'ফসিল' গল্পের মধ্যে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্র এবং উদীয়মান ধনতন্ত্রের সংঘর্ষ দেখানো হলেও কাহিনীর পরিসমাপ্তিতে শোষক ও শোষিতের দ্বন্দ্বই চিত্রিত হয়েছে।”—এরূপ মন্তব্য কতদূর যথাযথ আলোচনা করে দেখাও।

ফসিল গল্পটির ছোটগল্প হিসেবে সার্থকতা বর্ণনা করো।


তিরিশের দশকে বাঙালি সাহিত্যিকদের ভাবনায় যে নতুন হাওয়া লেগেছিল তাতে এক নতুন পথে চলবার চেষ্টা তাঁরা শুরু করেছিলেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টা বিধৃত হয়ে আছে কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি-কেন্দ্ৰিক সাহিত্যকর্মে। এতে একদিকে যেমন আছে তিরিশের অর্থনৈতিক সংকটজনিত হতাশার প্রকাশ, ফ্রয়েডীয় ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত জীবনচিন্তার রূপায়ণের চেষ্টা, অন্যদিকে নিম্নবর্গের জীবন চিত্রণের মধ্য দিয়ে তাঁদের নতুন ভাবনার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠল যার প্রভাব এল মার্কসীয় জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচয়ে। সমাজব্যবস্থায় বিলীয়মান সামন্ততন্ত্র, উদীয়মান ধনতন্ত্র এবং শোষিত শ্রমিক-কৃষক সমাজের দিকে এই নবভাবনার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। রোমান্টিক জীবন নয় বা জীবনবিমুখতাও নয়, বাস্তব যে সংগ্রামী জীবন তারই রূপায়ণে এই সাহিত্যিকরা সচেষ্ট হলেন। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলা কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও ছোটগল্পে এই বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়ে আছে। তারাশঙ্করের 'গণদেবতা'য় বা শৈলজানন্দের 'কয়লাকুঠি'র মধ্য দিয়ে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের পরিচয় ও সংঘাতের লিপিচিত্রণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভেঙে পড়া সমাজব্যবস্থা যে নির্মোহ রূপ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে বা উপন্যাসে পরিস্ফুট হয়েছে তারই পটভূমিকায় এসেছেন সুবোধ ঘোষ। সুবোধ ঘোষের অভিজ্ঞতার পরিধিও যেমন বিস্তৃত, তেমন তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুও বিচিত্র। তাঁর প্রথম গল্প 'অযান্ত্রিকেই তাঁর পরিণত লেখনীর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর দ্বিতীয় গল্পটিই ‘ফসিল'।


'ফসিল' গল্পটিতে সুবোধ ঘোষের শিল্পনৈপুণ্য আরও পরিণত হয়েছে। এই গল্পের পটভূমিকায় লেখকের যে সমাজ-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে মার্কসীয় জীবনদর্শন খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সামত্ততান্ত্রিক শক্তি, ধনতান্ত্রিক শক্তি এবং উভয়ের দ্বারা শোষিত ও পীড়িত কৃষক-শ্রমিক সমাজের যে চিত্র আলোচ্য গল্পে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তা সমকালীন সামাজিক সত্যকেই প্রতিফলিত করেছে। এ গল্পে লেখক সমাজের প্রধান চারটি অংশকেই নিয়ে এসেছেন, অঞ্জনগড়ের রাজা সামস্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি, খনির মালিকেরা ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি, অর্জুনগড়ে কুর্মী প্রজারা এবং দুলাল মাহাতো নিঃস্ব, খেটে-খাওয়া বঞ্চিত কৃষক ও শ্রমিক সমাজের প্রতিনিধি। অঞ্জনগড়ের নতুন ম্যানেজার মুখার্জী হচ্ছে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত মানুষ যার শিক্ষা আছে, আদর্শ আছে, আদর্শকে রূপায়িত করার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য তাকে তার প্রভুদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় যদিও বিবেকের দংশনে সে পীড়িত হয়।


