"হালদারগোষ্ঠী” গল্পের নীলকণ্ঠ সার্থকনামা আমলা—এই মত সাপেক্ষে আলোচনা করো।

“হালদারগোষ্ঠী” গল্প অবলম্বনে নীলকণ্ঠ চরিত্রের পরিচয় দাও।


পুরাণের গল্প থেকে জানা যায় যে, দেবাসুরে সমুদ্রমন্থনের সময় অমৃতের পাশাপাশি অত্যন্ত শক্তিশালী বিষও উত্থিত হয়েছিল। বিশ্বজগতের কল্যাণে সেই বিষ আপন কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। সেই বিষ এতটাই তীব্র যে দেবাদিদেবের কণ্ঠেও সে বিষ ক্রিয়া করেছিল। তাই তিনি হয়েছিলেন নীলকণ্ঠ। সেই থেকে মহাদেবের নাম নীলকণ্ঠ হয়েছিল।


পুরাণের এই কাহিনি থেকে আমরা যে শিক্ষাটি লাভ করি, তা হল, যে কোনো শুভ ফলের পশ্চাতে কিছু না কিছু অকল্যাণকর কিছু থাকেই। সেই অকল্যাণকে নিঃশেষ করে তবেই শুভ ফলটি পাওয়া যেতে পারে। বর্তমান যুগে যেমন বিশ্বের বিপুল উন্নতির পাশাপাশি উত্থিত হচ্ছে দূষণের করাল থাবা।


আলোচ্য গল্পের মধ্যে দেখা যায়, হালদার পরিবারের আমলার নাম নীলকণ্ঠ। সে না হলে হালদার পরিবার অচল প্রায়। পরিবারের কর্তা মনোহরলাল তার ওপর সংসারের সমস্ত দিক সামলানোর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে সুখ ভোগ করেছেন। অন্যদিকে বিষয়সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে বদনামের ভাগী হচ্ছে নীলকণ্ঠ। গল্পানুসারে হালদার পরিবারের সমস্ত সুখ ও কল্যাণ বিধানের জন্যে সে যাবতীয় অকল্যাণের বিষ পান করে নেয়।


নাম অনুযায়ী চরিত্রটির যে শারীরিক বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নীলকণ্ঠ মনিবের কল্যাণকামী এবং সৎ। সেই সঙ্গে বিষয়সম্পত্তি রক্ষার সমস্ত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা নিজের মাথায় নিয়ে সে শীর্ণকায়। তার এই সততার বিষয়ে মনোহরলাল স্থির নিশ্চিত ছিলেন।


নীলকণ্ঠ চরিত্রটির মধ্যে দেখা যায়, মনিবের কল্যাণের জন্য সমস্ত কালিমা ও বদনাম নিজে হজম করার গুণ সর্বত ভাবে বিদ্যমান। নীলকণ্ঠ মনোহরলালের সম্পত্তি দেখাশোনা করে। টাকাপয়সার নিখুঁত হিসেব রাখে। প্রজারাও নানা কারণে যথেচ্ছাচার করতে পারে না বলে, তাকে চোর আখ্যা দিতে দ্বিধা করে না। এমন কি নীলকণ্ঠের কঠিন নজরদারির জন্যে বনোয়ারি তার স্ত্রীকে ইচ্ছে মতো গয়না গড়িয়ে দিতে পারে না। সেখানেও বাড়ির বড়োবাবু হয়ে তাকে অপেক্ষা করতে হয় বেতনভুক আমলা নীলকণ্ঠের মতের ওপরে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সে অসন্তুষ্ট। রাগ সামলাতে না পেরে বনোয়ারি যখন তাকে চোর, ছোটলোক ইত্যাদি বলে গালি দেয়, তখনও সে অম্লান বদনে নত মস্তকে সেই গালি শ্রবণ করে, শান্ত ভাবে আদেশ গ্রহণের জন্যে অপেক্ষা করে ইচ্ছে করলে সে মনোহরের কাছে বনোয়ারির নামে নালিশ করে কিম্বা চাকরি ছেড়ে দেবার হুমকি দেখিয়ে বনোয়ারিকে দমিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু তা না করে, সমস্ত বদনাম নীরবে সহ্য করে আপন কর্তব্য সমাধা করে গেছে।


নীলকণ্ঠর দৃষ্টি সব দিকেই ছিল। বিষয়রক্ষা থেকে শুরু করে বংশের বড় ছেলে বনোয়ারির সন্তান না হবার কারণে সে পুনরায় তার বিয়ে দেবার উদ্‌যোগ পর্যন্ত নেয়। সেই কারণে বনোয়ারির কাছে সে বাধাও পেয়েছিল। আবার বাড়ির গিন্নীর মৃত্যুর পর সে কর্তা মনোহরলালের জন্যেও পাত্রী দেখে বিবাহ স্থির করতে থাকে। তার নিঃস্বার্থ কর্মসাধনা অতুলনীয়।


আবার যখন নীলকণ্ঠর জেল হাজত হয়ে গেল। জেল থেকে ফিরে এসে হালদার বংশের মর্যাদা রক্ষা করার জন্যে সে মধুকৈবর্তকে টাকা পয়সা দিয়ে কাশী পাঠিয়ে দিয়ে, তার পরিবারের অন্যদের কেটে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে রটনা করিয়ে আত্ম ও হালদার গোষ্ঠীর মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে। কেন না, সে জানে প্রজাদের স্বমতে না আনলে জমিদারি চালানো অসম্ভব। আর তাদের স্বমতে আনতে হলে যে করেই হোক সম্ভ্রম আদায় করতেই হবে। তাই মধুকৈবর্তকে কাশী পাঠিয়ে দিলেও, স্ত্রী পুত্র সহ তাদের কেটে বস্তায় বেঁধে গঙ্গায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব রটনা করে দেয়। এ থেকে যেমন তার বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় তার বিষয় রক্ষা ও বিসম্বাদ এড়ানোর কৌশলী বুদ্ধির পরিচয়।


নীলকণ্ঠ হালদার পরিবারকে নিজের মতো করেই দেখতো। তাই বনোয়ারি তাকে হাজত বাস করালেও সে পরিবারকে ছেড়ে যায় নি। এমনকি কর্তার মৃত্যুর পরও সে এই পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে অনড় থেকে গেছে।


রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের মধ্যে দেখা যায়, প্রতিটি চরিত্রই সার্থকনামা। আলোচ্য গল্পটির মধ্যেও নীলকণ্ঠ নামক চরিত্রটি তার নাম সার্থক করেছে। পরিবারের ও প্রজাদের থেকে রকমারি অপযশ কুড়িয়েও সে নিজ কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছে। অকারণে অনেক গালিগালাজ সে নির্বিবাদে সহ্য করে হালদার পরিবারের কল্যাণ সাধন করে গেছে। তাই চরিত্রটিকে অনায়াসেই সার্থকনামা বলা যেতে পারে।