“পৃথিবীর বহু ঊর্ধ্বে, স্তরে স্তরে সাজানো ভয়ের তলে প্রোথিত পৃথিবীর ঊর্ধ্বে একটা জঙ্গলাকীর্ণ সাধারণ টিলার শীর্ষে শশী হঠাৎ হারাইয়া গিয়াছে।”—উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

“জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে কলকাতার অনামী রহস্য।" ‘কলকাতার অনামী রহস্য' বলতে কি বুঝিয়েছেন তা ব্যাখ্যা করো।

পুরুষের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের কশাঘাতে জর্জরিত হয় নারী ও পরিবেশ। নারী সম্ভোগের দুর্নিবার তৃয়ার মধ্যে শেষ পর্যন্ত পরাজয়ের সুর ধ্বনিত হয়। নন্দলাল-বিন্দু আখ্যানের মধ্যে এই অমিতাচারী জীবনের এক বিচিত্ররূপ পরিস্ফুট হয়েছে। ব্যবসাসূত্রে হঠাৎ নন্দলাল গাওদিয়ায় এসে পড়ে। পাটের কারবারে কেনাবেচার প্রয়োজনে মধ্যস্থ গ্রাম হয় গাওদিয়া গ্রাম। গোপালদাসের মতো দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী যে তাকে আশ্রয় দেবে, তা স্বাভাবিক। গ্রামের মানুষের উত্তেজিত দাবীতে গোপাল-কন্যা বিন্দুকে নন্দলালের সঙ্গে বিয়ে দিতে সাহায্য করে। সামাজিক গণ্ডগোলের মধ্য দিয়া নন্দলাল স্ত্রীক কলকাতায় চলে আসে। কিন্তু গাওদিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তার আর থাকে না। গাওদিয়ার বিন্দু এক অদৃশ্য নিয়তির হাতছানিতে যে জীবনে তলিয়ে যায়, তার কোনো নামগোত্র পরিচয় ছিল না। কলকাতায় এসে শশী দেখেছে বিন্দুর ঘরে আর্থিক প্রাচুর্য। কিন্তু নন্দলাল তার সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করেছে। তাকে “গছাইয়া দেওয়া বৌ" বলেছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে প্রশ্ন হয়ে উঠে আসে। যে নন্দলাল তাকে ত্যাগ করেনি। তার জন্য আলাদা বাড়ি করে দিয়েছেন আসবাবের শেষ নেই। বিলাসিতার আয়োজনের মধ্যে বিন্দুর হাহাকার এক অপার রহস্য। নন্দলালের আসার আগে বিন্দু প্রসাধনে ব্যস্ত হয়। দামী আসবাবের পণ্যসম্ভারের মধ্যে সেও অতৃপ্ত আত্মা। শশী কলকাতায় গিয়ে দেখেছে বিন্দু অসামাজিক নয়, কিন্তু রহস্যময়ী। এই রহস্যময়তা বিন্দুকে আচ্ছন্ন করেছে। কলকাতার এ-সব নিষিদ্ধ পাড়ার রহস্যের মধ্যে বসে বিন্দু সুখী কিনা সে জিজ্ঞাসা অবান্তর। গাওদিয়ায় কয়েকদিনের জন্য এলে বিন্দু সম্পর্কে সকলে জিজ্ঞাসু হয়, উত্তরে বিন্দু কাঁদে। তবুও বিপথগামী জীবনের জন্য বিন্দুর কান্নার শেষ নেই। নন্দলালের জন্য তার মন ব্যাকুল হয়। লেখকের জীবনরহস্য সন্ধানের এক অদ্ভুত কেন্দ্র বিন্দু চরিত্র। তার মতো নারীর জীবন যে কী রহস্যে ঢাকা, গাওদিয়ার জীবন রহস্য যে কিভাবে বিন্দুকে গ্রাস করেছে, তার প্রমাণ বিন্দুর জীবন। জীবনের অপরিচিতলোকের বার্তা এইভাবে “জীবনের অজ্ঞাত রহস্য বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে বৈ কি?”



“শশী পৃথিবীতে আসিয়াছিল উলঙ্গ সন্ন্যাসী হইয়া, এখন সে ডাক্তার।"—উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

