'স্টীলের চঞ্চু' গল্পের রুনু চরিত্রের আলোচনা কর।

সাধন চট্টোপাধ্যায়ের 'স্টীলের চঞ্চ' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রুনু। রুনুর বিগত জীবন থেকে জানা যায় যে, সে পড়াশোনায় খুব ভাল এবং পিতার বাধ্য ছিল। নিজের চেষ্টায় বি.এস.সি. পাশ করার পর রেল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় পাশ করে সে রেলের অ্যাকাউন্ট ক্লার্কের চাকরি পেয়েছিল। কিন্তু তার পর যে কোনো কারণেই হোক সে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় থেকে সে নিত্য স্নান করতো না, বাবা ভূপতিকে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করে কথা বলতো। কোনো এক বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে জীবনের স্বাভাবিকতার বাইরে সে চলাফেরা করতে থাকে।


রুনুদের পলিটব্যুরো পাঁচ সদস্যের। কিন্তু তারা যে পদ্ধতিতে সমাজে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, তা কথার জালে যতই ফুলিয়ে বড় করে তোলা যাক না কেন আপাতদৃষ্টিতে অন্যের ঘাড় ভেঙে খাওয়া ও জীবন কাটানোর প্রবণতা ছাড়া আর কোনো শিক্ষা দেয় না। বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার সরিক হতে তারা পারবে না বলে রুনু অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেলে ডুব মারে। প্রেসিডেন্ট কোনো কাজ করেন কি না গল্পকার বলেন নি। তবে এই পচা সমাজকে রাতারাতি পাল্টে ফেলার জন্যে গোপনে তাদের মীটিং চলে আর সেই মীটিং-এ চা আসে বুর্জোয়া সমাজের পকেট মেরে। প্রেসিডেন্টের সংসারের জন্যে তাঁর রাতের বাজার করে দিয়ে যেতে বলেন অন্য দুই সদস্যকে। রোগীকে এরা হাসপাতালে পাঠাতে পারে না— সমাজের আর পাঁচজন্যের সেইরকম সুযোগ সুবিধা হয় না বলে। এই আদর্শ বয়ে নিয়ে চলেছে রুনু। সেই জন্যেই রুনু অসুস্থ — মানসিক রোগী। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েও তার অসুস্থতা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কেন না, তার মাথায় তার প্রেসিডেন্টের মতবাদ ছাড়া আর কিছুই স্থান পায় না।


আসলে রুনু নিতান্তই ভাল ছেলে। বাবার ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। ছাত্রজীবন থেকেই সে ‘গুডবয়'। ভাল নম্বর নিয়ে পরীক্ষায় পাশ করে নিজের চেষ্টাতেই রেলের চাকরি জোগাড় করে কলেজে কখনো কমনরুমে আড্ডা দেয় নি। অন্যদিকে তার মাথা খুব পরিস্কার, সায়েন্সের ছাত্র বলে সব কিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু যেহেতু তার মাথায় সমাজের সমস্যা, রাজনৈতিক ভাবনা ভূপতি কখনো ঢোকান নি। সমাজের সমস্যার কথা শুনে তাই তার ভূপতির ওপর বিরক্ত হওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে করা যায় না। হয়তো তার মনে এই প্রশ্নই এসেছিল যে, যার কথা এলাকার ইতিহাসে অবশ্যই আলোচিত হয়, তার ছেলে হয়ে তাকে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয় নি। এই জন্যে অবশ্যই ভূপতি দায়ী। তাই সমাজ সমস্যার কথা শোনার পরেই সে ভূপতিকে দায়ী করেছে। ভূপতির প্রতি বিরক্ত হয়েছে। যথাযোগ্য উত্তরসূরী ভূপতি তৈরি করতে পারে নি বলেই ভূপতির প্রতি নানা ভাবে তার তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা বর্ষণ করেছে। এবং সম্ভবত ভূপতির আদর্শেই সমাজ সেবার ধ্বজা বইতে প্রাণিত হয়ে সে বিপথে চালিত হয়েছে।


রুনু যে মনে প্রাণে প্রেসিডেন্টের আদর্শকে শিরোধার্য করে জীবনে চলতে চেয়েছে, এবং প্রতি দিনের প্রতিটি মুহূর্তে যে সে সমাজবিপ্লবের কথা ভেবে চলেছে তার অন্যতম প্রধান প্রমাণ তীক্ষ্ণ স্টীলের চঞ্চ -ধারী কাককে দেখতে পাওয়া। সমাজকে খুবলে খেতে যে কাক এসেছে, সেই কাক তারই বাড়ির সামনে একটা কঙ্কাল গাছের ডালে বসে তার চঞ্চুতে সান দিচ্ছে। এই দেখার মধ্যে দিয়ে তার সমাজ সংস্কারের সম্ভাবিত রূপটি ধরা পড়ে। কিন্তু ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবার ফলে রুনুকে মানসিক রোগগ্রস্থ হতে হয়েছিল।


রুনুকে মানসিক রোগী সাজিয়ে গল্পকারও যেন একটা পয়েন্টিলিস্টিক গোছের চিত্র অঙ্কনে প্রবৃত্ত হয়েছেন। মানসিক রোগী রুনুর আড়ালে থেকে যেন, কোনো এক বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি বিদ্রূপ করতে চেয়েছেন। তবে তার জন্যে অবশ্য রুনুকে কোনো অবাস্তবের মধ্যে ফেলেন নি। এমনকি গল্পের পরিনতিতে রুনুর মৃত্যু কিম্বা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার ঘটনাও তার মতো মানসিক রোগীর পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা।


সব মিলিয়ে, আলোচ্য গল্পের মধ্যে রুনুকে যে ভাবে পাওয়া যায়, তাতে সে আশৈশব ভাল ছেলে। স্কুল কলেজ জীবনে কোনো বাজে দাগ তার চরিত্রে লাগে নি। সমাজ সংস্কারের ভাবনায় ভাবিত হয়ে সে মানসিক রোগীতে পরিণত হলেও মানুষের জন্যে শুভাকাঙ্ক্ষাই ছিল তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।