ছোটগল্প হিসাবে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পটি কতখানি সার্থক তা আলোচনা করো।

আধুনিক ছোটোগল্প অনেকসময় প্রথাগত ছোটগল্পের চরিত্র বা কাহিনী নির্ভরতাকে গৌণ করে দিয়ে মনন-প্রধান হয়ে উঠছে। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর 'চোর' গল্পটিকে একটি মনন প্রধান সংকেতময় ছোটগল্প মনে করা যেতে পারে।


‘চোর’ গল্পটি নিঃসন্দেহে একটি সমাজ-সমস্যামূলক গল্প। এই সমাজ-সমস্যাটি হল নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পারস্পরিক শ্রেণিসম্পর্কের সমস্যা। বর্তমান সমাজে উচ্চবিত্তদের মধ্যে তেমন আত্মিক সংকট নেই। তারা তাদের বিত্তের অহমিকা ও সমৃদ্ধি নিয়ে সমাজের উপরতলায় বাস করে নিম্নশ্রেণির প্রতি করুণাবর্ষণে অভ্যস্ত। সমাজের নিম্নবিত্তদের মধ্যেও একদিক থেকে আত্মিক সংকট অনুপস্থিত। তারা অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যে কোনো অবস্থার সঙ্গে প্রশ্নহীনভাবে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। গল্পে মদনকে দেখি, সুকুমারদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে সে মধ্যবিত্ত মিন্টুদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আবার সুকুমারদের বাড়িতে পুনর্বহাল হয়ে সে অকুণ্ঠচিত্তেই মিন্টুকে জানিয়ে দেয় যে, তাদের বাড়ি সে আর কাজ করবে না। এক নির্লজ্জ মোহ ও আত্মসমর্পণই তাদের বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র, এজন্য কোনো পিছুটান বা আত্মিক যন্ত্রণা তাদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত। মধ্যবিত্তের মধ্যেই থাকে তীব্র এক আত্মিক সংকট। রুচি, শিক্ষা, আত্মসম্মানবোধ, বিবেকবোধ, শ্রেণিসচেতনতা মধ্যবিত্তের এই সংকটকে তৈরি করে। তাদের মধ্যেই থাকে নীচে নামার ভয় বা ওপরে ওঠার আভিজাত্যবোধ। গল্পে মিন্টুর মধ্যে এই আত্মসংকট সৃষ্টি হতে দেখি। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় বিত্তের নিরিখে বিভক্ত সামাজিক বিন্যাসকে ‘চোর’ গল্পে সংক্ষিপ্ত সংহত অবয়বে অসাধারণ শিল্পকুশলতায় প্রকাশ করা হয়েছে।


গল্পের আখ্যানভাগ নিছক বিবরণধর্মী। মিন্টুর পেঁপেচারা রোপণ। মদনের আগমন ও মিন্টুদের বাড়িতে সামান্য মাহিনায় কর্মে নিযুক্তি। কাজ চলে যাবার জন্য সুকুমারদের প্রতি ক্ষোভ। ওদের বাড়ি থেকে গাছ চুরির পরিকল্পনা এবং শ্রেণিগত ক্ষোভের কারণে স্কুলফেরৎ সুকুমারের গায়ে কাদাজল ছিটিয়ে দেওয়া পর্যন্ত কাহিনীটি নিছক সরল ও স্বাভাবিক। কিন্তু আপাত সরল ও এই বিবরণে লেখক এক নাটকীয় ঝাকুনি আনেন সুকুমারদের বাড়ি মদনের কাজে লেগে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ঘটনাটিই শ্রেণি-বিভক্ত সমাজের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের একটা অদৃশ্য প্রায় চোরা স্রোতকে চিনিয়ে দেয়। আসলে কোনো শ্রেণি-বিরোধ নয়, উচ্চবিত্তের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং বিত্তের ঔজ্জ্বল্য ও বিলাসিতার প্রতি মোহটাই নিম্নস্তরবর্তী সামাজিক মনকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে, এই সামাজিক সত্যটি গল্পে প্রকট হয়ে উঠেছে। শুধু নিম্নবিত্ত মদনকে নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিসচেতন মিন্টুও অনুভব করে সুকুমারের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে ও বাড়ির বৈভব, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সুকুমারের মায়ের আদর-যত্ন, ওদের বাগানের ফল-ফুলভরা সৌন্দর্য তাকেও যেন এক অনিবার্য আকর্ষণজালে বন্দী করে ফেলেছে। এই উপলব্ধির পর মিন্টুর মনে হয়—‘পেঁপেচারাটাই মদনকে আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। কেবল মদনকে নয়, আমাকেও.....'। এই আত্মবিশ্লেষণের মধ্যেই তৈরি হয় গল্পের Climax।


ছোটোগল্পের প্রকৃতির মধ্যে যে সংক্ষিপ্ততা থাকে, সেই বৈশিষ্ট্যানুযায়ী মিন্টুর মধ্যবিত্ত মানসের বিশ্লেষণ গল্পে অনুপস্থিত। Climax-এ পৌঁছানোর পরেই অতিদ্রুত লেখক গল্পের উপসংহার বা Catastrophe রচনা করেছেন—‘আর কোনোদিন আমি ও বাড়ি যাইনি।' এই বাক্যের মধ্য দিয়েই গল্পকার অনায়াস কুশলতায় দেখিয়ে দিয়েছেন নিম্নবিত্ত মদনের নির্দ্বিধ আত্মসমর্পণের সঙ্গে শ্রেণি সচেতন মধ্যবিত্ত মিন্টুর আত্মসংকটের মূল প্রভেদ।


‘চোর’ গল্পে কাহিনীর বা ঘটনার আতিশয্য নেই। নেই কোনো আকস্মিকতা। সবই যে স্বাভাবিক, জীবন্ত, অদ্ভুত সংহত, প্রয়োজনীয় গল্পের কাহিনী, ঘটনা, চরিত্র। গল্পের মূল বক্তব্যের একমুখীনতা এসেছে নর্দমার ধার থেকে মিন্টুর পেঁপেগাছ তুলে আনার প্রসঙ্গ থেকেই। এই পেঁপে গাছটাই শেষ পর্যন্ত গল্পটিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। পেঁপেগাছটি মিন্টুদের বাড়ি থেকে মদন আবার চুরি করে নিয়ে যায়। সুকুমারদের বাড়ি সেই লিকলিকে পেঁপেচারার নধর পরিপুষ্ট ফলস্ত চেহারা বর্তমান সমাজের এক স্বরূপকেই যেন প্রকাশ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত গল্পের কথকের অনুভূতিতে মদন চোর প্রতিপন্ন হয় না, পেঁপেগাছটাই চোর প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ পেঁপেগাছটি গল্পকারের কুশলতায় হয়ে যায় বিত্তগত প্রলোভনের অব্যর্থ প্রতীক। এই প্রতীকী ব্যঞ্ঝনার অসাধারণ প্রয়োগেই ‘চোর’ গল্পটি এক সার্থক ছোটোগল্পের মর্যাদা লাভ করেছে।