'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' গ্রহসনের নাট্যাঙ্গিকের পরিচয় দাও।

'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' এর নাট্যাঙ্গিক লক্ষ্য গোচর। 'একেই কি বলে সভ্যতা’য় গল্প গঠনের ত্রুটি ছিল কেননা নক্সাধর্মের কাহিনী গ্রন্থনকে ব্যহত করেছিল। কিন্তু ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁতে মধুসূদন সে বিচ্যুতি অতিক্রম করে একটি পূর্ণদেহ গল্প গঠনে সাফল্য অর্জন করেছেন।


আলোচ্য প্রহসনের গল্পটি জটিল নয়, প্রহসনের গল্পে জটিলতা প্রত্যাশিতও নয়। জীবনকে নানাদিক থেকে সম্পূর্ণ দেখবার দাবি প্রহসনে নেই। তার দৃষ্টি বিশেষভাবে একমুখী। তাই গল্পে জটিলতা আনবার চেষ্টা করলে তার পক্ষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা। ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'-এর কাহিনী বৃদ্ধ জমিদার ভক্তপ্রসাদের কামুক অনাচারের কাহিনী। বিবাহিতা অথবা কুমারী, হিন্দু অথবা মুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের রেহাই নেই তার লোভের কবল থেকে। ভক্তপ্রসাদের চরিত্রের এই সাধারণ পরিচয় কিন্তু কাহিনী নয়। হানিফের তরুণী স্ত্রী ফতেমাকে হস্তগত করা তার জীবনের বহু সংখ্যক লাম্পট্য কাহিনীর অন্যতম কাহিনী মাত্র। কিন্তু ঐ ঘটনাটি একতম হয়ে ওঠায় এখানে তা গল্পে দানা বেঁধে ন প্রহসনের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে অর্থ পিশাচ জমিদার ভক্তপ্রসাদ অল্প খাজনা নিয়ে হানিফকে সম্পত্তি ছেড়ে দিতে রাজী হল। কারণ অনাবৃষ্টি ও হানিফের কঠিন দারিদ্র্য নয়, হানিফের স্ত্রী ফতেমার সৌন্দর্য্য— তাকে ভোগ করবার বাসনা। গদাধর এবং তার পিসি পুঁটি এই ব্যবস্থা করবার জন্য নিযুক্ত হল।


দ্বিতীয় দৃশ্যে ফতেমাকে বশ করবার জন্য পুঁটির চেষ্টা, অন্যদিকে হানিফ পুঁটি এবং বাচস্পতির গোপনে পরামর্শ শেষে ফতেমার সম্মতি দান। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে বৃদ্ধ লম্পট ভক্তপ্রসাদের সন্ধ্যা সমাগমের প্রতীক্ষা চমৎকার ভাবে চিত্রিত হয়েছে। দ্বিতীয় দৃশ্যে শিব মন্দিরে ভক্তপ্রসাদের ফতেমার উপরে বলৎকারের চেষ্টা করায় ছদ্মবেশী হানিফের হাতে প্রহৃত হয়। পূর্ব পরামর্শ মত বাচস্পতি এবং হানিফ ভক্তপ্রসাদকে ঐ অবস্থায় আবিষ্কার করে এবং এই সুযোগে বেশ কিছু অর্থ আদায় করে নেয়। ভক্তপ্রসাদ এতকাল গোপনে যে সব অপকর্ম করে চলেছিল তার আবরণ খসে পড়লো। গুরু পাপে তার লঘু দণ্ড হল। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হল লোকটার লাম্পট্য একটা বড় রকমের আঘাত খেল, তার মুখোস আর অক্ষত রইল না। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র মত ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ মূলত চিত্র সমষ্টি না হয়ে, হয়ে উঠল গল্প, হয়ে উঠল প্রহসন।


প্রথমত, ভক্তপ্রসাদের নিত্যকার লাম্পট্যের কাহিনীর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র মাত্র এখানে রূপায়িত হয় নি। ফতেমাকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল তা তার লম্পট-জীবনের একটির মধ্যে বহু নৈশ অভিযানের মধ্যে মনে করে রাখবার মতো বিশিষ্টতম অভিযান।


দ্বিতীয়ত, ভক্তপ্ৰসাদ হানিফ-ফতেমার গল্পটির ভিত্তিতে যে বিশেষ সমস্যা আছে তা শুধুমাত্র সামাজিক নয়, ব্যক্তিগত চরিত্রের টানাপোড়েনে তা তৈরি। একটি কেন্দ্রিয় সমস্যা যা দুই বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বের রূপ ধরে দেখা দেয়, তাই-ই কোনো কাহিনীর ভিত্তি তৈরি করতে পারে। এখানে প্রকৃত পক্ষে বোঝা যায় সমস্যার ঐক্য এবং “সে ঐক্য ঘটনায় প্রতিফলিত একটি বিশিষ্ট ঘটনার সমস্যা নয়, একটা যুগের সমস্যা, একটা জাতীয় সমস্যা বা একটা ব্যক্তির সামগ্রিক জীবন সমস্যায় ঘনপিনদ্ধ ঐক্য থাকে না। বিচিত্র ঘটনা সন্ধির সমবায়ের মধ্য দিয়ে সেই সব সমস্যা আত্মপ্রকাশ করে। নাটকীয় কাহিনীর ভিত্তিতে যে সমস্যা তাকে একনিষ্ঠ হতে হয়, একটি সমস্যাসঙ্কুল ঘটনার আদ্যস্ত শৃঙ্খলে বদ্ধ হলেই তা পূর্ণদেহ ঐক্যবদ্ধ গল্প হয়ে ওঠে। এই সমস্যা দ্বন্দ্বের রূপ ধরে দেখা দেয়। নাটকের কাহিনী যুগপৎ একনিষ্ঠ এবং দ্বন্দ্বমূল। 'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'তে এই দুটি লক্ষণই বর্তমান। ভক্তপ্রসাদ এবং হানিফের যে সংঘাত-এর কাহিনী কেন্দ্রে তা শুধুমাত্র জমিদার ও প্রজাশক্তির মধ্যের দ্বন্দ্ব হলে একনিষ্ঠ গল্প গঠিত হতে পারতো না। কামুক ভক্তপ্রসাদের যমদূতের মত শক্তিশালী হানিফের স্ত্রীকে ভোগ করবার চেষ্টা একটি ঘটনাগত সমস্যার সৃষ্টি করেছে—এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই ব্যক্তির মধ্যে সংঘাত ঘটেছে। এই সমস্যা তথা দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'-র কাহিনীটি আবর্তিত।”– [ নাট্যকার মধুসূদন—ক্ষেত্র গুপ্ত ।]


“তরঙ্গ চাঞ্চল্য ঘটনার গল্পে রূপান্তর অন্যতম লক্ষণ। ভক্তপ্রসাদ ফতেমা-হানিফকে কেন্দ্র করে যে দ্বন্দ্ব সমস্যার সৃষ্টি তার বিকাশ একে আদৌ নিস্তরঙ্গ প্রাত্যহিকতায় সীমাবদ্ধ করে রাখেনি। লম্পট জমিদারের ভোগ আরও পাঁচটা ক্ষেত্রে যে পথ ধরে মসৃণ ভাবে চলেছে এখানে তা প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে আবর্ত ও কলরোলের সৃষ্টি করেছে।


"বাংলাদেশে ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ'-ই প্রথম প্রহসন হয়েও পূর্ণাঙ্গ গল্প হয়ে উঠল।”