সামাজিক নাটকের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করে কয়েকজন প্রধান বাঙালি নাট্যকারের সামাজিক নাটক সম্বন্ধে আলোচনা কর।

সমাজজীবনের বিভিন্ন দিক তার সমস্যা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্বন্ধ ইত্যাদি নিয়ে রচিত বাস্তবতাপ্রধান নাটককে সামাজিক নাটক বলা হয়। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিদেশী নাট্য রচনার ধারা পরীক্ষা করে দেখলে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক কমেডি বা ট্র্যাজেডি যে ধরনেরই নাটক হোক, তা ছিল রোমাণ্টিক, কবিতার মতই কল্পনা ও আবেগের ঐশ্বর্যময় সংলাপ কবিতার ছন্দে লিখিত, সম্পূর্ণ রূপেই কাব্যধর্মী। শেক্সপিয়ারের Romeo and Juliet, Julius Caesar, Hamlet প্রভৃতি নাটকে বিভিন্ন ধরনের চরিত্র ও তাদের আচরণ, জনতা দৃশ্যে সাধারণ মানুষদের গদ্যে বাস্তবধর্মী সংলাপ প্রভৃতিতে সমাজ পর্যবেক্ষণ অনেকটা পরিমাণেই সামাজিক নাটকের বৈশিষ্ট্যধর্মী কিন্তু নটিকে তার স্থান নিতান্তই‌ গৌণ—কাব্যধর্মিতারই প্রাধান্য। শেক্সপিয়ারের নাটককে কোনও কোনও সমালোচক কাব্যনাটকরূপেও অভিহিত করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দীর ‘রেস্টোরেশন' যুগের ওয়াইচার্লি, কগ্রিভ, ভ্যানরু, ফার্কুহার প্রভৃতির কমেডিতে সামাজিক নাটকের সূত্রপাত, তাদের মধ্যে সমাজ পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবতাকে প্রাধান্য পেতে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে গদ্যের আত্মপ্রতিষ্ঠা, তবু সামাজিক নাটক রচনায় কোনও নতুন গতিবেগ লক্ষ্য করা যায় না। এই যুগের গ্যেটে, শিলার ও অন্যান্য নাট্যকারেরা যে সমস্ত নাটক রচনা করেছেন, সেগুলি প্রকৃতপক্ষে রোমান্টিক কাব্যনাটক। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাব্যসাহিত্য ও উপন্যাসেরই প্রাধান্য।


সামাজিক নাট্যরচনার নবদিগন্ত উন্মোচিত হল বিংশ শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দীর সূত্রপাত থেকেই দেখা যায়, নাটক এলিজাবেথীয় যুগের কবিকল্পনার উত্তুঙ্গ চূড়া থেকে অবতরণ করে প্রাত্যহিক জীবনের নিম্নভূমিতে বিচরণশীল, শিল্পায়ন ও ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতির ফলে সমাজজীবনে বৈষম্য, দুর্নীতির প্রসার, জীবনে যান্ত্রিকতার প্রভাব, পুরাতন ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে জটিলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা এবং তাদের জটিল জালে আবদ্ধ মানুষের দুঃখযন্ত্রণা চিত্রণই তার লক্ষ্য। আধুনিক সামাজিক নাটকের সঙ্গে কাব্যের যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে তাও আমাদের চোখে পড়ে গল্সওয়ার্দি তাঁর Justice, Strife প্রভৃতি নাটকে বিংশ শতাব্দীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনসঞ্জাত সমস্যাগুলির ঘাতপ্রতিঘাতে মানবজীবন যেভাবে আলোড়িত তা-ই রূপায়িত করেছেন। বার্নার্ড শ তাঁর নাটকগুলিতে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় অন্যায় ও বৈষম্য, বিবাহ প্রথা, অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ, চিকিৎসা ব্যবসায়, গণিকাবৃত্তি, যুদ্ধের গৌরব ও বীরত্বের মহিমাকীর্তনের প্রবঞ্চনা ইত্যাদি নির্মম ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে উদ্ঘাটিত করে দেখিয়েছেন। সামাজিক নাটক রচনায়, বিশেষত সংলাপে কথ্যভাষায় শব্দ ব্যবহারে গওয়ার্দির নৈপুণ্য সহজেই চোখে পড়ে। নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার ইবসেনের A Doll's House, Ghosts প্রভৃতি নাটকের সমাজ-সমালোচনা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্যার চিত্রণ বিশ্ব নাট্যসাহিত্যে যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করেছে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার চেখভ-এর অবদানও কম নয়। আধুনিক যুগের সামাজিক নাটক ক্ষুদ্রায়তন, তিনটি অংশে বিভক্ত অথবা একাঙ্কই এখন প্রচলিত। বাস্তবতাপ্রধান আধুনিক সমস্যামূলক সামাজিক নাটকে ট্র্যাজেডি ও কমেডির সীমারেখাকে মুছে যেতে দেখা যায়। ট্র্যাজেডি ও কমেডি, লঘু ও গম্ভীর ভাবের মিশ্রণই তাদের বৈশিষ্ট্য। বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সামাজিক নাটক রচনায় অ্যানভিল বার্কার, প্রিস্টলে, নোয়েল কাওয়ার্ড, রবার্ট শেরিফ প্রভৃতির দান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।


আধুনিক যুগের কমেডি,ট্র্যাজেডি ও প্রহসন প্রভৃতি সর্বশ্রেণীর নাটকই ত সামাজিক নাটক। তাদের থেকে কোন্ নাটকগুলিকে আলাদা করে নিয়ে বিশেষভাবে সামাজিক নাটকরূপে অভিহিত করা হবে সেই সমস্যা আমাদের সামনে দেখা দেয়, এক কথায় তার উত্তর দেওয়াও সম্ভব নয়। আমাদের মনে হয়, যে নাটকগুলিকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে কমেডি ও ট্র্যাজেডি ও প্রহসন রূপে চিহ্নিত করা যায়, তাদের বাদ দিয়ে সাধারণ শ্রেণীর নাটকগুলিকে সামাজিক নাটকরূপে গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত।


