“ওর রক্ত বড় প্রাচীন। বড় আদিম হয় কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীর রক্ত। ওর রক্তে অনাহার, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা। রূপকথায়, কিংবদন্তীতে, অলৌকিকে অবাস্তবে বিশ্বাস করে ওর রক্ত চিরকাল পালিয়ে বাঁচতে চায়। ছ'টি শব্দে ওর প্রাচীন রক্তের ছটি ফুলকি হয়ে জ্বলে উঠল।—ব্যাখ্যা করো।

"মুণ্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়ে থাকে।” -কথাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

মুণ্ডাদের জীবন দুঃখ জর্জরিত। যুগ যুগ ধরে মুণ্ডা সম্প্রদায় শোষিত, অত্যাচারিত হয়ে চলেছে। দুঃখ, দারিদ্র্য এত অসহনীয় যে অন্ন তাদের কাছে স্বপ্নের ব্যাপার। কারণ তাদের নিত্যদিনের পাতে ‘ঘাটো’ থাকে। যারা উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষ যারা 'দিকু' তারা ভাত খেতে পায়। ভাত তাদের প্রাপ্য খাদ্য। কিন্তু যারা হউমান, হত দরিদ্র, তারা তাদের প্রাপ্য অন্ন পায় না। মুণ্ডারা নীচু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই তারা ভাত খেতে পায় না। ভাত তাদের কাছে স্বপ্নের ব্যাপার। রাতে তারা শুয়ে শুয়ে স্বপ্নে মহারানীর ছাপ মারা দশ টাকার নোটের স্বপ্ন দেখে। কারণ টাকার বড় অভাব। দারিদ্র্যে জীর্ণ হয়ে প্রতিদিনের অন্ন চিন্তা ‘বৈঠবেগারী' করে এই হতভাগ্যদের জীবন কাটে। বিনা মজুরিতে বেগার খেটে এদের পেট ভরে না। অখাদ্য-কুখাদ্য খায়। ঘাটোতে লবণ জোটে না। মুণ্ডাদের সংসার ছেঁড়া কানির মত। তাদের কামনা শুধু ঘাটোর সঙ্গে লবণ পাওয়া। কিন্তু ভাতের কথা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। ঘাটোর সঙ্গে ‘যত ইচ্ছে হাত ডুবিয়ে' লবণ নিয়ে খাবে, তবু তারা 'অন্ন'র কথা ভাবতে পারে না। এই নিরন্ন মানুষদের কাছে ভাত তাই চিরকালের স্বপ্ন। মহাজন-জমিদার দিকুদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এই সামান্য খাদ্য, যৎসামান্য প্রাপ্য থেকেই তারা বঞ্চিত থাকে। এই কারণে জীবনের অতল অন্ধকার থেকে হাত বাড়িয়ে তারা ভাতের স্বপ্নে দিন গোনে। যে সমাজ প্রাথমিক প্রয়োজনটা মেটাতে পারে না, সে সমাজে মানুষের দুঃখ অবর্ণনীয়। তাই মুণ্ডাদের জীবনে ভাতের স্বপ্ন এমন এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা তাদের জীবনের এক সেরা আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে।



