“মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রকরণভাবনা অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে লেখকের জীবনদৃষ্টির সঙ্গে।"- আলোচনা করো।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক। তাঁর জীবনদৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, তাঁর বাস্তব-অন্বেষণ সবই তাঁর উপন্যাসের প্রকরণ ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। উপন্যাসে প্রকরণ ভাবনা জীবনভাবনার ফলশ্রুতি হিসেবে প্রতিফলিত হয়। তাই ঘটনাপ্রধান উপন্যাসের আঙ্গিকে ঘটনার বিবরণ ও উপস্থাপনা যেমন প্রাধান্য পায়, তেমনি মনস্তত্ত্বপ্রধান উপন্যাসে অন্তঃবাস্তবতার প্রকাশের ক্ষেত্রে রীতিপ্রকরণকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপিত করতে হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তবসন্ধান ও মনস্তত্ত্বনির্ভর উপন্যাস সৃষ্টি প্রকরণ ভাবনার বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। কারণ উপন্যাসে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক অন্যোন্য।


বঙ্কিমচন্দ্র ঘটনাপ্রধান উপন্যাস লিখলেও “অন্তবিষয় প্রকটনে” যত্নবান ছিলেন। 'রজনী'র পাতায় পাতায় সেই মানসলোকের চিত্র। ‘কৃয়কান্তের উইল’ বা ‘চন্দ্রশেখর' মনোলোকের চিত্রে পূর্ণ। বঙ্কিমোত্তর উপন্যাসে রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র যে মনস্তত্ত্বপ্রধান উপন্যাসের ধারাকে প্রবর্তন করলেন, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নতুন এক মাত্রা নিয়ে দেখা দিল। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি'-তে চরিত্রের অন্তর্লোকের চিত্র বাংলাসাহিত্যে যে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিল, তা 'চতুরঙ্গ'-এর গূঢ় অন্তঃবাস্তবতায় এসে এক নতুন পথের মোড় নিল। 'চতুরঙ্গ'র এই অন্তঃবাস্তবতা মানিকের প্রথম পর্যায়ের উপন্যাসে একটি ধারাস্রোত সৃষ্টি করেছে। মানিকের মনস্তত্ত্বনির্ভর এই উপন্যাসগুলিতে বাস্তবতার প্রেরণা যুক্ত থেকে রচিত হয়েছে এক নতুন প্রকরণ।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক। তিনি নির্মোহ ও মর্মভেদী দৃষ্টিতে জীবন ও জগৎকে নিরীক্ষণ করেছেন। একটি বোধের সূত্র ধরে, একটি দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে তিনি জীবনের ঘটনাকে নির্বাচিত করেছেন। এইজন্য উপন্যাসে নিটোল গল্প বা প্লটের আদি-মধ্য-অন্ত্যযুক্ত সুসঙ্গত শরীর তার সুনির্দিষ্ট পরিণামী রূপে গড়ে ওঠেনি। মানিক জীবনের ঘটনাকে নির্বাচিত করে তাকে বিশোধিত করেছেন এক অখণ্ড চেতনায়। অংশ সমগ্রতায় বিধৃত হয়েছে জৈব সংহতিতে। সমালোচকরা উপন্যাসে যে 'organic growth'-এর কথা বলেছেন, মানিক তাঁর ‘এপিসোডিক্যাল’ কাহিনীতে সেই ঐক্য ও সংহতিকে পরিস্ফুট করেছেন। শিল্পী মানিক খণ্ড খণ্ড চেতনা দিয়ে সমগ্রতার অবয়বে উপন্যাসের কাহিনীকে সজ্জিত করেছেন। তাই প্রথাসিদ্ধ উপন্যাসের প্রকরণ ভাবনা মানিকের উপন্যাসে নেই। তারাশঙ্করের মত পটভূমি প্রধান উপন্যাস মানিক লেখেননি, পটভূমির মধ্যে চরিত্রকে উপস্থাপিত করে তাকে বিশাল গতি তিনি দেননি। মানিক কাহিনীর ধারা ও চরিত্রের বিন্যাসে যে লক্ষণটি স্পষ্ট করেছেন, তা হচ্ছে মিতরেখায় কাহিনীর প্রকাশ ও চরিত্রের প্রবণতাকে তুলে ধরা। চরিত্র বলতে প্রথমে মানিকের কাছে ছিল ‘মানুষের projection' 'দিবারাত্রির কাব্যের' হেরম্ব, মালতী, অনাথ ও আনন্দ, সুপ্রিয়া ও তার কাহিনী সবই “মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।” ‘দিবারাত্রির কাব্য' উপন্যাসে এইভাবে চরিত্র নির্মাণকে স্বতন্ত্র রীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। চরিত্রের পরিচয় ‘রূপক' হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-র ঘটনাবিন্যাস বিশ শতকের আধুনিক উপন্যাসের লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত। প্রথম থেকে উপন্যাসে ঘটনার দ্রুতগতি লক্ষ্য করা যায়। চোদ্দটি পরিচ্ছেদ সমন্বিত এই উপন্যাসে বর্ণবাহুল্য প্রয়োগ করা হয়নি। ঘটনা সরল, মামুলি ও বর্ণ-বিরল। ব্যক্তির মনোলোকের রূপায়ণের দিকে লেখকের দৃষ্টি বেশি। শশী-কুসুম সম্পর্কের ইতিহাস ও বিবর্তন স্বল্প ঘটনার মধ্যে মানসিক নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বর্ণনাতে পর্যবসিত হয়েছে। পরিবেশ ও পটভূমিতে পরিচিত জগতের প্রকাশ বেশি। হারু ঘোষের কন্যার পাত্র নির্বাচনের জন্য মরীয়া চেষ্টা ও মৃত্যু, শহর থেকে পাশ করা ডাক্তারের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে বন্ধন, নানা পরিবারে তার যাতায়াত ও সহানুভূতিপূর্ণ সম্পর্ক, পরানের কৃষক-জীবন, কুসুমের অতৃপ্তি ও শশীর প্রতি তার পরকীয়া প্রণয়সঞ্জার, শশীডাক্তারের পরোপকারিতার প্রবৃত্তি, কবিরাজ মশায়ের পারিবারিক জীবনের নানা জটিলতা, গোপালের লোভ ও পুত্রের প্রতি তার অধিকারবোধের প্রসার ও আঘাত, কুমুদের যাত্রায় প্রবীরের বেশে দিগ্বিজয়-এসব ঘটনার মধ্যে প্রয়োজনীয় বর্ণযোজনা করেছেন লেখক। পট ও পরিবেশ জানাশোনা ও পরিচিত জগৎ-নির্ভর বলেই বাস্তবতাসন্ধানী লেখকের মন ও জীবন এখানে নিবিষ্ট। প্রতিটি ঘটনাকে লেখক এনেছেন শশীর জীবন-সন্ধান বা জীবন জিজ্ঞাসার বৃত্তে। এসবই উপন্যাসের প্রবহমান আঙ্গিকরীতির বা 'flat' বা সমতলবিহারী কাহিনীর সূত্রকে প্রমাণ করে। একজন বিশেষজ্ঞ সমালোচক এই প্রসঙ্গে বলেছেন “বিশ শতকের আধুনিক উপন্যাসের যে সাধারণ প্রবণতা— ঘটনার বিরলতা ও বর্ণবাহুল্য বর্জন এবং ঘটনার বদলে ব্যক্তির অন্তর্লোকের অধিকতর রূপায়ণ, বলা বাহুল্য এসবই 'পুতুল নাচের ইতিকথা'য় বর্তমান। ঘটনার চারপাশ থেকে রঙের চটক মুছে ফেলার জন্যে মানিক সর্বদাই যে নিতান্ত চেনা-জানা পট-পরিবেশ প্রয়োগে অভ্যস্ত, এখানে তার ব্যত্যয় হয় নি। শহর থেকে পাশ করা ডাক্তার-নায়ক, তার নীতিবর্জিত ধনী জোতদার পিতা, পরানের চাষি পরিবার, অল্পবয়স্কা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে বৃদ্ধ কবিরাজের পারিবারিক জীবনের জট, এ ছাড়া গ্রামের ছোটখাটো দোকানদার ও সাধারণ মানুষ— এইসব চেনাজগতের উপকরণ নিয়েই গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির পট-পরিবেশ। কিন্তু তবু বলবো, এই উপন্যাসের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতা সৃষ্টির উপযোগী ঘটনা, চরিত্র ও পরিবেশ সংক্রান্ত অনেক উপাদান থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিতে গভীর জীবনরহস্যের এক গূঢ় সংবেদন আভাষিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, তা ঘটনা বা পরিবেশ থেকে হয়নি, হয়েছে নায়ক শশীর গভীর আত্মজিজ্ঞাসার সূত্রে। বস্তুত উপন্যাসটিতে ঘটনার বস্তুরূপের মধ্যে, তার বিন্যাসের মধ্যে বাস্তবতার ঊর্ধ্বাচারী কোন রহস্যময়তা নেই, তা ক্রমশ উদ্ঘাটিত হয়েছে নায়কের চিত্তদর্পণে, তার তীব্র জীবন-অন্বেষণের অনুষঙ্গে।”


