অদ্বৈতচরণ সার্থকনামা ব্যক্তি আলোচনা করো | 'পয়লা নম্বর গল্পের নামকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা আলোচনা করো।

'পয়লা নম্বর গল্পের নামকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা আলোচনা করো।


প্রায় সর্বক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করতেন নামীর স্বভাব ব্যক্ত করে। সে পদ্ধতি শুধু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নামকরণ করতেন গাছপালার, ফুলেরও। এবং বলাবাহুল্য, সর্বক্ষেত্রেই তাঁর নামকরণ আদর্শ রূপেই বিবেচিত হয়েছিল। কোনো মানব শিশুর নামকরণের সঙ্গে, সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের কিছু পার্থক্য আছে। শিশুর নাম শ্রুতিমধুর এবং সহজ আহ্বান যোগ্য হলেই চলে, কিন্তু সাহিত্যের সামগ্রীর নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে নামকৃত উপাদানটির মর্মকথা বা উদ্দেশ্য বা কোনো বিশেষ বক্তব্য। আবার কখনো বা গল্প বা উপন্যাসের পটভূমিই হয়ে থাকে শিল্পসামগ্রীর নামকরণ। তাই বলাবাহুল্য যে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সহ সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে দেখা যায় নামকরণ তিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে করে গেছেন। এবং সেই নামকরণ নিয়ে কোনো দ্বিধা উপস্থিত হয় না। কিন্তু আলোচ্য গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে কোথায় যেন একটু থমকাতে হয়। অথচ, নামকরণের ব্যাপারে তিনি যে নিতান্তই সজাগ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়, আলোচ্য গল্পের গল্পকথক তথা নায়কের নাম অদ্বৈতচরণ করায়। অদ্বৈতচরণ মানে এক পায়ে চলেন যিনি। গল্পকথক কেবল বই মুখেই বসে থাকেন, অন্যদিকে তাঁর কোনো হুঁশ নেই। অন্যদিকে তাঁর স্ত্রীর নাম অনিলা। অনিল শব্দকে আ প্রত্যয় যোগে স্ত্রীলিঙ্গ করা হয়েছে। অনিল শব্দের অর্থ বায়ু অর্থাৎ যার দ্বারা প্রাণ বাঁচে। অথচ, সেই বায়ু আমাদের পক্ষে এতই সহজলভ্য যে প্রায় মূল্যহীন বললেই হয়। অদ্বৈতচরণের পক্ষে অনিলার অস্তিত্বও সেই রকম। এরপর আমরা পাই পয়লা নম্বরের ভদ্রলোকের নাম-সিতাংশু মৌলি। সিতাংশু হল চাঁদ, আর মৌলি শব্দের অর্থ হল শ্রেষ্ঠ। চন্দ্রশ্রেষ্ঠ ভদ্রলোক নরোত্তমপুরের জমিদার। এই নামকরণের মধ্যে দিয়ে বোঝা যাচ্ছে অদ্বৈতচরণের তুলনায় নরোত্তম হলেন সিতাংশুমৌলি। তাঁর মধ্যে চাদের কলঙ্ক কিছু থাকলেও তিনি শ্রেষ্ঠ। এবং এই নরোত্তমপুরের জমিদার থাকতেন এই পয়লা নম্বরের বাড়িতে।


‘পয়লা নম্বর’ শব্দটির মধ্যে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, যেন রয়ে গেছে বিদ্রূপের ইঙ্গিত। গল্পকথক যে বাড়িতে থাকেন সে বাড়িটা দ্বিতীয় নম্বরের বাড়ি। আর তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রথমপুরুষ বলার মতো প্রতিবেশীকে পয়লা নম্বরের বাসিন্দা করা হয়েছে। এই বাড়ির নামকরণের মধ্যে দিয়ে পাঠকদের কিছুটা ধাঁধায় ফেলে দিয়েছেন গল্পকার। কেন না,পয়লা নম্বর বাড়ির বাসিন্দা আলোচ্য গল্পের নায়ক নয় অথচ তিনি নরোত্তমপুরের জমিদার সিতাংশুমৌলি—যিনি অনিলাকে পরস্ত্রী জেনেও প্রেমপত্র প্রেরণ করেন। তা হলে কোন শ্রেষ্ঠত্ব গল্পকার আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন?


