“হালদারগোষ্ঠী” গল্পের বনোয়ারিলাল চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

‘হালদারগোষ্ঠী' গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বনোয়ারিলাল হালদারের কর্মকাণ্ডের কাহিনি। এই হিসেবে বনোয়ারিলাল আলোচ্য গল্পের নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মর্যাদা লাভের যোগ্য। বনোয়ারিলাল জন্মসূত্রে হালদার পরিবারের বড়োবাবু। অর্থাৎ মনোহরলালের জ্যেষ্ঠপুত্র। পিতার পরে সেই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী ও কর্তৃ। ঘটনাচক্র যদি এই স্বাভাবিক পথে গড়িয়ে চলত, তবে কাহিনি লেখার মতো কোনো রসদ সেখানে পাওয়া যেত না। কিন্তু লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী এখানে পদ্মবনে মত্ত হাতীর উদ্দামতা থেকে কাহিনির বীজ সংগৃহীত হয়েছে। ফলে বনোয়ারিলালের চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণের অবকাশ পাওয়া যায়।


হালদার পরিবারের মধ্যে বনোয়ারিলাল ছিল যাকে বলা যেতে পারে উদ্যমী পুরুষ। সে তার পিতা মনোহরলাল বা ভাই বংশীর মতো সম্পত্তির গদীতে বসে বসে খাবার মানুষ নয়। সে কিছু করতে চায়। নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা আন্দোলন না হলে তার ভাল লাগে না। সেই স্বভাব অনুযায়ী তার শখ কুস্তি, শিকার ও সংস্কৃতচর্চা। এই তিন শখের দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, বনোয়ারি কুটিল মনের অধিকারী ছিল না, সে ছিল শৌখিন প্রকৃতির লোক। শিকার করাটা তার বিলাসিতার অঙ্গ ছিল। তার পশু হত্যার নিষ্ঠুরতার কোনো নিদর্শন গল্পকার আমাদের সামনে রাখেন নি। কিন্তু এ কথা জানতে পেরেছি যে, অন্যের বিপদের সময় বিবেচনা শূন্য হয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত উদ্ধার কল্পে। বিপন্নকে, আর্তকে উদ্ধার করার মতো কোমল চিত্তবৃত্তির অভাব তার ছিল না। অন্যদিকে বসন্তের স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় স্ত্রী কিরণের মনোরঞ্জনার্থে বহুবিধ সংস্কৃত শ্লোক সে আবেগ সহ আবৃত্তি করে শোনাতো।


স্ত্রী কিরণকে সে অত্যধিক ভালোবাসত। প্রাণের আবেগে কেবলই তার মনে হতো, কিরণকে দেওয়া উপহারগুলি কিরণের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই কিরণকে খুশি করার জন্যে নানা উপায় ও উপহারের উদ্ভাবন সে করত। কিন্তু যথেচ্ছ ব্যয়ের অধিকার তার না থাকার জন্যে স্ত্রীকে উপহার দেবার জন্যেও হাত পাততে হত হালদার পরিবারের বেতনভুক কর্মচারী নীলকণ্ঠের কাছে। এই পরাধীনতা সে সহ্য করতে পারে নি। শুধু এই উপহার প্রদানই নয়, কিরণের গর্ভে কোনো সন্তান হয়নি বলে নীলকণ্ঠ যখন কর্তাকে বনোয়ারির আবার বিয়ে দেবার পরামর্শ দিচ্ছিল, তখন বনোয়ারিই তাতে বাধা দিয়েছিল সর্বাগ্রে। তাই এই আচরণ থেকে স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা অনুমান করা যায়।


