“ইহারাই আমাদের উদীয়মান জাতীয় নাট্যশালার প্রথম উৎসাহদাতা।” বেলগাছিয়া নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতাদের সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই উক্তির যাথার্থ্য নিরূপণ কর।

১৮৫৭ সালে আশুতোষ দেবের বাড়ির নাট্যশালায় ‘'শকুন্তলা' নাটকের অভিনয় দিয়ে বাঙ্গালীর প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালায় বাংলা নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠানে যে একটি নূতন শক্তি ও গতি সঞ্চারিত হয়েছিল, সেই সৌখিন নাট্যশালাগুলির মধ্যে বেলগাছিয়া নাট্যশালাই ছিল শ্রেষ্ঠ। পাইকপাড়ার বিদ্যোৎসাহী রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও তাঁর ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের উৎসাহেই এই নাট্যশালা নির্মিত ও স্থাপিত হয়। নাট্যশালাটির নির্মাণে মহারাজ যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম প্রধান পরামর্শ দাতা এবং সে যুগের বহু শিক্ষিত বাঙ্গালীও এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়ায় অবস্থিত বাগানবাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল বলেই এর নাম বেলগাছিয়া নাট্যশালা'। সমকালীন শিক্ষিত বাঙ্গালী সমাজের মনে, রঙ্গমঞ্চের সাজসজ্জা, দৃশ্যপট, গীতবাদ্য এবং অভিনয়ে, সকল দিক থেকে এই নাট্যশালাটি ছিল শ্রেষ্ঠ। ধনাঢ্য রাজাদের প্রচুর অর্থব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল এই নাট্যশালা। মধুসূদনের সহপাঠী বন্ধু গৌরদাস বসাকের ‘স্মৃতিকথা' থেকে জানা যায় যে এই নাট্যশালাতেই প্রথম দেশীয় ঐক্যতানবাদনের প্রবর্তন হয়। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ও যদুনাথ পাল, এই দুইজনেই ঐকতানবাদনের দল সংগঠিত করেন। নট্যশালাটির সাজসজ্জা সংগ্রহে ও দৃশ্যপট অঙ্কন ও নির্মাণে বহু অর্থব্যয়ে ইংরেজ শিল্পীদের নিয়োগ করা হয়েছিল। তাছাড়া ইংরেজ তত্ত্বাবধায়কদের উপর মঞ্চ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঐ ‘স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায় যে গ্যাসের আলোয় পাদপ্রদীপ প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং সেই আলোকে একটি মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।


এই নাট্যশালার উদ্বোধন হয় শ্রীহর্ষ রচিত সংস্কৃত নাটক ‘রত্নাবলী' নাটকের রামানারায়ণ তর্করত্ন কর্তৃক বাংলা অনুবাদের অভিনয় দিয়ে। এই রত্নাবলীর অভিনয়ের জন্য দশ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। অভিনেতাদের সকলেই সেকালেই ইংরেজিশিক্ষিত বাঙ্গালী ছিলেন। এদের সুন্দর অভিনয়ে অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছিল। বিশেষ সমকালীন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় এই নাটকে বিদূষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। অভিনয়ে উচ্চ প্রতিভার জন্য তিনি বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ‘ গ্যারিক’ নামে পরিচিত হন। অফুরন্ত ব্যঙ্গরহস্যের পরিবেশনে বিদূষকের ভূমিকাটিকে তিনি অপূর্ব জীবন্ত করে তুলেছিলেন। এই অভিনয় অনুষ্ঠানে রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহও একটি চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রথম রাত্রির অভিনয়ে বহু দেশী-বিদেশী গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সপরিবারে বাংলার লেফটেন্যন্ট গভর্নর স্যার্ ফ্রেডারিক হ্যালিডে দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন। গভর্নরও কেশববাবুর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই 'রত্নাবলী' নাটকের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ৩১শে জুলাই, শনিবার। এই নাটকের অভিনয় ছয় সাতবার হয়েছিল। ইংরেজ দর্শকদের সুবিধার জন্য নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়েছিল। এই অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।


‘রত্নাবলী’র পর বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত হয়েছিল মাইকেল মধুসূদনের 'শর্মিষ্ঠা' নাটক ১৮৫৮ সালের ৩রা সেপেটম্বর। এই ‘শর্মিষ্ঠা' নাটকের রচনাও অভিনয় অনুষ্ঠানের নেপথ্য কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ। ‘রত্নাবলী' নাটকের ইংরেজি অনুবাদকরণের ব্যাপারেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত বন্ধু গৌরদাস বসাকের মাধ্যমে (ইনি প্রথম থেকেই নাট্যশালার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন) বেলগাছিয়া নাট্যশালার সঙ্গে পরিচিত হন ও যুক্ত হন। 'রত্নাবলী' নাটকের অভিনয় দেখেই তাঁর মনে বাংলা নাটক রচনার ইচ্ছা জাগে। ভাল বাংলা নাটকের অভাব দেখেই তাঁর এই ইচ্ছা জাগে। একথা তিনি ‘শর্মিষ্ঠা' নাটকের ভূমিকায় জানিয়েছিলেন—

“অলীক কুনাট্য রঙ্গে    মজে লোক রাঢ় বঙ্গে

দেখে শুনে প্রাণে নাহি সয়”।

মধুসুদনের এই ইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির ফলই 'শর্মিষ্ঠা' নাটক।


বেলগাছিয়া নাট্যশালয় ‘শর্মিষ্ঠা'র প্রথম অভিনয় হয় ১৮৫৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর। 'রত্নাবলী' নাটকের মতই ইংরেজ দর্শকদের সুবিধার জন্য এই নাটকেরও ইংরেজি অনুবাদ করেন নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন নিজেই। শর্মিষ্ঠা নাটক রচনা এবং অভিনয় বাংলা নাটকের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা, কারণ এই নাটকের রচনার মাধ্যমেই আধুনিক বাংলা নাটকের মুক্তি ঘটেছিল এবং এই ব্যাপারে বেলগাছিয়া নাট্যশালাও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শর্মিষ্ঠা' নাটকের প্রথম অভিনয় অত্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। এই সম্পর্কে নাট্যকার মধুসূদন তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন, "When Sarmistha was acted at Belgachia, the impression it created was very indescribable. Even the least romantic spectator was charmed by the character of Sarmistha and shed tear with her." 'শর্মিষ্ঠা' নাটকের ষষ্ঠ বা শেষ অভিনয় হয় ১৮৫৯ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর। 'শর্মিষ্ঠা'র পর বেলগাছিয়া নাট্যশালায় আর কোন অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় নি। ১৮৬১ সালের ২৯শে মার্চ রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের মৃত্যুতে এই নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যায়।


১৮৫৮ সালের জুলাই থেকে ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বর, এই অল্পকালের স্থায়িত্বের মধ্যেই বেলগাছিয়া নাট্যশালা এদেশীয় নাট্যশালা ও নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে যে শক্তি ও উৎসাহ সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছিল তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে (১৮৮২) যে জাতীয় নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছিল, সম্ভবত তার প্রস্তুতি সুরু হয়েছিল এই বেলগাছিয়া নাট্যশালা থেকে। মধুসূদনের বন্ধু গৌরদাস বসাক এই নাট্যশালার অবদান সম্পর্কে বলেছেন, “এই নাট্যশালা এদেশীয় সৌখিন নাট্যশালার ইতিহাসে অতুলনীয় সাফল্য অর্জন করেছিল।”