উপন্যাসের প্রকরণ সম্পর্কে মানিক ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-য় যে নতুন চিন্তাভাবনা করেছেন, তার প্রমাণ ‘শুভাশুভ' উপন্যাসের ভূমিকায় লেখকের উক্তি : “উপন্যাস লেখার পুরনো রীতি আজও অনেকে আঁকড়ে আছেন—সেটা এই যে উপন্যাসে কোন চরিত্র আনলে তার একটা গতি ও পরিণতির সম্পূর্ণতা দিতেই হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষটার কি হল। আমার প্রথম উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'য় আমি প্রথম এই নিয়ম ভঙ্গ করি।”


মতি-কুমুদ বৃত্তকে এই কারণে লেখক অসম্পূর্ণভাবে শেষ করেছেন, ভবিষ্যতে আর একটি খণ্ডে তা রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। কুমুদ ও মতি শেষে ট্রেনে উঠে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে। এখানে তিনি এই বৃত্তকে সম্পূর্ণতা দেননি, তাকে তিনি পরিণতির ছবি এঁকে দেননি। এখানে তিনি পুরোনো রীতি থেকে সরে গিয়েছেন। এই প্রকরণবৈশিষ্ট্য ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-র মধ্যে ফুটে উঠেছে বলে বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে এই উপন্যাসের অভিনবত্ব স্বীকৃত হয়েছে।


শশী-কুসুমের আখ্যান বিন্যাসে লেখক এই নীতি গ্রহণ করেননি। এই আখ্যান সমগ্র উপন্যাস ব্যাপ্ত করে আছে। এই আখ্যান শশী চরিত্রের ক্রম-উন্মোচনকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কুসুম-শশী সম্পর্কের গতি ও প্রবাহ লেখক প্রচলিত উপন্যাসের রীতিতে প্রকাশ করেছেন। অন্য কোন আখ্যানকে লেখক এইরকমভাবে ব্যবহার করেন নি। উপন্যাসটি নানা আখ্যানে বিভক্ত, নানা 'এপিসোডে' বিন্যস্ত। মতির প্রতি, কুমুদের প্রতি, সেনদিদির প্রতি, গোপালের প্রতি এবং সর্বোপরি কুসুমের প্রতি শশীর মনোভাব এসবই নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। কুসুমের প্রতি শশীর আকর্ষণের গোপন প্রবাহ শশীর গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগ্রহের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে refrain-এর সুরে বেজে উঠেছে। এসবই লেখকের আঙ্গিক রীতির বৈশিষ্ট্য।


