"বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে 'অরণ্যের অধিকার' এক বিশেষ সৃষ্টি"— আলোচনা করো।

বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে বাংলা উপন্যাসের প্রবাহে এক স্বতন্ত্র স্বাদের কথাসাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কেউ কেউ এই সাহিত্যধারাকে বলেছেন 'সৎসাহিত্যের ধারা, কেউ কেউ বলেছেন অন্য ধারার উপন্যাস। বাণিজ্যমুখী উপন্যাসের পসার বাজার কেন্দ্রিক তা Market-mechanism'-এর দ্বারা চিহ্নিত। যৌনতাগন্ধী, রোমান্সমুখ্য আখ্যানের রমণীয় আকর্ষণই এই ধরনের উপন্যাসের রসবৈশিষ্ট্য। অন্যধারায় আছে সমাজ ও জীবন সম্পর্কে দায়বদ্ধ, বক্তব্যমুখী এক ধরনের সদর্থক চিন্তার বাণীবাহী প্রগতিসাহিত্যের ধারা। এই ধারার উপন্যাসে বাস্তবনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী, সমাজনীতি, অর্থনীতির মধ্য দিয়ে লোকাচার, লোকসংস্কৃতি লৌকিক জীবনাশ্রয়ী এক দলিলীকরণের উপন্যাস। ইতিহাসের মুখ্য কাজই হচ্ছে একই সঙ্গে বাইরের গোলমাল, সংগ্রাম ও সমারোহের আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জনবৃত্তকে অন্বেষণ করা, অর্থ ও তাৎপর্য দেওয়া— ইতিহাসসচেতন চর্চায় এই তাৎপর্যদান দ্বিতীয় ধারার উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার' এই দ্বিতীয় ধারার উপন্যাসের প্রতিভূ।


‘অরণ্যের অধিকার’ ব্যতিক্রমী উপন্যাস। এই উপন্যাস নিপীড়িত শোষিত এক জনবৃত্তের সংগ্রাম ও মুক্তির কাহিনী। 'শিল্পের জন্য শিল্প,' বলতে যে উপন্যাস বোঝায়, সেই উপন্যাসের বিপরীত ধারায় এই উপন্যাসের অবস্থান। বক্তব্যমুখী উপন্যাস বলেই এই উপন্যাসের "social content" ঋজু ও বিশিষ্ট। “আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস চেতনা এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় যা বর্তমান সময়কে বুঝতে সাহায্য করবে। শিল্পের জন্য শিল্প করার ক্ষমতা বা সাধ আমার ছিল না, করিনি। যেহেতু অন্য কিছু কাজের কাজ করতে শিখিনি, তাই পারি না পারি লিখে গেছি। অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্যও যথার্থ দলিলীকরণকেই যোগ্যতম মাধ্যম মনে করেছি।” উপন্যাস বিনোদন নয়, উপন্যাস সমাজচেতনার রূপায়ণ। এই ধারার উপন্যাস তারাশঙ্কর-মানিক সতীনাথ থেকে মুখ্য হয়ে উঠেছে। এবং এই সমাজভাবনামূলক উপন্যাসের ধারায় ‘অরণ্যের অধিকার এ রূপ পেয়েছে। আদিবাসী সমাজ হিন্দুসমাজে অত্যন্ত অবহেলিত ও নিপীড়িত সম্প্রদায়। তাদের শোষিত জীবনের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের পতাকা তুলেছে, লেখিকা তাকেই তাঁর চিন্তায় মুখ্য স্থান দিয়েছেন। “আদিবাসী সমাজ নিয়ে যে যন্ত্রণাবোধ দীর্ঘকাল আমায় দগ্ধ করে, সে দহন আমার সঙ্গে চিতা অবধি যাবে। ভেবেছিলাম, কোন এক শেষ কথায় পৌঁছলাম, কিন্তু নানা গোষ্ঠী, ভাষা, উন্নত সংস্কৃতি ও সমাজ আইনে বিভক্ত। আদি সভ্যতার শেষ স্মরণচিহ্ন এক বিশাল জনজাতির বিষয়ের শেষ নেই, শেষ কথা বলবার অধিকারী কে? আমি তো নই।”— মূলস্রোতের মানুষদের সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে এ এক আলাদা সমাজব্যবস্থা ও জীবনধারা। লেখিকা যে এই বিষয়বস্তুকে তাঁর উপন্যাসে রূপ দিয়েছে, তাই বাংলা সাহিত্যে নতুনত্বের ধারা। ইতিহাসের লোকবৃত্ত থেকে গণ-আকাঙ্ক্ষার পৃথিবীতে তিনি কেমনভাবে পৌঁছাচ্ছেন, মহাশ্বেতা দেবীর সত্তর দশকের উপন্যাসে তার পরিচয় -পাওয়া যায়।


‘অরণ্যের অধিকার’ একদিকে আঞ্চলিক উপন্যাস, অন্যদিকে সার্বভৌম আবেদন সমৃদ্ধ উপন্যাস। বীরসা মুন্ডা তাঁর উপন্যাসের নায়ক। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা মুণ্ডার নাম চিরস্মরণীয়। বীরসা মুণ্ডা পরিচালিত মুণ্ডা জাগরণ 'ফিউড্যাল সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে 'উলগুলান'। মহাশ্বেতা দেবী এই উপন্যাসে জীবনের প্রগতির কথা বর্ণনা করেছেন। 'অরণ্যের অধিকার' ১৯৭৫ সালে 'বেতার জগৎ' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সুরেশ সিং রচিত "Dust storm and Hanging Mist" বইটির কাছে লেখিকা বিশেষভাবে ঋণী। তথ্যভিত্তিক এই গ্রন্থটি লেখিকার সমাজসম্পর্কিত তথ্য ও ঐতিহাসিকতার ভিত্তিভূমি। এই উপন্যাস তাই রিপোর্টাজধর্মী' রচনা বলে সমালোচিত হলেও আসলে এই উপন্যাস সংগ্রামী মানুষের কাহিনী। 'হাজার চুরাশির মা' বা 'অরণ্যের অধিকার' বাংলা উপন্যাসের এই বাস্তবধর্মী ধারার পরিচয় বহন করেছে। সাহিত্যের ইতিহাসের ভৌগোলিক বেষ্টনী যেমন—স্বতন্ত্র ছোটনাগপুর-পালামৌ-সিংভূম প্রভৃতি অঞ্চলের আচার আচরণ, ধর্ম ও জীবনাবসানের সনিষ্ট বর্ণনা যেমন উপন্যাসের আঞ্চলিক গুণকে প্রকাশ করেছে, তেমনি একটি জনবৃত্তের আখ্যানকেও পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে। তাঁকে 'কল্পনাগুণহীন রিপোর্টাজধর্মী' লেখিকা বলা অর্ধসত্য আসলে তাঁর উপন্যাস বাস্তববাদী ধারার প্রতিনিধি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিহ্ন', 'চিত্তামণি' বা পূর্বযুগের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা' এই সমাজকথা চিত্রের প্রতিনিধি। মহাশ্বেতা দেবী সমালোচিত হয়েছেন “বটতলার রোমান্স লেখিকা” হিসাবে। কিন্তু 'নটী', 'ঝাঁসীর রানী' থেকে এই সিদ্ধান্ত করা চলে না। তিনি শীঘ্রই এই পথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। মহাশ্বেতা দেবী বিবর্তিত হলেন। ইতিহাসের রোমান্স থেকে তিনি চলে এলেন ইতিহাসের জিজ্ঞাসায়। 'হাজার চুরাশির মা' (১৯৭৪) থেকে এই প্রবণতার সূত্রপাত। 'অরণ্যের অধিকার’-এ (১৯৭৭) এই প্রবণতার পুষ্টি। 'হাজার চুরাশির মা'র ব্রতী চ্যাটার্জীর মৃত্যু সমাজের পথে একটি বিরাট প্রশ্নস্বরূপ। এই প্রশ্নমুখীনতা নতুন ধারার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য।


