচেয়ে অল্পসময়ের জন্যে দুটি স্ত্রীলোক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। তারা তাদের সংলাপে অভিজিতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাস ও প্রিয়তার কথা ব্যক্ত করেছে। সাধারণ জনমনের প্রতিনিধি রূপেই তাদের উপস্থিতি ঘটেছে আলোচ্য নাটকের মধ্যে। এই ভাবে দেখা যায়, মুক্তধারা নাটকের প্রতিটি অপ্রধান চরিত্রই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় মুক্তধারা নাটকে অপ্রধান চরিত্রগুলি নিতান্তই অমোঘ এবং তাদের ভূমিকাও অপরিসীম।