মানিকের জীবনদৃষ্টির ও জীবনভাবনার প্রতিফলন তার আঙ্গিকরীতিতে পরিস্ফুট হয়েছে। 'দিবারাত্রির কাব্য' থেকে এই রীতির শুরু। এই রীতিকে বলা চলে প্রতীক-সংকেতধর্মী প্রয়োগরীতি। উপন্যাসটিতে পুতুলের প্রতীক বার বার ব্যবহার হয়েছে। সেনদিদির পুতুল- কুড়িয়ে পাওয়ার সম্ভাবনা, সিন্ধুর পুতুলখেলা, কুসুমের বাবা অনস্তের মুখে অপার্থিব পুতুল নাচের প্রসঙ্গ—এসব দিয়ে লেখক পুতুলের সঙ্গে মানবজীবনের সাদৃশ্যকে তুলে ধরেছেন। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসটি বাস্তবধর্মী উপন্যাস। তার মধ্যে ফুটে উঠেছে এই সংকেতের ব্যঞ্ছনা। এই উপন্যাসে কয়েকবার তালবনের ধারে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এই দৃশ্যটি উপন্যাসের ব্যানা হয়ে ফুটে উঠেছে। বাস্তবধর্মী বাতাবরণে এই রোমান্টিক ব্যঞ্ঝনা উপন্যাসে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-র আবেদন গূঢ় জীবন বাস্তবতার। মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার সীমা পেরিয়ে জীবন-বাস্তবতার ছবি আঁকা জীবনরহস্যভেদী শিল্পী-মানসের প্রধান কৃত্য। শশীর চঞ্চলতা, তার জীবনরহস্য সন্ধান এই উপন্যাসে নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে। জীবনের নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে শশীর মানস-প্রগতি এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু। লেখকের জীবনদর্শন পরিস্ফুট হয়েছে শশীর ভাবনার ব্যঞ্ছনানিপুণ ইঙ্গিতে : “নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে। মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে।”


এই জীবনভাবনাকে উপযুক্ত আধারের মধ্যে দিয়ে রূপায়িত করার মধ্যে শিল্পীর দক্ষতা। বিভিন্ন ‘এপিসোডে'র ঘটনাকে সজ্জিত করে এই জীবনদর্শনকে পরিস্ফুট করা হয়েছে। কুমুদ-মতি, কুসুম, সেনদিদি সবই এই জীবনদর্শনের আলোকে আলোকিত হয়ে একটি প্রকরণের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং একটি সমগ্র-সুষমায় সুষমান্বিত হয়েছে। বাংলা উপন্যাসে একদা ছিল “ঘটনা পরম্পরার বিবরণ”, তারপর অস্তবিষয়ের প্রকটনে যত্নবান। লেখক ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে অন্তঃবাস্তবকে যখন উপন্যাসে রূপ দিতে শুরু করলেন, তখন উপন্যাসের আঙ্গিক প্রকরণেও এল নির্বাচন পদ্ধতি, সংকেতধর্মিতা, একটি ‘থীমের’ সঙ্গে ‘প্লটের’ সমন্বয়। ফোর্ড ম্যাডক্স প্লট সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ‘অনিবার্যতা'-কে মুখ্য স্বরূপলক্ষণ বলেছেন। তাই আকস্মিকতার চমক না দিয়ে, কার্যকারণবিধি-ভিত্তিক ‘অনিবার্যতা' দিয়ে প্লটকে দেখার মধ্যেই প্লট-বোধের সার্থকতা। কেন মতি গাওদিয়ার মায়া কাটালো, কেন কুমুদের মতিকে ভাল লাগল, গোপালের সন্তানের প্রতি অতি-সতর্কতা কেন এবং সেনদিদির পুত্রের প্রতি তার স্নেহাতিরেক কেন, কুসুম কেন শশীকে আঘাত করেছে বার বার—এসব কিছুর কার্যকারণ-সূত্র প্লটের মধ্যে নিহিত আছে বলেই সব বিচ্ছিন্ন চিত্র, আখ্যান একটি দৃঢ়পিনদ্ধ গঠনের রূপ নিয়েছে। সমালোচকের ভাষায় একে বলে ‘organic plot'। 'পুতুল নাচের ইতিকথা'-র গঠন দৃঢ়পিনদ্ধ হলেও যান্ত্রিক নয়।


