প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার'-এর প্রতিষ্ঠা ও অভিনয় অনুষ্ঠানের বিবরণ দাও। প্রসঙ্গত, সমকালে ও পরবর্তীকালে এই নাট্যশালার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।

প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার' ইংরেজি-শিক্ষিত নব্য বাঙ্গালি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রথম নাট্যশালা। ১৮৩১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এই নাট্যশালার উদ্বোধন হয়। বিদেশী গেরাসিম লেবেডেফের ‘বেঙ্গলী থিয়েটার'-এর প্রতিষ্ঠার (১৭৯৫) ৩৬ বৎসর পর বাঙ্গালী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সম্পূর্ণ বেশী নাট্যশালারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রসন্নকুমার ঠাকুররের এই হিন্দু থিয়েটার।


উনিশ শতকের প্রথমদিকে বাঙ্গালির সামাজিক জীবনের উপর বিগত শতাব্দীরই প্রভাব ছিল সম্পূর্ণ, অর্থাৎ বাঙ্গালীর সামাজিক আমোদ-প্রমোদ ও নাট্যকলা পরিবেশনের ব্যাপারে যাত্রা, পাঁচালি, কবি, হাফ্-আখড়াই প্রভৃতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে হিন্দু কলেজ (১৮১৭) এবং বিভিন্ন ইংরেজি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পর। এইসব প্রতিষ্ঠানে এদেশীয়দের ইংরেজি কাব্য ও নাটকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তাছাড়া ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠরত ছাত্র, যুবক ও অন্যান্য ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি নাট্যশালায় অভিনয়-অনুষ্ঠান দেখতে যেত। এর ফলে নাট্যকলা আস্বাদনের ক্ষেত্রে এদের রূচি ও পিপাসার পরিবর্তন ঘটেছিল, তখন পুরাতন যাত্রা, পাঁচালি তার তাদের ভালো লাগত না। তাই ইংরেজদের মত নাট্যশালা স্থাপন এবং নাটক অভিনয়ের ইচ্ছা ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।


এই সম্পর্কে সমকালীন সমাচার চন্দ্রিকা'র সম্পাদকীয় রচনাতে (১৮২৬) সুন্দর মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে : “এই বিস্তীর্ণ নগরে নগরবাসীদিগের উপকার ও উৎকর্ষের নিমিত্ত নানাবিধ জনহিতকর ও অভিনব প্রতিষ্ঠানের স্থাপন হইয়াছে। কিন্তু তাহাদের চিত্তবিনোদনের কোন ব্যবস্থা হয় নাই এবং ইংরেজ সম্প্রদায়ের মত তাহাদের আমোদ প্রমোদের কোন সাধারণ স্থান নাই।... সুতরাং ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা যাহাতে একত্র হইয়া ইংরেজদের মত শেয়ার গ্রহণ করিয়া একটি নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাহাতে এক একজন সর্বাধ্যক্ষের বেতনভোগী যোগ্য ব্যক্তি নিযুক্ত করিয়া এতদর্থে বিরচিত গীতি ও কাব্যের মাসে একবার নূতন করিয়া অভিনয় করেন, তাহা নিতান্তই বাঞ্ছনীয়।”


এই মনোভাবেরই ফল আধুনিক নাট্যশালা ও নাটক। এই প্রসঙ্গে একথাটি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে আধুনিক বাংলা নাটক ও নাট্যশালার উৎপত্তি হয়েছিল পাশ্চাত্ত্য আদর্শের প্রভাবে, মধ্যযুগীয় যাত্রা থেকে নয়। ইংরেজি নাট্যশালা ও নাটকাভিনয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এদেশীয় কোন কোন ধনী ব্যক্তি নিজ নিজ বাড়ীতে সখের নাট্যশালা স্থাপন ও অভিনয় অনুষ্ঠানে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। অবশ্য এই উৎসাহের মধ্যে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাবও ছিল বলেই মনে হয়।


