শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চুয়াচন্দন' গল্পে চুয়া চরিত্রটি সম্পর্কে যা জানো লেখো।

'চুয়াচন্দন' গল্পের নায়িকা কে? তার চরিত্রটি সম্পর্কে সম্যক আলোচনা করো।


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক, রোমান্স, রহস্য প্রভৃতি বিভিন্ন ধারার গল্প উপন্যাস কাহিনীর রচয়িতা তিনি। 'কালের মন্দিরা', ‘গৌড়মল্লার', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' প্রভৃতি বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস এবং ‘অমিতাভ’, ‘রক্তসন্ধ্যা’, ‘বাঘের বাচ্চা’, ‘শঙ্খকঙ্কণ’ প্রভৃতি ইতিহাস সমৃদ্ধ গল্পের মায়াল্গুন বাঙালির মননে সঞ্জীবিত করেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।


শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নায়ক চরিত্র সৃষ্টিতে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর চিত্রক (‘কালের মন্দিরা'), বজ্রদেব ('গৌড়মল্লার), অর্জুনবর্মা ('তুঙ্গভদ্রার তীরে') প্রভৃতি নায়ক চরিত্রগুলি যেভাবে ফুটে উঠেছে, নায়িকা চরিত্র অঙ্কণে তিনি দক্ষতা দেখালেও কাহিনীতে নারী চরিত্রগুলি দৃপ্তময়ী হয়ে ওঠেনি সেভাবে। রট্টা যশোধরা, রঙ্গনা, যৌবনশ্রী, মণিকঙ্কণা, বিদ্যুন্মালা প্রভৃতি নারীরা অসাধারণভাবে চিত্রায়িত হলেও তেজোদ্দীপ্ত নায়কদের পাশে নিষ্প্রভ। তবে নায়কদের তেজোদ্দীপ্ত শক্তির প্রেরণা এঁরা অবশ্যই ছিলেন।


তাঁর উপন্যাসগুলির থেকেও 'চুয়াচন্দন' গল্পে নায়িকা চুয়ার চরিত্র বেশ নিষ্প্রভ। গল্পে চন্দনদাস, নিমাইপণ্ডিত এমনকি গৌণচরিত্র চুয়ার বৃদ্ধা ঠান্‌দি, মাধব প্রভৃতি চরিত্রগুলিও অনেক বেশি সক্রিয়। কিন্তু তবুও এই কাহিনীর নায়িকা হিসেবে আমরা চন্দনের বিপরীতে চুয়াকেই প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।


প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর পূর্বের বাংলার নবদ্বীপের কাহিনী এই 'চুয়াচন্দন' গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিমাইপণ্ডিত অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যের সময়কার পটভূমি কাহিনীকে আরও বিশ্বস্ত করে তুলেছে। তৎকালীন যুগের বাংলার এক ষোড়শী তরুণী চুয়া এই গল্পের নায়িকা।


গল্পের প্রথমে চুয়ার কোনো উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। নিমাই পণ্ডিতের প্রাণচঞ্চল উপস্থিতি ও নবদ্বীপের তৎকালীন সমাজচিত্রের দ্যোতনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। গল্পে এরপরে প্রবেশ ঘটে নায়ক চন্দনদাসের। সে অগ্রদ্বীপের বণিক তনয়। বাণিজ্য থেকে ফেরার পথে নবদ্বীপে বিশ্রামের জন্য নৌকা থেকে অবতরণ করে। এরপরে সে নবদ্বীপের রাজপথে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে চুয়াকে দেখতে পায়। এবং তার চোখ দিয়ে আমরা পাঠকেরাও প্রথমে চিনে নিই গল্পের নায়িকাকে— “মেয়েটি একজন বয়স্কা সহচরীর সঙ্গে ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছিল। পূর্ণযৌবনা ষোড়শী—তাহার রূপের বর্ণনা করিতে গিয়া হতাশ হইতে হয়। বৈষুব রসসাহিত্য নিঙড়াইয়া এই রূপের একটা কাঠামো খাড়া করা যাইতে পারে ; হয়তো এমনই কোনো গোরোচনা গোরী নবীনার নববিকশিত রূপ দেখিয়া প্রেমিক বৈষুব কবি তাঁহার রাই-কমলিনীকে গড়িয়াছিলেন, কে বলিতে পারে? মেয়েটির প্রতি পদক্ষেপে দর্শকের হৃৎকমল দুলিয়া দুলিয়া উঠে, যেন হৃৎকমলের উপর পা ফেলিয়া সে চলিয়াছে। তাহার মদির নয়নের অপাঙ্গদৃষ্টিতে মনের মধ্যে মধুর মাদকতা উন্মথিত হইয়া উঠে।”