বিন্যাস পদ্ধতির দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, উপন্যাসের প্লট তিন প্রকার—(ক) বৃত্তাকার, (খ) পন্থাকার, (গ) হর্ম্যাকার। বৃত্তাকার প্লটে একটি কেন্দ্রস্থ সূত্র থাকে—ঘটনাগত বা দর্শনগত। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র প্রথম বাক্য ও অনুচ্ছেদ এবং শেষ অনুচ্ছেদ ও বাক্যটির মধ্যে একটি সম্পর্ক যদি রাখা যায়, তবে তা মনে হবে উপন্যাসটি বৃত্তাকার প্লটের। উপন্যাসের শুরু হয়েছে এইভাবে :—“খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছটার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।


হারুর মাথায় কাঁচাপাকা চুল আর মুখের বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না। শতাব্দীর পুরাতন তরুটির মূক অবচেতনার সঙ্গে একান্ন বছরের আত্মমমতায় গড়িয়া তোলা চিন্ময় জগৎটি তাহার চোখের পলকে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।”


উপন্যাসের শেষ হয়েছে এইভাবে : “মামলা করিতে শশী বাজিতপুরে যায়, ফিরিবার পথে চোখ তুলিয়া দেখিতে পায় খালের ধারে বজ্রাহত একটা বটগাছ শুকনো ডালপালা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গাওদিয়ার ঘাটে গোবর্ধন নৌকা ভিড়ায়। নন্দলালের পাপ-জমা করা শূন্য চালাটা প্রায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে দেখিয়া শশীর মনে হয়। নন্দলালের পাপ জমা করা বিন্দুর দেহটাও হয়তো এতদিনে এমনিভাবে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। জোরে আজকাল শশী হাঁটে না, মন্থর পদে হাঁটিতে হাঁটিতে গ্রামে প্রবেশ করে। গাছপালা বাড়িঘর ডোবাপুকুর জড়াইয়া গ্রামের সর্বাঙ্গসুন্দর রুপের দিকে নয়, শশীর চোখ খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ। যারা আছে তাদের, আর যারা ছিল। শ্রীনাথের দোকানের সামনে বাঁধানো বকুলতলায়, কায়েতপাড়ার পথে। যামিনী কবিরাজের বাহিরের ঘরে হামানদিস্তার ঠকঠক শব্দ শশী আজও শুনিতে পায়; এ বাড়ির মানুষের ফাঁক মানুষ পূর্ণ করিয়াছে। যাদবের বাড়িটা শুধু গ্রাস করিতেছে জঙ্গলে। পরানের বাড়িতেও এখনো লোক আসে নাই। তার ওপাশে তালবন। তালবনে শশী কখনো যায় না। মাটির টিলাটির উপরে উঠিয়া সূর্যাস্ত দেখিবার শখ এ জীবনে আর একবারও শশীর আসিবে না।"


এই দুই অনুচ্ছেদের মধ্যে যে বিরাট ঘটনাধারা, কাহিনীধারা ও মানুষের নানা সংঘাতের পরিণাম লক্ষ্য করা যায়, তা আখ্যানের বৃত্তাকার পরিণাম ছাড়া কিছু নয়। এই দিক থেকে কাহিনীর গঠনশিল্পের প্রকরণ ভাবনার আর এক দিক এখানে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তবে এই বৃত্তের কেন্দ্রে আছে পুতুল নাচের জীবনদর্শন, মানুষের “হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে”—এই সূত্র এই উপন্যাসের জীবনদর্শন বলে প্রকরণভাবনাও সেই দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।