“উলগুলানের আগুনে জঙ্গল জ্বলে না, মানুষদের হৃদয় আর রক্ত জ্বলে।”—ব্যাখ্যা করো।

অধঃপতিত মুণ্ডা জাতি বীর নায়ক বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জমিদার মহাজন ও দিকুদের কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়েছিল, সে লড়াই এক বৃহৎ যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। এর নাম 'উলগুলান'। জঙ্গলের অধিকার পুনরার্জন করতে নিষ্পেষিত, নিপীড়িত এই সম্প্রদায় শক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। এই সংগ্রামের আগুন কেবল জমিদার দিকু অধিকৃত জঙ্গলকে জ্বলিয়ে দেয় নি, তা মুণ্ডা সম্প্রদায়ের মানুষদের হৃদয়কেও জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের রক্তে রক্তে জাগিয়েছে এই উলগুলানের অগ্নিমন্ত্র। জঙ্গল মুণ্ডাদের মা। বীরসা ছেলেবেলায় জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে অরণ্য জননীর কান্না শুনেছে। প্ৰাণ দিয়ে অরণ্যের মর্মরধ্বনি শুনতে পেয়েছে। সে শুনেছে অরণ্য কাঁদছে, আর্ত স্বরে প্রার্থনা করছে। বীরসা আমায় মুক্তি দে, আমাকে ‘দিকু' রা ধর্ষিতা করেছে। আমাকে মুক্তি দে। এই আর্ত কান্না বীরসাকে কেবল উতলা করে নি, হাজার হাজার মুণ্ডাদের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মুণ্ডারা সারা জীবন ‘দিকু'-দের অত্যাচার সহ্য করেছে, ‘বেঠবেগারী’ খেটেছে। দিকুদের জীবনযাত্রার সব রকম সুযোগ সুবিধের জন্য তাদের কর দিতে হয়েছে। এদিকে তাদের সংসার 'ছেড়া কানির’ মত। সর্বমুখী দারিদ্র্যে মুন্ডারা অভিশপ্ত। তারা সামান্য ভাত খেতে পায় না। ভাতের স্বপ্ন-তাদের কাছে বড় স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়, তারা খায় ‘ঘাটো'। ঘাটোতে লবণ দিয়ে খাওয়ার সুখও তারা সব সময় পায় নি। তাই তারা 'উলগুলানে’ মেতে উঠেছে। ‘দিকুরা' হল শঙ্খচূড়ের মত। তাই তাদের নাগপাশের বাঁধন থেকে মুক্তি নেই। শুধু সেই মুক্তির জন্য মুণ্ডারা এই যুদ্ধের সেনানী। যারা বীরসাইত, যারা নানক, তারা সকলে এসে এই যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হয়েছে। কারণ 'উলগুলান'-এ কেবল জঙ্গল জ্বলে নি, মানুষের রক্ত জ্বলেছে। মানুষের হৃদয় শোষণের জ্বালায় অস্থির। তাই উলগুলানের আগুনে সব জ্বলে পুড়ে গেছে। অরণ্যের অধিকার আবার অসহায় মানুষ ফিরে পাবে।



"উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই।"—কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

বীরসা মুণ্ডার নায়কত্বে শোষক জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধের নাম উলগুলান। এই যুদ্ধের নায়ক বীরসা মুণ্ডা। উলগুলানের আগুন দিকব্যাপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দলে দলে 'নানক', 'বীরসাইত’ ও ‘মুণ্ডারী’ মানুষ এসে এই যুদ্ধে জড়ো হয়েছে। যে কোন বড় যুদ্ধে প্রস্তুতি যেমন, সার্থকতা-ব্যর্থতাও তেমন। অসংখ্য মানুষকে ডেকে তাদের সভায় বীরসা ঘোষণা করেছে যে উলগুলান শুরু হচ্ছে। সকলে সংসার ও সুখ ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছে উলগুলানের আগুনে। সব বীরসাইডের ঘর হয়ে উঠেছে গড়। ডোমবারির পেছনে সৈলরাকাব পাহাড়ের চড়াৎ খাড়াই এক দুশ্চর জায়গা। সেখান থেকে মুণ্ডারা তীর ছুঁড়বে। চারিদিকে অগ্নি-গীতির মত ধ্রুবপদ ছড়িয়ে গেছে 'উলগুলান', 'উলগুলান'। মুণ্ডাদের অরণ্যের অধিকার চাই। “দিকু’দের দ্বারা ধর্ষিতা অরণ্য জননী বার বার কেঁদে বীরসার কাছে প্রার্থনা করেছে, 'আমাকে মুক্তি দে বীরসা'। সেই আর্ত ক্রন্দনের ফলশ্রুতি হিসেবে এই উলগুলান। "নতুন ছেলেদের নানকদের দীক্ষার মন্ত্র হল এই পাঁচটি শব্দ–উলগুলান"। এ লড়াই ধিমা-ধিমা লড়াই নয়। 'একসঙ্গে সকল মুণ্ডা সকল দেশ জুড়ে লড়বে। এই লড়াই সামগ্রিক লড়াই, একটা জাতির বাঁচা মরার লড়াই। উলগুলানের অগ্নিশিখা এমন ভাবে মুণ্ডা সমাজে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, একজনের সঙ্গে দেখা হলে একজন বলে 'উল' অন্যজন বলে 'গুলান'। এই উলগুলানের বিরাট প্রস্তুতি ছাড়া শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় বীরসা। কিন্তু এই পরাজয়ই শেষ কথা নয়। জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় জনজাগৃতির জোয়ার। এই জনজাগরণের ফলে সচেতন হবে মুণ্ডারা। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। তখন এই উলগুলান চলবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ভগবানের যেমন শেষ নেই, উলগুলানের তেমন শেষ নেই। ভগবান অজস্র। বিপ্লবও অজস্র। এই কারণে ভগবানের প্রতি নির্ভরতা, পূজা, বিশ্বাস যেমন চির সত্য, পরাজয়ের পরেও উলগুলানের প্রতি বিশ্বাসও তেমনি অমর সত্য। এই কারণেই এই উপন্যাসে বলা হয়েছে উলগুলানের শেষ নেই, ভগবানেরও শেষ নেই। ধ্রুবপদের মত এই সুর বেজে চলেছে।