চুয়ার এই স্নিগ্ধকোমল রূপ প্রথমেই প্রত্যক্ষ করে আমাদের মনে বৃন্দাবনের শ্রীরাধিকার ছবি ভেসে ওঠে। লেখকও শ্রীরাধিকার রূপের সঙ্গে চুয়ার রূপে অঙ্গীভূত করে দিয়েছেন। বৈয়ব মহাজনেরা ‘গোরোচনা গোরী নবীনার নববিকশিত রূপ’ কে লক্ষ করেই কানুর পাশে শ্রীরাধিকার মূর্তিকে এঁকে থাকতে পারেন। ফলে রাধা কোনো কল্পলোকের আরাধিকা নন তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে সুন্দিরী গোপকন্যা। এমনই এক স্নিগ্ধ সজল রূপ আমাদের আলোচ্য গল্পের নায়িকা চুয়া।


কিন্তু এরপরেই আমাদের দৃষ্টি ফেরান চুয়ার মনের গোপনে—“কিন্তু এত রূপ সত্ত্বেও মেয়েটির মুখখানি স্নান, যেন তাহার উপর কালো মেঘের ছায়া পড়িয়াছে।” চুয়ার রূপকে পাঠকের সামনে প্রত্যক্ষ করিয়ে হঠাৎ করে ‘মেয়েটির মুখখানি স্নান' বলে গল্পে চমক ও গল্পের বুনোটটিকে ধরে রেখে দেন গল্পকার।


চন্দনদাস চুয়ার ম্লান মুখ, প্রতিহারী বেষ্টিত করুণ অবস্থা, এত বয়স (চুয়া পূর্ণযৌবনা ষোড়শী) পর্যন্ত অনূঢ়া থাকা ইত্যাদি সব লক্ষ করে চুয়ার পশ্চাতে পশ্চাতে কৌতূহল বশত অগ্রসর হয় এবং নবদ্বীপের রাজপথের থেকে গলির অভ্যন্তরে এক বিপণির সন্ধান পায় এবং সেখানে এক বৃদ্ধা দোকানীকে দেখে পসরা সাজিয়ে বসে আছে। পরে তাঁর সঙ্গে ভাব জমিয়ে জানতে পারে ইনিই চুয়ার বৃদ্ধা ঠান্‌দি। চুয়া এই বাড়িতেই থাকে। হতভাগ্য চুয়ার জীবনের কাহিনী খুবই করুণ তার আভাসও প্রথমে বৃস্থা দিয়ে দেন– “আমাদের দুঃখের কাহিনী কাউকে বলবার নয়। সমাজ আমাদের বিনা দোষে জাতে ঠেলেছে, মুখ তুলে চাইবার কেউ নেই। আর কাকেই বা দোষ দেব, সব দোষ ঐ হতভাগীর কপালের। এমন রূপ নিয়ে জন্মেছিল, ঐ রূপই ওর শত্রুর।"


চুয়াকে প্রথম দেখায় যে রূপের পরিচয় আমরা পাই তাতে তাকে অসাধারণ সুন্দরী বলা যায়। কিন্তু এই ‘রুপ'ই তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।


বৃদ্ধার সঙ্গে কথোপকথনে চন্দন জানতে পারে চুয়ার দুঃখের কাহিনী বণিক কাঞ্চনদাসের মেয়ে চুয়া। কাঞ্চনদাস দূরদেশে বাণিজ্য করতে গিয়ে অকূলে হারিয়ে যান আর ফেরেননি, চুয়ার মা'ও একবছর পর মারা যান। কাঞ্চনদাসের মাসী এই বৃদ্ধা আয়ি চুয়াকে প্রতিপালন করে বড়ো করে তোলে। সংসারযাত্রাও নির্বাহ করা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল তাই বুড়ি পসরা সাজিয়ে বসে।