প্রকৃতপক্ষে, আলোচ্য গল্পে পয়লা নম্বরের বাড়ির বাসিন্দা বা অদ্বৈতচরণকে কেন্দ্র করে নামকরণ করা হয়নি নামকরণ করা হয়েছে অনিলাকে দেখে। রবীন্দ্রসাহিত্যে অনিলা এমনই এক ব্যক্তিত্বময়ী নারী যিনি অদ্বিতীয়া—যিনি পয়লা নম্বর।


সাধারণত আমাদের একটা ধারণা আছে যে নারীজীবনের সার্থকতা মাতৃত্বে, কারও ধারণা প্রেয়সীত্বে। কিন্তু এখানে অনিলা মাতৃত্ব, প্রেয়সীত্ব, ভগ্নীত্বর চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে নারীত্বে। তার ব্যক্তিত্বকে স্পর্শ করতে পারে নি অদ্বৈতচরণ কিংবা নরোত্তমপুরের জমিদার সিতাংশুমৌলি। প্রেমের ও পার্থিব ঐশ্বর্যের প্রলোভন এবং অভ্যস্ত অনাদর তাকে চালিত করতে পারেনি চিরাচরিত পথে। সে যদি সিতাংশুর সঙ্গে পালিয়ে যেত কিংবা আত্মহত্যা করতো তা হলে তার শ্রেষ্ঠত্বে দাগ ধরতে পারতো। কিন্তু এখানে তার স্বামী এবং প্রেমাস্পদ উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে সে-ই হয়ে গেছে পয়লা নম্বর। গল্পের পরিণতিতে তাই অনিলার এই মহত্ত্ব ছুঁয়ে যায় পাঠকচিত্তকে। এইখানে এসেই সার্থক হয় গল্পের নামও।



অদ্বৈতচরণ সার্থকনামা ব্যক্তি আলোচনা করো।

অদ্বৈতচরণ মানে এক পায়ে চলেন যিনি। গল্পকথক কেবল বই মুখেই বসে থাকেন, অন্যদিকে তাঁর কোনো হুঁশ নেই। মানুষের দুটি পা যে নিজেকে ঠিক মতো দাঁড় করানো ও হাঁটার সুবিধের জন্যেই রয়েছে। সংসারী মানুষেরও সংসার এবং কর্ম দুটি ক্ষেত্রেই যে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, অদ্বৈতচরণের মতো মানুষেরা সেটা খেয়াল করেন না। সেই জন্যেই এক খাতে প্রবাহিত হতে থাকে তাঁদের জীবনধারা। খ মানুষের মতো পথ চলার অবলম্বন হাতের কাছে থাকলে সহজে চলতে পারে, অন্যথায় হোঁচট খেতে হয় প্রতি পদে।


আলোচ্য গল্পে অদ্বৈতচরণকে আমরা পাই একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন গ্রন্থকীট রূপে। তাঁর জ্ঞানের সীমা পরিসীমা নেই। বিজ্ঞান সাহিত্য দর্শন থেকে শুরু করে হাল আমলের সমস্ত বিষয়টি তাঁর নখদর্পণে। অথচ তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কা পাননি। বাইরের বই পড়তে পড়তে পাঠ্য বইয়ের পাতায় খুব বেশি মনোনিবেশ করতে পারেননি। তা হলেও তিনি স্বশিক্ষিত। এবং স্বশিক্ষাতেই শিখে নিয়েছিলেন জার্মান, ফরাসি, ইটালিয়ান, রাশিয়ান ভাষা। স্বাভাবিক ভাবেই এত পাণ্ডিত্বের কারণে তাঁর কাছে বেশ কিছু লোক সমাগম ঘটে। এবং লেখালেখির অভ্যাস নেই বলেই আলোচনা করে জ্ঞানের গভীরতা বাড়িয়ে থাকেন তিনি। পড়াশোনার জগতে থাকার জন্যে তাঁর মনের মধ্যেও একটা স্থিতপ্রজ্ঞ ভাবের প্রলেপ পড়েছিল। তাই সংসারের সুখ দুঃখের সংবাদে তাঁর কোনো বিচলন এবং কৌতূহল ছিল না। সংসারের অন্ন চিন্তার চেয়ে পুঁথির তত্ত্ব বিশ্লেষণে তাঁর আগ্রহ ছিল অধিক। এমন কি সংসার খরচের টাকায় কৃপণতা করে বই কেনায় দেদার খরচ করতেন অদ্বৈতচরণ।