“ওর রক্ত বড় প্রাচীন। বড় আদিম হয় কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীর রক্ত। ওর রক্তে অনাহার, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা। রূপকথায়, কিংবদন্তীতে, অলৌকিকে অবাস্তবে বিশ্বাস করে ওর রক্ত চিরকাল পালিয়ে বাঁচতে চায়। ছ'টি শব্দে ওর প্রাচীন রক্তের ছটি ফুলকি হয়ে জ্বলে উঠল।—ব্যাখ্যা করো।

বীরসার মৃত্যুর পর যখন তাকে দাহ করা হল, তখন চিতা জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে এল। সালী চলে। গেল। শিবন চিতা ধুয়ে দিতে দিতে ভাবছিল যে ওদের রক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসীর রক্ত। অনার্য জনজাতির রক্ত ধারা ওর শরীর দিয়ে বইছে। শিবনের শরীরে যে রক্ত বইছে, সে রক্ত বড় প্রাচীন রক্ত। অনার্যরাই এদেশের আদিম অধিবাসী। চুটু আর নাগু এসে আচোটা জমিতে চোট মেরে কুমারী অরণ্যের কৌমার্য ঘুচিয়ে মুণ্ডারীদের পত্তন আবাদ করেছিল। সেই আদি যুগে সেংগেলদা আকাশ থেকে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। সিংবোঙা আকাশ থেকে আগুন ফেলেছিল। আদিবাসীরা যাদুবিদ্যা, বোঙাবুঙি পূজো আর তুকতাকে বিশ্বাস করত। অবিশ্বাসে অলৌকিকে বিশ্বাস করত। এই মধ্যযুগীয় বিশ্বাস থেকে বীরসা তাদের আধুনিক পৃথিবীতে ডেকে নিয়ে এল। বীরসা যে ব্রত নিয়েছে, সে ব্ৰত দুঃসাধ্য। 'প্রাচীন জড়তা, অন্ধকুসংস্কার থেকে আধুনিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চায় বীরসা। তাই মুন্ডারা অরণ্যের অধিকারের জন্য সিংবোঙার পূজা নয় উলগুলানের রক্তমন্ত্র জপ করেছে। সভা ডেকে বীরসা তাদের উলগুলানের মন্ত্র শুনিয়েছে। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে শোষিতের যুদ্ধ এই উলগুলান। উলগুলানের নেশায় মুন্ডারা খেপে উঠেছিল। ধনুক, তীর আর বনোয়া তুলে মুণ্ডারা এগিয়ে যাবে ‘দিকু’দের দিকে, সাহেব যোদ্ধার দিকে। ‘ধরতি আবা'-র ডাকে তারা সব ডোমবারি পাহাড়ে জড়ো হবে। এইভাবেই উলগুলানের আগুন অরণ্যের অধিকারকে নিয়ে আসবে। মধ্যযুগীয় ধর্মের অলৌকিকতার মাধ্যমে পলায়ন নয়, যুদ্ধই অধিকার অর্জনের একমাত্র পথ।