“আমার পরমায়ুর সমস্ত দিন রাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা" নায়কের উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

“ঠিক সময়ে ঠিক কাজ করিতে কাহারো মনে পড়ে না, তাহারা পরে বেঠিক সময়ে বেঠিক বাসনা লইয়া অস্থির হইয়া মরে"—এই আক্ষেপোত্তির তাৎপর্য কী?

'একরাত্রি' গল্পের নায়কের কোনো এক সান্ধ্য অবসরকালীন বিগত দিনের হিসেবী চিন্তাধারার ফলশ্রুতি স্বরূপ আত্মকথনে তার বর্তমান নিঃসঙ্গ অবসরকালীন মনোজগতের একটা রেখাচিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে ফেলে আসা দিনের অবহেলাগুলিকে শুধরে নেওয়ার অক্ষমতায় আক্ষেপ বর্ধিত হয়েছে।


নায়কের পিতা চেয়েছিলেন কিছু লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলেকে জমিদারী সেরেস্তার গোমস্তার কাজে নিযুক্ত করাতে, কিন্তু নায়কের চোখের সামনে তখন উজ্জ্বল আদর্শ ছিল পাড়ার নীলরতন, যে কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে লেখাপড়া শিখে কালেক্টর সাহেবের নাজির হয়েছিল। সেই আদর্শে জারিত নায়কও একদিন কলকাতায় পালিয়ে গেল। সেখানে এন্ট্রান্স পড়া শুরু হল বটে কিন্তু মন গেল দেশোদ্ধারের কাজে। সে কাজের উৎসাহ ও নিষ্ঠায় লেখাপড়ায় ঘাটতি হতে লাগল। দলের জন্যে চাঁদা তুলে, হ্যান্ডবিল বিলি করে, সভার জন্যে চৌকি, বেঞ্জ পেতে সময় কাটিয়ে তার মধ্যেও এন্ট্রান্স পাশ করল। এফ. এ.-তে ভর্তি হল। কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার মুখে তার পিতৃবিয়োগ হওয়ার ফলে পড়া ছেড়ে চাকরীর ব্যবস্থা দেখতে হল। নাজির বা হেডক্লার্ক কিছুই সে হতে পারল না। নোওয়াখালি বিভাগের ছোট একটা শহরের এন্ট্রান্স স্কুলে সেকেণ্ড মাস্টারের চাকরী পেল।


এন্ট্রান্স পাশ করার পর তার পিতা এবং বাল্যসঙ্গী সুরবালার পিতা যুক্তি করে সুরবালার সঙ্গে তার বিবাহের ব্যবস্থা করল। কিন্তু দেশোদ্ধারের কাজে তখন মন অত্যন্ত নিযুক্ত থাকায় বিয়েতে সে রাজি হল না। সুরবালার বিয়ে হয়ে গেল উকিল রামলোচন রায়ের সঙ্গে। যে সুরবালাই ছিল তার একান্ত অধিকারের সামগ্রী, আজ তার মুখ দেখতে হলেও অপরের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন। নিজের ফেলে আসা জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করতে বসে যখন বারে বারেই সুরবালার মুখ তার মনে পড়তে লাগল তখন দেখলো জীবনের অনেক কিছুই তার অপূর্ণ রয়ে গেছে। বিশেষ করে জীবনে সুরবালাকে বরণ করবার সঠিক সিদ্ধান্ত সময় মতো না নেওয়ার ফলে আজ যেমন তাকে মনস্তাপে ভুগতে হচ্ছে তেমনি পরস্ত্রী সুরবালা সম্পর্কিত অন্তরঙ্গ কিছু চিন্তাধারাও বেঠিক সময়ে তার মনোকষ্টকে বাড়িয়ে তুলছে। ক্রমশ ভুলের পর ভুলে তার জীবন অস্থিরতায় ভরে উঠছে। এই বোধ নির্জন সায়াহ্নে তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করায় ওই সত্য নায়কের আক্ষেপোত্তিরূপে প্রকাশিত হয়েছে।



“আমার পরমায়ুর সমস্ত দিন রাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা" নায়কের উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