অদ্বৈতচরণের স্ত্রীর নাম অনিলা। অনিল মানে 'যার দ্বারা বাঁচে' অর্থাৎ ‘বায়ু'। বায়ু দ্বারা বাঁচলেও আমরা যেমন তার মূল্য বুঝি না, এক্ষেত্রেও তেমনি অনিলা এমনই সহজ অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল যে তার মূল্য অদ্বৈতচরণ বুঝতে পারতো না। কিন্তু অদ্বৈতচরণের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী সত্য সত্যই অনিলা—তাকে ছাড়া তার জীবনচর্যা ছিল দুষ্কর। সংসারের সমস্ত কাজ তিনি নিঃশব্দে ও অপ্রতিবাদে করে থাকেন। কিভাবে যে তিনি সংসার চালান অদ্বৈতচরণ তা জানেন না, জানতে চান না। শুধু জানেন যে তাঁর কাছে সময়জ্ঞানহীন অথবা সময় সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন যেসব শিক্ষার্থী বা সভ্যরা আসেন তাদের দু বেলা আহারের ব্যবস্থা অনিলা করে থাকে। কিন্তু সংসারের ব্যয় কিভাবে নির্বাহ হয় তার খোঁজ করেন না অদ্বৈতচরণ। তার পক্ষে স্ত্রী সহজলভ্য বায়ুর মতোই নিতান্ত প্রয়োজনীয় অথচ মূল্যহীন ছিল। গ্রন্থব্যূহ ভেদ করে স্ত্রীর দিকে, স্ত্রীর মনের দিকে তাকানোর অবকাশ অদ্বৈতচরণের কোনোদিন ঘটেনি। তাঁর মস্ত এক রক্ষাকবচ ছিল অন্যমনস্কতা। সেই কবচ দিয়েই সংসারের যাবতীয় অশান্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারতেন। সেই অন্যমনস্কতার জন্যেই অনিলার একমাত্র ভাই-এর পড়াশোনা বা তার আত্মহত্যার সংবাদও তিনি নিতে পারেননি যথা সময়ে।


সেই অন্যমনস্কতার বেড়া ভেঙে একদিন আবির্ভূত হয়েছিল পয়লা নম্বর বাড়ির সিতাংশুমৌলি। তার সশব্দ দিন যাপনে অদ্বৈচরণের নিভৃত ধ্যান ভেঙে যেত বার বার। ক্রমে ক্রমে তিনি দেখলেন, সিতাংশুর দাপটে তাঁর সভার সভ্য সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। তিনি নিরুপদ্রর সাধনার জন্যে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া করার কথা ভাবতে লাগলেন।


এ হেন অদ্বৈতচরণেরও জীবন বিচলিত হল অনিলার গৃহত্যাগ করার ঘটনায়। তখন স্ত্রীর বিরহের মাঝখানে সিতাংশুর চিঠির মধ্যে দিয়ে তিনি দেখতে পেলেন স্ত্রীর প্রকৃত রূপ। এতদিনে অনুভব করতে পারলেন স্ত্রীর অভাব। এই আঘাত থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জ্ঞানচর্চা ও তত্ত্বকথা নিয়ে সংসার চলে না। মানুষের মন ওইসব শুকনো তত্ত্বের চেয়েও অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। এইখানে এসেই চরিত্রটির মধ্যে দ্বৈতচরণ ভরসার বা স্বাবলম্বী হবার প্রেরণা জাগে। তা না হলে সমগ্র গল্পের মধ্যে নিজের পাণ্ডিত্বের কথা তিনি গাল ফুলিয়ে যতই বলুন না কেন, তিনি যে সত্য সত্যই অদ্বৈতচরণ রূপে অবস্থিত ছিলেন এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।