আধুনিক কালের সমাজব্যবস্থায় এই চারশ্রেণির মানুষেরাই হচ্ছে এ গল্পের পাত্রপাত্রী এবং এদের মধ্য দিয়ে নতুন ম্যানেজার মুখার্জীর যে অসহায়তা প্রকাশ পেয়েছে তা তিরিশ বা চল্লিশের দশকের মধ্যবিত্ত বাঙালি মনের অসহায়তা। মধ্যবিত্ত মানুষেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর কালে বিলীয়মান সামস্ততন্ত্র ও উদীয়মান ধনতন্ত্রের কঠোর বাস্তব রূপ দেখেছে এবং এদের অর্থনৈতিক শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত শোষিত মানুষদের নিরুপায় আর্তনাদ শুনেছে। এই শোষিত মানুষদের জীবনযন্ত্রণার অংশভাগ মধ্যবিত্ত মানুষদের আদর্শবাদ পরাভূত হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার মৌলিক তাগিদে। এখানেই তার ট্র্যাজেডি।


লেখক সুবোধ ঘোষ আলোচ্য গল্পে শুধু শোষক ও শোষিতের সংগ্রামই দেখাননি, তার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্তের জীবন যন্ত্রণার স্বরূপটিও সহানুভূতির সঙ্গে উদ্ঘাটিত করেছেন।


এ গল্পেও শোষক সমাজের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে একদিকে অঞ্জনগড়ের রাজা, অপরদিকে খনি-মালিকেরা। উভয়ই শোষক, কিন্তু উভয়ের স্বার্থ এক নয়, তাদের মধ্যে অর্থাৎ দুই সামাজিক শ্রেণির মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব রয়েছে, যে সামাজিক দ্বন্দ্বে উদীয়মান ধনিকশ্রেণির জয় এবং সামন্তশ্রেণির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থ যেহেতু তাদের উভয়ের স্বার্থবিরোধী, সেহেতু পরস্পর দ্বন্দ্বশীল দুই শ্রেণির মধ্যে একটা সাময়িক সমঝোতা হয়েছে তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার অন্তর্নিহিত স্বাভাবিক নিয়মেই চায় কৃষককে জমি থেকে, তার সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন থেকে মুক্ত করে শ্রমিক বানাতে, সামন্ততন্ত্র অবশ্যই তাতে বাধা দিতে চায়, ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘাত। কিন্তু চেতনাপ্রাপ্ত শ্রমজীবী সমাজ সংঘবদ্ধ হয়ে বাঁচার ন্যায্য দাবি আদায়ের চেষ্টা করে, তখন তা একই সঙ্গে সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। আর সেই বিপদের সম্মুখীন হয়ে স্বার্থপরায়ণ শোষকশ্রেণিই পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলায় এবং নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে যে কোনো মূল্যে সংগ্রামী শ্রমজীবীদের কণ্ঠ চিরকালের জন্য নীরব করে দেয়। ওদের যৌথ স্বার্থের বেদীতে এই নিঃস্ব দরিদ্র ও শোষিত ও শ্রমজীবী মানুষের উৎসর্গীকৃত হয়।


যৌথ প্রচেষ্টায় শ্রমজীবী মানুষদের সংগ্রামী প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেওয়ার মধ্য দিয়েই গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু এ কথা ব্যঙ্খনায় আভাসিত হয়েছে দুই শোষকশ্রেণির এই মিত্রতা নিতান্তই সামাজিক, পূর্বে আভাসিত দ্বন্দ্ব নিরন্তর বর্তমান এবং শ্রমজীবী শ্রেণিকেও তাদের প্রয়োজন কী জমিতে ফসল উৎপাদনে, কী কারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে। এই শ্রেণিদ্বন্দ্বে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা গৌণ মাত্র, মুখার্জীর নিষ্ক্রিয় অবস্থানে যা চিত্রিত।


আলোচ্য গল্পে চিত্রিত এই সমাজচিত্র একদিকে এক বিশেষ স্থান-কাল-পাত্রে সীমাবদ্ধ, তেমনি অপরদিকে নির্বিশেষ সার্বজনীন সত্যের প্রকাশক।


গল্পটি শুধু সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার রূপায়ণই পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেনি, এর পরিবেশ, চরিত্রচিত্রণ ও ঘটনা সংস্থাপনে একটি সার্থক ছোটগল্প হয়ে উঠেছে।