এ পৃথিবীতে মানুষ আসে কোনো সামাজিক পরিচয় নিয়ে নয়। সে আসে একা। তারপর সে একটি পরিবারে একটি সংসারের বুকে দেখা দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় মানব শিশুর জয়যাত্রা। নানা মানুষ নানা সম্পর্ক, নানা ঘটনাস্রোতের মধ্যে দিয়ে সে সংসারে বড় হয়, সে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র শশী গাওদিয়ার বুকে বড় হয়েছে, তারপর কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে সে ডাক্তার হয়েছে। ডাক্তার হয়ে সে গাওদিয়া গ্রামের জীবনধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। দুঃখী, আর্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে ত্রাতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেনদিদির জটিল অসুখের চিকিৎসায় তার ক্লান্তি নেই। সে পরোপকারী মানুষ, তাই তার চিকিৎসাবৃত্তির সঙ্গে ব্যবসাবৃত্তি যুক্ত নয়। সে পৃথিবীতে এসেছিল নিরালম্ব হয়ে, যেমন সব মানুষই আসে। কিন্তু তারপর সে তার সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। শশীর বাড়ীতে ছিল এক আশ্রিতা মেয়ে, পুত্রসন্তান জন্ম দেবার সময় যে আতুড় ঘর তৈরি হয়েছিল, তার স্বাস্থ্যনীতি ছিল দুর্বল। সাময়িকভাবে কম খরচে সস্তা বেড়ার ঘর তুলে আঁতুড় ঘর করা হত। শশীর বাড়িতে এই প্রথা এখনও চলে আসছে। এখন সে অবস্থাপন্ন, পসারওয়ালা ডাক্তার, কিন্তু তবু প্রাচীন স্বাস্থ্যনীতি এখনও অক্ষুণ্ণ। অন্য রোগীদের স্বাস্থ্য নীতির ফতোয়া দেবার সময় চিকিৎসক যে আদর্শগত আচরণ করে, নিজের বাড়িতে তা মেনে চলা হয় না। তাই এ কথা সত্য যে, সে জন্মেছে—উলঙ্গ সন্ন্যাসী হয়ে, কিন্তু এখন সে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। অন্যকে স্বাস্থ্যনীতি প্রচার করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই ব্যাপারটা জীবনের পক্ষে একটা তামাশা বিশেষ। ডাক্তারের স্বাস্থ্য চেতনা যে কত বহিরঙ্গ, তার মূল যে চেতনার গভীরে প্রোথিত নয়, তাই একথা বলা হয়েছে।



“পৃথিবীর বহু ঊর্ধ্বে, স্তরে স্তরে সাজানো ভয়ের তলে প্রোথিত পৃথিবীর ঊর্ধ্বে একটা জঙ্গলাকীর্ণ সাধারণ টিলার শীর্ষে শশী হঠাৎ হারাইয়া গিয়াছে।”—উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

হারু ঘোষের বাড়ির অদূরে তালবনের ধারে মাটির একটা টিলা আছে। ওটার পর তা জঙ্গলে সমাবৃত হয়ে যায়। এই তালবনের টিলার কাছে শশীর সঙ্গে কুসুমের দেখা হয়। কুসুমের রহস্যময়ী নারীসত্তার আলো-অন্ধকার এই রহস্যময় পরিবেশেই ফুটে ওঠে। এ টিলার ওপর উঠে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা শশীর জীবনে এক বড় ব্যাপার। শখ হিসেবে হয়তো এটা ছেলেমানুষী, কিন্তু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে যে শান্তি ও স্তব্ধতা সে উপলব্ধি করল, তা অভূতপূর্ব। কিন্তু সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নেমে এলে একধরনের শিহর-সঞ্চারী ভয় শশীকে আবিষ্ট করে। সে নিজেকে অসহায়, দুর্বল ও ভঙ্গুর বলে মনে করল। শশীর মনে প্রথমে যেমন স্তব্ধ প্রকৃতির অনুদান হিসেবে শান্তি নেমে এসেছিল, অন্য দিকে যখন ভয় ও ত্রাস তাকে গ্রাস করল, তখন তার মনে হল ঊর্ধ্বলোকের স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ভয় তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে এসেছে। শশী জঙ্গলাকীর্ণ টিলার শীর্ষে উঠে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শশীর সম্মুখে আছে অনন্ত ও সীমাহীন এক সত্তা, শশী যেন অনন্ত বিস্তারের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। এমন আশ্চর্য এক মিশ্র অবস্থার ভাবানুভূতি এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। এই অতীন্দ্রিয় অনুভূতি শশীর দার্শনিক মনের সম্পদ। হয়তো সব মানুষের মধ্যে যে শিশু লুকিয়ে থাকে, সেই শিশুর সন্ধানে এইসব ভাবানুভূতি জেগে ওঠে। মনের এই ধরনের সৃষ্টি ছাড়া অবাস্তবতা সব শিশুরই মনের বিষয়, শশীর হয়তো এই অবাস্তব কল্পনা তার মৌলিক কোনো কিছু ব্যাপার নয়। মনের এই পাগলামি, এই অসঙ্গত লীলাখেলা প্রকৃতির নিজস্ব জগতে এসে মাঝে মাঝে দেখা দেয়। টিলার শীর্ষে উঠে সূর্যাস্ত দেখার শখ তাকে এই সুযোগই এনে দিয়েছিল। শশী নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল অসীম শূন্যে। তাই সে এইসব অলীক ভাবানুভূতির সাক্ষাৎ করেছিল। এই অনুভূতি এত গভীর যে পরবর্তীকালেও তার মধ্যে এর রেশ বজায় ছিল।