ঊনবিংশ শতাব্দীতে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ, নৈতিক অধঃপতন প্রভৃতি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে বহু সামাজিক নাটক রচিত হয়েছিল, কিন্তু প্রথম যুগের নাট্যকারেরা সংস্কৃত নাট্যরীতির প্রতি নির্বিচার আনুগত্যের জন্য বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেন নি।


গিরিশচন্দ্রের সর্বাধিক পরিচিত সামাজিক নাটক ‘প্রফুল্ল’কে ট্র্যাজেডিরূপেই চিহ্নিত করতে হয়। তাঁর ‘হারানিধি' (১৮৯০) নাটকের বিষয়বস্তু বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা। পাষন্ড মোহিনীর কন্যার মস্তিষ্ক বিকৃতি-ব্যাধিতে হৃদয় পরিবর্তন নাটকটিতে চিত্রিত হয়েছে। গিরিশচন্দ্র তাঁর ‘মায়াবসানে’ রাজনৈতিক আন্দোলন অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মরত এবং ক্ষমাধর্মের আদর্শের অনুসরণে ধর্মীয় ঐক্যবিধান দেশের পক্ষে অধিকতর মঙ্গলজনক, এই তত্ত্বকেই আভাসিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু নাটকটি রসোত্তীর্ণ হয় নি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মাত্র দুটি সামাজিক নাটক লিখেছিলেন, ‘পরপারে’ ও ‘বঙ্গনারী’। দুইটিই ব্যর্থ রচনা। 'কর্মফল' গল্পের নাট্যরূপ ‘শোধবোধ' রবীন্দ্রনাথের সামাজিক নাটক, এখানে অনুকরণসর্বস্ব সাহেবিয়ানাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে চিত্রিত করা হয়েছে এবং প্রথমে সন্তানহীনা মামীর প্রশ্রয়প্রাপ্ত, পরে তিনি সন্তান লাভ করলে তার প্রতি তাঁর অবজ্ঞা-অবহেলায় ধিকৃত সতীশের নারীর প্রকৃত প্রেমের সৌভাগ্য লাভ প্রদর্শিত। ‘বাঁশরী’ অতিমাত্রায় সংলাপের কারুকার্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে চরিত্রগুলি সজীব হয়ে উঠতে পারে নি।


বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই বাঙলা ভাষায় প্রচুর সামাজিক নাটক রচিত হতে দেখা যায়। বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মেঘমুক্তি’র বিষয়বস্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহবশত ভুল বোঝাবুঝি ও তার অবসান, নাটকটিকে মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্ম ঘাতপ্রতিঘাতের মাধ্যমে বিশ্লেষণে উল্লেখযোগ্য, কিন্তু সমস্যার সমাধান গভীর ও নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়নি। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দুই পুরুষ’ নাটকে পুত্র ও পিতার মতাদর্শঘটিত সংঘাত এবং পিতার পরাজয় স্বীকার চিত্রিত হয়েছে। মনোজ বসু তাঁর ‘প্লাবনে' ব্যক্তিজীবনের বিপর্যয় এবং ‘নূতন প্রভাতে ধনী জমিদারের পীড়ন শোষণের বিরুদ্ধে দুঃস্থ-দুর্গতদের সংগ্রাম রূপায়িত করেছেন। বনফুলের 'কঞ্চি নাটকের মূল বিষয় অসবর্ণ বিবাহ-ঘটিত সমস্যা, কন্যা ও পুত্রের দুই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এই বিবাহ প্রতিরোধের প্রয়াস এবং অবশেষে তাদের পরাজয়। বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্নে' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে দুর্ভিক্ষপীড়িত কৃষক জীবনের দুর্গতি, সমাজজীবনেও প্রচলিত মূল্যবোধে ভাঙ্গন, জীবনের প্রচলিত ধারার পরিবর্তন এবং তারই মধ্যে নতুন জীবনের স্বপ্ন যে বাস্তবতায় চিত্রিত হয়েছে, বাঙলা নাট্যসাহিত্যে তা তুলনাহীন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘গোত্রান্তর' নাটকে একজন উদ্বাস্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিভাবে নিজের পরিবারসহ ভদ্র মধ্যবিত্ত জীবন থেকে ভ্রষ্ট হয়ে বস্তিনিবাসী শ্রমিক জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়লেন, তারই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই বিষয়বস্তুর দিক থেকে নাটকটি উল্লেখযোগ্য হলেও তার নাট্যরূপায়ণ সর্বথা সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। তুলসী লাহিড়ী তার ‘ছেঁড়াতার’ নাটকে পঞ্চাশের মন্বন্তরের পশ্চাদপটে বর্তমানে বাঙালাদেশের অন্তর্ভুক্ত রংপুর জেলার গ্রামীণ কৃষক সমাজের সমস্যা ও দুঃখদৈন্য রূপায়িত করেছেন, নাটকের চরিত্রগুলির মুখে রংপুর অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, এটি নাটকটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বহুরূপী অভিনীত ‘পুতুলখেলা’ ইবসেনের A Doll's House-এর অনুবাদ হলেও বাঙলা সামাজিক নাটকের আলোচনায় অবশ্য স্মরণীয়। মনোজ মিত্রের ‘চাকাভাঙা মধু’, ‘সাজানো বাগান', মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘একাংকিক ও অন্যান্য নাটক ইত্যাদি সাম্প্রতিককালের উল্লেখযোগ্য সামাজিক নাটক।