এরপরে চুয়ার দশ বৎসর বয়সের সময় জমিদারের পাষণ্ডতান্ত্রিক ভ্রাতুষ্পুত্র মাধব-এর চোখে পড়ে যায়। -সে। কামলোলুপ, নরপশু মাধব চুয়াকে শয্যাসঙ্গিনী করবার অভিপ্রায়ে তান্ত্রিক বামাচার সাধনার কথা বলে চুয়া যে শুধুমাত্র তার এটা জানান দিয়ে তার দাসী টাপাকে ওদের দেখাশোনার ভার দিয়ে চলে যায়। এক কামজর্জর, পাষণ্ড ব্যক্তির হাতে ফুলের মতো অপাপবিদ্ধা নারীর অপমৃত্যু দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বৃদ্ধার, মাঝখানে পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। চন্দনদাসকে দেখে তিনি আশায় বুক বাঁধেন যদি চুয়ার জীবন থেকে হতাশার কালো মেঘটা সরে যায়।


চুয়াও স্নান করতে যাবার সময় চন্দনকে দেখেছিল। প্রথম দেখে তার চন্দনকে ভালো লেগেছিল। তাদের গৃহে আবার চন্দনকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এইরকম—“চুয়ার কুমুদের মতো গাল দুটিতে কে যেন কাঁচা সিঁদুর ছড়াইয়া দিল। তারপর ম্রিয়মাণ লজ্জায় তাহার চোখ দুটি ধীরে ধীরে নত হইয়া পড়িল।” বিদেশি তরুণকে দেখে চুয়ার মুখাবয়বে যে লজ্জা, সম্মতি, ভালোলাগা, সম্ভ্রম সব কিছু ফুটে উঠেছে তা পরিষ্কার হয়ে যায় উপরিউক্ত এই অংশে।


চন্দন চুয়াদের সাহায্য করার আবেদন জানালে চুয়ার মুখে মুক্তির একটুকরো বাতাস ঝলকে ওঠে। কামুক, পাষণ্ড লোভীর পাশবিক অত্যাচারের যূপকাষ্ঠে ফুলের ন্যায় কোমল মেয়েটি কিছুতেই ধরা দিতে চায় না তাই গল্পকারের লেখনীভঙ্গিতে ধরা পড়ে চুয়ার মনের কথা— “চুয়ার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত নামিয়া মুখখানা সাদা হইয়া গেল। তাহার চোখে পরিত্রাণের ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষণ বিস্ফারিত আশার আলো ফুটিয়া উঠিল।” কিন্তু তারপরে আবার পুরুষজাতির ওপর বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে এবং বলেছে— “কেন আমাকে মিছে আশা দিচ্ছ?”