মধ্যবিত্ত-লিখিত মধ্যবিত্ত সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা বাংলা সাহিত্যে এযাবৎ কথাসাহিত্যের প্রধান সুর। বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের লেখায় যে মধ্যবিত্ত দৃষ্টিভঙ্গীর সন্ধান পাওয়া যায়, তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ মানিকের লেখায় তার অধঃগতিত রূপ দেখা যায়। কল্লোল যুগের কথাসাহিত্যে নীচুতলার মানুষের যে পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে, শৈলজানন্দ-প্রেমেন্দ্র মিত্র- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় সেই ধারায় শোষিত নিম্নকোটির মানুষের দুঃখ দারিদ্র্য ও বঞ্চনার কথা লিপিবদ্ধ আছে। তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম', 'হাসুলী বাঁকের উপকথা’ বা ‘কবি'—সমাজের এক সম্প্রদায় বিশেষের আখ্যান। বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালীর' অপু-সর্বজয়া হরিহর দারিদ্র্য লাঞ্ছিত নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের দুঃখের পাঁচালী। এই জীবনের মধ্যেও স্বপ্ন দেখার সুযোগ কত গভীর, কত নিবিড় সে কথা বিভূতিভূষণের রোমান্টিক চেতনার পরিচয় অব্যাহত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা', 'চিহ্ন’, ‘খতিয়ান', 'চিত্তামণি', 'সোনার চেয়ে দামী'.....ক্রমবিবর্তনের পথ বেয়ে বাঙালী সমাজের দুঃখ দুর্দশা সংগ্রাম ও প্রতিরোধের কাহিনী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী', 'শিল্পী', 'প্রাগৈতিহাসিক' দুঃখবিড়ম্বিত জীবনের নানা জিজ্ঞাসার চিত্র। কল্লোল যুগে শৈলজানন্দের 'কয়লাকুঠি'র গল্পগুলিও অচিন্ত্যকুমারের ‘বেদে’-তে নিম্নশ্রেণির জীবনের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’, ‘জাগরী’ প্রভৃতি উপন্যাসে অন্ত্যজ-ব্রাত্য সমাজের চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। একজন সমালোচক লিখেছেন, "সূচনাকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় দেড়শো বছরের বাংলা উপন্যাস সাহিত্য কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে আদ্যস্ত মধ্যবিত্তের দ্বারা সৃষ্ট মধ্যবিত্তের শিক্ষিত খণ্ডাংশের জন্য এক সুলভ বিনোদন। দেশ কাল পরিস্থিতির বিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এই মধ্যবিত্ততার নির্যাস বদেলেছে।” (অরূপকুমার দাস—অরণ্যের অধিকার, ইতিহাসের কণ্ঠস্বর)। মহাশ্বেতার দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিবাদী ও ব্যতিক্রমী। প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের যুগযুগাত নিপীড়িত মানুষের নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার শেষে মুক্তির জন্য 'উলগুলান'-এর আহ্বান 'অরণ্যের অধিকার'-এর বৈশিষ্ট্য। মহাশ্বেতা দেবীর সমাজসচেতন আখ্যানে এই সমাজ জিজ্ঞাসা ও বিদ্রোহ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। মহাশ্বেতা দেবী সংবেদী লেখিকা। নিপীড়িত মানু দুঃখকষ্টই তাঁকে সংবেদী ও দরদী লেখকে পরিণত করেছে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত নূতনতর রূপে ও সংগ্রামে বেঁচে থাকা মানুষরাই তার লেখার উপজীব্য। এরা বাস করে বেশিরভাগ ছোটনাগপুর অঞ্চলের এখানে-সেখানে। এইসব হতমান, নতশির, অপমানিত ও কালান্তরব্যাপী লাঞ্ছিত মানুষরাই মহাশ্বেতাকে সংবেদী লেখক করে তুলেছে। এদের জীবনকে লেখার মাত্রান্তরিত করাই মহাশ্বেতার মানবিক তথা সৃষ্টিশীলতার দায়বদ্ধতার মাপকাঠি হয়ে গেছে।” -(তদেব)।


‘অরণ্যের অধিকার’-এর মূল মন্ত্র 'উলগুলান', শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। “উলগুলানের শেষ নেই, ভগবানের শেষ নেই”—এই অনিঃশেষ 'উলগুলানের' আহ্বান মহাশ্বেতার উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বীরসা মুণ্ডা এই উপন্যাসের নায়ক। বীরসা চরিত্রের অসাধারণত্ব ও মহিমা এই উপন্যাসে দীপ্তভাবে ফুটে উঠেছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেছেন তিনি। গণজীবনের সঙ্গে যোগসূত্র সৃষ্টি করে মহাশ্বেতা দেবী এই উপন্যাসে গণজীবন-চিত্রকে পরিস্ফুট করে তুলেছেন। মহাশ্বেতা দেবী সত্তরোত্তর বাঙলার অগ্নিগর্ভ সমাজের বাণী ও দায়বদ্ধতাকে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। ভারতের জনবৃত্তের ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের মত তুলে ধরায় মহাশ্বেতা দেবী 'জনগণের সাহিত্য' সৃষ্টি করেছেন। মহাশ্বেতা দেবীর গণবৃত্তের কাহিনীতে রাজনৈতিক চেতনা ও ইতিহাসের চেতনাকে উজ্জ্বল করে উপস্থাপিত করেছেন। বাংলা উপন্যাসের ধারায় 'অরণ্যের অধিকার' এক ব্যতিক্রমী উপন্যাস।