‘একরাত্রি' গল্পের নায়ক জীবনের নানা ভুলের মাশুল দিতে আজ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেমন সেকেন্ড মাস্টারির পদপ্রাপ্ত হয়ে পাড়াগেঁয় স্কুলে চাকরি করছে ঠিক তেমনি যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় তার বাল্যসখী সুরবালাকে জীবনসঙ্গীনী হিসেবে পেতে পারে নি। অথচ বাল্যাবস্থা থেকেই তাদের বিবাহ সম্ভাবনার সমর্থন তাদের অভিভাবক মহলেও ছিল। যথাকালে নায়কের পিতা এবং সুরবালার পিতা একমত হয়ে নায়ককে যখন সুরবালাকে বিবাহ করার জন্যে চিঠি দিলেন তখন দেশোদ্ধারের কাজে ব্যস্ত নায়ক আপাতত তার বিবাহ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিল। ফলে সুরবালার অন্যত্র বিবাহ হল।


এদিকে অবস্থার গতিকে নায়ক স্কুলের সেকেণ্ড মাস্টারীর চাকুরী নিয়ে যে স্থানে এসে পড়ল সুরবালার স্বামীও সেখানকারই উকিল। একদিন অবসরকালে রামলোচনের বাড়িতে রামলোচনের সঙ্গে কথাবার্তার ফাঁকে পাশের ঘরে চুড়ির মৃদু টুংটাং, কাপড়ের খসখসানি, পায়ের শব্দ শুনে সে উতলা হল। কিন্তু যে সুরবালা তার পক্ষে সহজ প্রাপ্য ছিল সে আজ তার আয়ত্তের বাইরেই শুধু নয়, সে পরস্ত্রী। কিন্তু ঐ সন্ধ্যায় না দেখা সুরবালার আভাষ মাত্র পেয়ে তার চিন্তাভাবনা সবই সুরবালাময় হয়ে উঠল।


নায়কের অপ্রাপ্য সুরবালাময় মানসিকতার মধ্যে একরাত্রে প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপস্থিত হল। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সংবাদ পাওয়া গেলে, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে উঁচু পাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। এমন সময় দেখল অপর দিক থেকেও উঠে আসছে আর একটি মানুষ—আকার আকৃতিতে বোঝা গেল সে সুরবালা। চতুর্দিক জলমগ্ন, একটিমাত্র জেগে থাকা দ্বীপাংশে পাঁচ ছয় হাত দূরত্বে দুটি মাত্র প্রাণী। কারো মুখে কথা নেই। রাত শেষে ভোর হলে নিঃশব্দে দুজনেই দুদিকে নেমে গেল।


একদা শৈশবের বাল্যসঙ্গী বহুকাল বাদে সামাজিক ব্যবধানের বেড়ার আড়াল থেকেও মহাপ্রলয়ের রাত্রে মরণের মুখোমুখি হয়ে আবার কাছাকাছি এলো। কিন্তু সুরবালার প্রতি তার সঙ্গলিঙ্গা আসঙ্গ লিপ্সায় পরিণত‌ না হয়ে সুরবালার কল্যাণ কামনা করে মনের মধ্যে নায়ক অত্যন্ত তৃপ্তি বোধ করল। তার সেই বাসনাহীন ক্ষণমিলন চিরমিলনের মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠে একটি রাত্রিই চিরকালের অনন্তক্ষণ হয়ে উঠল। যে স্থূল আনন্দের আশায় সে সুরবালার প্রতি অন্তরঙ্গ বর্ণালী ভাবনায় সমাচ্ছন্ন হয়ে বেদনা মধুর চিন্তা করে মনগত অভিলায় মনে মনেই চরিতার্থ করছিল, সেই ভ্রান্ত চিন্তার অবসানে অনন্তকালীন আনন্দ জোয়ারে স্নাত হয়ে অভিভূত ও পবিত্র হল তার অন্তর। কলুষতার কালিমা মুছে গেছে শ্বেত শুভ্র মিলনান্দে উদভাসিত চিত্তে সে অনুভব করল সেই একটি মাত্র রাত্রিই তার জীবনের চরম সার্থকতা।