প্রসন্নকুমার ঠাকুর ছিলেন বিরাট ধনী তিনি তাঁর নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়িতে 'হিন্দু থিয়েটার' নির্মাণ করান। নির্মাণকার্যে তিন মাসেরও কিছু বেশি সময় লেগেছিল। 'হিন্দু-থিয়েটার' এই নামকরণে সমকালীন জাতীয়তাবোধের পরিচয় নিহিত আছে। এদেশীয়দের উন্নতি মূলক সবকিছুরই নামকরণে ‘হিন্দু’ শব্দটি প্রয়োগ করা হত, যেমন 'হিন্দু কলেজ' ইত্যাদি। 'হিন্দু থিয়েটার' প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য প্রসন্ন কুমার ঠাকুর একটি সভা আহ্বান এবং কমিটি গঠন করেছিলেন। এই কমিটিতে ছিলেন প্রসন্ন কুমার নিজে এবং শ্রীকৃষেণ সিং, কিষেণ দত্ত, গঙ্গাচরণ সেন, মাধবচন্দ্র মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী ও নাট্যকার হরচন্দ্র ঘোষ।


‘হিন্দু থিয়েটার'-এর উদ্বোধন হয়েছিল ২৮শে ডিসেম্বর, ১৮৩১। বাঙ্গালীর দ্বারা স্থাপিত হলেও এখানে প্রথম অভিনয় হল সেক্সপীয়রের 'জুলিয়াস সিজার'-এর পঞ্চম অঙ্ক এবং উইলসন কৃত ভবভূতির 'উত্তররামচরিতে'র (প্রথম অঙ্ক) ইংরেজি অনুবাদ। ভাবনার বিষয় এই যে, ৩৬ বৎসর আগে একজন বিদেশী রূশ লেবেডেফ এদেশে নাট্যশালা স্থাপন করে ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ করে অভিনয় অনুষ্ঠান করেছিলেন, অথচ প্রসন্ন কুমার ঠাকুর তাঁর নাট্যশালায় যে অভিনয় অনুষ্ঠান করেছিলেন, সেগুলি ছিল ইংরেজি এবং সংস্কৃত নাটকের ইংরেজি অনুবাদ।


‘হিন্দু থিয়েটারে’ অভিনীত অনুষ্ঠানে বহু উচ্চপদস্থ ইংরেজ এবং ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত বাঙ্গালী উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু কলেজের গঙ্গাচরণ সেন, রামচন্দ্র মিত্র অভিনয়ে অংশ্রহণ করেন। দর্শকরূপে উপস্থিত ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, কর্নেল ইয়ং এবং রাধাকান্ত দেব।


প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠানের তিন মাস পর ১৮৩২ সালের ২৯ মার্চ এই থিয়েটারে ‘Nothing Superfluous' নামে একখানি ছোট ফার্সের অভিনয় হয়। অভিনয়ে পাত্র-পাত্রী, বেশভূষা এবং রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যপটসমূহ চমৎকার হয়েছিল। অবশ্য এই থিয়েটারে যে ইংরেজি নাটক অভিনীত হবে, তা’ কয়েক মাস পূর্বে প্রচারিত একটি বিজ্ঞপ্তি থেকেই জানা যায় : “এই নর্তনশালা ইংলন্ডীয়দের রীতি অনুসারে প্রস্তুত হইবেক এবং যে সকল নাটকের ক্রীড়া হইবে, সে সকল ইংলন্ডীয় ভাষায়।' (সমাচার দর্পণ, ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩১)।


সাধারণ মানুষের মধ্যে এই অভিনয় অনুষ্ঠান কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। কারণ অভিনীত হয়েছিল সেক্সপীয়র এবং ইংরেজিতে অনুদিত নাটক। এদেশের সাধারণ মানুষ ইংরেজি বোঝে না–দর্শক সমাবেশ হয়েছিল ইংরেজ অথবা ইংরেজি জানা শিক্ষিত বাঙালী। তাই এক বৎসরের মধ্যেই হিন্দু থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়।