‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' প্রহসনে ফতেমা বিবি চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।

সমালোচ্য প্রহসনে ফতেমা বিবি বেশ স্বাভাবিক চরিত্র। ভক্তপ্রসাদের কুপ্রস্তাব জানা মাত্রই সে তার স্বামীর গোচরে এনেছে। সে ছেলেমানুষ, তাই তার একমাত্র অবলম্বনের কাছে সে সভয়ে সব কিছু ব্যক্ত করেছে, তারপর হানিফের অনুরোধে সে রাতের বেলা ভাঙা শিবমন্দিরে যেতে রাজি হয়েছে। তার ঐ বয়সে এ জাতীয় কমবয়সীসুলভ কৌতুকের প্রতি আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু অন্ধকার রাত্রে বনের মধ্যে প্রবেশ করে এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে উঠেছে- “যে আঁদার্ বড় ডর লাগে। এই বনের মদ্দি মোরা দুটিতি কেমন করে থাক্‌পো।” শেষ পর্যন্ত সে পুঁটির শরণাপন্ন হয়েছে। এরপর ভক্তপ্রসাদের সামনে এসে সব কৌতুক ভুলে গেছে; একদিকে মান-ইজ্জতের ভয়, অন্যদিকে স্বামীর চিন্তা তাকে উৎভ্রান্ত করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত পুঁটিকে বলেছে— “পুঁটি দিদি, মুই তোর পায়ে সেলাম করি, তুই মোকে হেতা থেকে নিয়ে চল।” ফতেমার বয়স ও সামাজিক স্তর অনুযায়ী নাট্যকার তার চরিত্রটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 


তবে সমালোচক ক্ষেত্রগুপ্ত মনে করেন - “ফতেমার চরিত্রে কিছু চাতুর্য আছে। সাহসেরও অভাব নেই, সে অসৎ নয়। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে লম্পট জমিদারকে ভুলিয়ে দেহদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা কুলবধূর পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়। ফতেমা সাহসে ও বুদ্ধিতে একেবারে মামুলি নয়। কিন্তু মধুসূদন জানতেন স্বাভাবিকতার সীমারেখা খুব কাছেই। যতই তার সাহস হোক, ভাঙ্গা শিবমন্দিরে অন্ধকারে লম্পটের আগমনে তার আত্মরক্ষা ও সম্মানরক্ষার আকুলতা তাই তিনি যেন তীব্রভাবেই উপস্থিত করেছেন।”


ফতেমার চরিত্র চিত্রণে মধুসূদন যথেষ্ট কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। হানিফ গাজীর যোগ্য বিবি। দরিদ্র হলেও সম্মান ও ধর্মরক্ষাই তাঁর কাছে বড়। অর্থের কাছে নিজেকে সে বিক্রয় করেনি। ফতেমার চরিত্র 'নীলদর্পণে'র ক্ষেত্রমণির পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফতেমার চরিত্র বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে সমালোচক অশোককুমার মিশ্র তাঁর 'বাংলা প্রহসনের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন— “ফতেমা বিবি হানিফের মত হঠকারী নয়, দক্ষ অভিনেত্রী সে। সে হানিফকে শান্ত সংযত থাকার পরামর্শ দেয় আখেরে লাভের জন্য। মূলত ফতেমার সহায়তায় এবং বাচস্পতির বুদ্ধি কৌশলেই হানিফ এক দিকে ভক্তপ্রসাদের উপর তার ক্রোধের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে অন্যদিকে অর্থের দিক থেকেও আখেরে লাভবান হয়েছে।”


সমালোচক অজিতকুমার ঘোষের মতে, “হানিফ ও ফতিমা চরিত্র দুটির মধ্যে কৃষক জীবনের বাস্তবতা, সমস্যা পীড়িত রূপ, আদিম সরলতা প্রভৃতি আশ্চর্য নিপুণতার সঙ্গে অঙ্কিত করা হয়েছে। তবে চরিত্রদুটির আচরণে কিছু কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে। হানিফের মতো সরল ও গোঁয়ার কৃষকের পক্ষে শেষ দৃশ্যে ভক্তপ্রসাদের সঙ্গে চতুর রসিকতা করা অস্বাভাবিক। ফতেমার পক্ষে ভক্তপ্রসাদের মত দোর্দণ্ড জমিদারকে জব্দ করবার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করা মোটেই বিশ্বাস্য মনে হয় না।”


ফাতেমার মধ্যে মাইকেল নায়িকাদের একাধিক গুণ অর্পণ করেছেন—তার সহজাত আবেদন, লাস্যময়তা, বাকপটুতা, intrigue-এর প্রতি বিশ্বস্ততা একটি বিশেষ দেশজ বাঙালী গুণ হিসাবে যুক্ত হয়েছে। ফাতেমাকে কেন্দ্র করেই “বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ” কাহিনী গতিময় হয়েছে। একটি মেয়ের কর্মকাণ্ডকে হাস্যরসের নাটকে এতখানি প্রাধান্য এর আগে কেউ দিয়েছেন বলে মনে হয় না।