এখানে একটা কথা পরিষ্কার যে বনোয়ারি ছিল প্রেমিক প্রকৃতির মানুষ। যদিও তার সে প্রেমের অধিকাংশই প্রবাহিত হত কিরণের দিকে, তবুও প্রজাকুলের জন্যেও তার হৃদয় অবারিত দ্বার ছিল। এই সূত্র ধরেই মধু কৈবর্ত আপন স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে বনোয়ারিকে জালে জড়িয়েছিল। বনোয়ারিও প্রেমের বীর্যে কিরণকে খুশি করার ভাবনায় আবেগতাড়িত হয়ে মধুর ফেলা জালে আবদ্ধ হয়ে স্ববংশের অহিত সাধনায় মেতে উঠেছিল। এই কাজে সে যখন দেখল, তার পাশে পরিবারের আর কেউ নেই, এমনকি কিরণ পর্যন্ত তার কাজকে সমালোচনা করছে, তখনই সে বিদ্রোহের পথে চলতে শুরু করল। নিজেকে এবং হালদার পরিবারকে সমূলে নাশ করা ছাড়া তখন তার আর অন্য কেনো চিন্তাই রইল না। যার ফলে হালদার পরিবারের সম্ভাব্য কর্তা ক্রমে ক্রমে পরিবারের বেতনভুক সদস্যে পরিণত হল। এই পরিণতি তার কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সে কেবল চেয়েছিল নিজের মতো করে স্ত্রীকে উপহার দিতে। সে নিজে বাড়ির ভবিষ্যৎ কর্তা অথচ তাকে বাড়ির এক কর্মচারীর অর্থমজুর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করতে হত। এমনকি একমাত্র আদরের ভাইপো হরিদাসকে পর্যন্ত আদর করার অধিকার তার ছিল না। সকলে এমনকি কিরণ পর্যন্ত মনে করত হরিদাসকে সে ফেলে দেবে নয়তো আঘাত করে ক্ষতি সাধন করবে। পরিবারের সদস্য তথা সর্বময় কর্তার আসন থেকে চ্যুত হয়ে সে সর্বত ভাবে একা ও পরাধীন হয়ে গিয়েছিল। এই পরাধীনতা সহ্য করতে সে পারেনি। তারই পরিণতিতে সে পরিবার ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল।


বনোয়ারি সব দিক থেকে বঞ্চিত হয়ে সংগ্রামের পথে সংহারের পথে চলে গেলেও তার শেষ পর্যন্ত কোমল চিত্তবৃত্তির অবলুপ্তি হয় নি। তার পরিচয় পাওয়া যায়, হালদার পরিবারের সম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ চুরি করে নষ্ট করার উদ্দেশ্যে যখন সে দলিলগুলি হাতে নিয়ে বাইরে যাচ্ছিল, সেই সময় এক বৃদ্ধার ঘরে আগুন লেগেছে দেখে সে তৎক্ষণাৎ তাকে রক্ষা করার জন্যে দলিলের কাগজগুলো গাছ তলায় ফেলে রেখেই দৌঁড়েছিল। তারপর সেই কাগজপত্র ভাইপো হরিদাস যখন তাকে ফিরিয়ে দিল, তখন সে সমস্ত রকম বিদ্বেষ ভুলে হরিদাসকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে অন্তঃপুরে গেল। মনের ওপরে জমা কঠিন নির্মম প্রলেপ অশ্রুস্রোতে বিগলিত হয়ে আবার সে আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিরণের কাছে চুরি করা সমস্ত দলিলপত্র ফিরিয়ে দিয়ে সে বলেছিল, ‘আমাকে আর ভয় কোরো না।' এরপর কাহিনির অবশেষ পরিণতিতে দেখি বনোয়ারি তার পিতার শ্রাদ্ধ না করে চাকরি খুঁজতে বাইরে চলে গেল।


সব মিলিয়ে আলোচ্য গল্পের মধ্যে বনোয়ারির যে চরিত্র চিত্রিত হয়েছে, তাতে সে হৃদয়বান ব্যক্তি, পরদুঃখে কাতর। স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসা নিখাদ। অন্যদিকে সে উদ্যমী। সেই জন্যে কোনো কাজ করতে গিয়ে কোনো বাধা সে মানে না। তার নিগূঢ় প্রেম ভাবনাই তাকে ক্রমশ সংহারের পথে নিয়ে গিয়েছিল। তবে আদ্যস্ত বনোয়ারি যে একটি রক্তমাংসের মানুষ গল্পকারের নিখুঁত তুলির টানে এ চিত্রই ফুটে উঠেছে।