চন্দন এরপরে তাদের সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক শুনে এবং তাদের জাতিচ্যুত অবস্থা প্রত্যক্ষ করেও যখন তাকে ভালোবেসে বিবাহ করতে চেয়েছে এবং তাকে গৃহে নিয়ে যাবেও বলেছে। তখন বৃদ্ধা চন্দনকে নিমাই পণ্ডিতের মতামত জানতে যেতে বলেছেন এই বিবাহের ব্যাপারে। চন্দন এরপরে বলে নিমাই পণ্ডিত রাজি না হলেও সে চুয়াকে নিয়ে পালিয়ে দেশে চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে তাকে বিবাহ করবে। এতে বৃদ্ধা আশঙ্কিত হলেও চুয়া কিন্তু চিনে নেয় যথার্থ প্রেমিককে। চন্দনের মধ্যে সে দেখতে পায় প্রেমিকের মুগ্ধতা ও নিষ্পাপ ভালোবাসা। পুরুষের লোভ, কামুকতা দেখে সে ব্যথিত। পুরুষের অন্তরের এই ভালো দিকটিও চুয়ার চোখ এড়িয়ে যায় না।— “তুমি আজ রাত্তিরে এসো। নিমাই পণ্ডিত যদি রাজী না হন, তবু, তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস করে আমি তোমার সঙ্গে যাব।" যথার্থভাবেই এক প্রেমিকার অন্তর ভালোবাসার পবিত্রতা দিয়ে চন্দনের ভালোবাসাকেও পরখ করে নিল। বৃদ্ধা যতই আতঙ্কিত হোক, নিমাইপণ্ডিত রাজী না হলেও এই ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে অনিশ্চিতের পথে পাড়ি দিতে তার কোনো আপত্তি নেই। চুয়া বলেছে— "তোমার ধর্মের ওপর বিশ্বাস করে আমি তোমার সঙ্গে যাব।” চুয়া চন্দনের প্রেমধর্মের ওপর বিশ্বাস করে তার সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছে। তার কাছে লোক, লজ্জা সব কিছু তুচ্ছ। তারা কোনো দোষ করেনি। কিন্তু জমিদারের পাষণ্ড ভাইপো তার দিকে দৃষ্টি দেওয়াতে তারা সমাজে জাতিচ্যুত। যে সমাজ অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে নিরপরাধের ওপর শাস্তির খাঁড়াকে ঝুলিয়ে দেয়। সেই ঘৃণ্য সমাজের ভয়কে উপেক্ষা করে যথার্থ প্রেমিকের গলায় বরমাল্য পরিয়ে বরণ করে নিতেই চন্দনের সঙ্গে তার যাবার বাসনা।


এক্ষেত্রে চুয়ার প্রেমিকসত্তার জয় ঘোষণা দেখান গল্পকার। এরপরে চন্দনদাস চুয়াকে মাধবের হাত থেকে উদ্ধার করার সমস্ত পরিকল্পনা সেরে নেন নিমাইয়ের সঙ্গে। রাত্তিরে চুয়ার সঙ্গে গোপনে মিলিত হয়। চুয়া তখন যথার্থ প্রেমিকের জন্য উৎকণ্ঠিত। রাত্রের এই ক্ষণটি অত্যন্ত কাব্যশ্রীমণ্ডিত। চুয়ার মধ্যে যথার্থভাবেই প্রেমিকসত্তার উদ্বোধন ঘটে। আর এখানেই চুয়া চরিত্রকে মহিমান্বিত করে দেন গল্পকার।


সারা গল্পে মাত্র এই দু'জায়গাতেই চুয়া চরিত্রের সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। চুয়ার বিফল জীবনে পূর্ণতা এনে দিয়েছে প্রেমিক চন্দন। মূলত তার কার্যকুশলতায় চুয়া ট্র্যাজিক নায়িকা হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে উঠেছে।


জীবনের প্রথম পর্বে চুয়া নিষ্ক্রিয়। কিন্তু প্রেমের বন্যা তার চরিত্রকেও পূর্ণতা দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে চন্দন গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে এলে সে বলে—“তুমি আসবে বলেছিলে, তাই আমি তোমার জন্য সারা রাত জেগে আছি।” এতো কোনো নারীর সাধারণ বাণী নয় এ যেন—'অভিসারিকার প্রণয়বাণী'। প্রেমিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চুয়া তার জীবন যৌবন চন্দনকে সমর্পণ করে পরিপূর্ণা শ্রেয়সী নায়িকায় উত্তরিত হয়েছে—"চুয়া অশ্রু-আর্দ্র হাসিমুখ একবার চন্দনদাসের বুকের উপর রাখিল, অস্ফুটস্বরে কহিল, “চুয়া নয়—চুয়া বউ, এই আমাদের বিয়ে।”


চুয়ার এই উক্তিতে সাবেকী বঙ্গবধূর রূপটি ফুটে উঠেছে। আসল কথা হল অসাধারণ চরিত্র স্রষ্টা শরদিন্দু চুয়াকে আকৃতি প্রকৃতিতে মধ্যযুগের বাঙালি নারী করে গড়েছেন। আর এখানেই চুয়া চরিত্র সেভাবে সক্রিয় না হয়েও ‘চুয়াচন্দন' গল্পের নায়িকা স্তরে উন্নীত হয়েছে।