'একেই কি বলে সভ্যতার উপাদান গ্রহসনকারের অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদান।'—আলোচনা করো।

ইতিহাসের উপাদানের সাহায্যে ও পুরাণ উপাদানের সাহায্যে ‘কৃষ্ণকুমারী', ‘শর্মিষ্ঠা' নাটক রচনার পর মধুসূদন সমাজ বা জীবিত চরিত্রকে কেন্দ্র করে নাটক লিখতে মনস্থ করেন। তার ফলশ্রুতিতে তিনি তৎকালীন সামাজিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনটি রচনা করেন। অবশ্য প্রহসনটি যে মধুসূদনের অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদানের রূপায়ণ যে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কেননা, মধুসূদনের আলোচ্য প্রহসনে যে চিত্র, চরিত্র অঙ্কিত তা যে যথার্থ ও সত্য এ বিষয়ে সাক্ষ্য পাওয়া যায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের, রামগতি ন্যায়রত্নের এবং যোগীন্দ্রনাথ বসুর রচনায়।


১। “ইয়ং বেঙ্গল অভিধেয় নববাবুদিগের দোষোদঘাটন বর্তমান প্রহসনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং তাহা যে অবিকল হইয়াছে ইহার প্রমাণার্থে আমরা এইমাত্র বলিতে পারি যে, ইহাতে যে সকল ঘটনা বর্ণিত হইয়াছে ৎসমুদয়ই আমাদিগের জানিত কোনো না কোনো নববাবু দ্বারা প্রচারিত হইয়াছে।”


2 "This farce is undoubtedly one of the happiest reproductions of the fertile brain of the gifted poet. It is a life-like picture of young Bengal full of sallies of art and humour and written in familiar graceful Bengali"


৩। “বাংলার পক্ষে লজ্জার বিষয়, এ ছবি নিতান্তই সত্যের প্রতিরূপ। শিক্ষিত মার্জিত শ্রেণীর মানুষ ইউরোপীয়দের বক্তৃতায় যেমন বিহ্বল হন, তথাকথিত সংস্কারকদের পাগলের মতো ইংরেজি শব্দসম্ভারবহুল বাগাড়ম্বরে নিশ্চয় মোহগ্রস্ত হবেন না। অস্বীকার করা যায় না, এই সব সংস্কারক আসলে স্বল্পশিক্ষিত বাবুশ্রেণীর প্রতিনিধি।”


৪। 'মধুসূদন তাঁহার প্রহসনে যে চিত্র অঙ্কিত করিয়াছিলেন তাহা কোনো বিষয়ে বিন্দুমাত্রও অতিরঞ্জিত নহে।'


৫। রামগতি ন্যায়রত্ন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র চিত্রগুলিকে যথাযথ বলেছেন।


৬।‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র মধ্যে মধুসূদনের সমসাময়িক কলকাতার সমাজের একটি পূর্ণ রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্বল্পপরিসরের মধ্যে অনেকগুলি চিত্র ধরা হয়েছে বলে চিত্রগুলি চলচ্চিত্রের ন্যায় দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে। কোনো চিত্র বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারেনি, কিন্তু স্বল্পকালের মধ্যেই তা দর্শকচিত্তে রেখাপাত করে। ইয়ংবেঙ্গলদের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তা, মদ্যাসক্তি ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ উদ্ঘাটন করাই মধুসূদনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমাজের একটি সামগ্রিক রূপই তিনি তুলে ধরেছেন।”


তা ছাড়া প্যারীচাঁদ মিত্র লিখিত 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত্র', শিবনাথ শাস্ত্রী লিখিত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে যে চিত্র অঙ্কিত হয় তার সঙ্গে মধুসূদনের ‘একেই কি সভ্যতা?’য় অঙ্কিত চিত্রের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং 'একেই কি বলে সভ্যতা' গ্রহসনটি যে মধুসূদনের অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদান এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।


সমালোচ্য প্রহসনে ইয়ংবেঙ্গল নামে তথাকথিত আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কলেজে পড়া মদ্যপায়ী, ভ্রষ্টাচারী, ভোগাবিলাসী, বারবিলাসী যুবসম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাচারী রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। এদের জীবনের কপটতা, দুরাচার, শ্রদ্ধাহীনতা, আপন ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে অবজ্ঞাকে তুলে ধরা হয়েছে বলেই মধুসূদন এর নাম দিয়েছেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?”। নামকরণটি অবশ্যই বিদ্রূপাত্মক। আলোচ্য গ্রহসনে রূপায়িত কপটতা সেকালের সমাজে যে কত প্রবল ছিল তা শিবনাথ শাস্ত্রীর আলোচনা থেকে জানা যায়। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সুরাপানের প্রবণতা ও অন্যান্য অসামাজিক কার্যের প্রবণতা ক্রমবর্ধিত হচ্ছিল। রাজনারায়ণ বসু ও প্যারীচরণ সরকার ‘সুরাপান নিবারণী' সভা স্থাপন করেছিলেন। সুকুমার সেন মনে করেন, প্যারীচাঁদ মিত্র লিখিত ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ গ্রন্থটির কাহিনী সম্ভবত মধুসূদনকে ‘একেই কি বলে সভ্যতা' প্রহসনটি রচনার প্রেরণা দিয়েছিল।


প্রহসনে সিকদার পাড়ার যে চিত্র আছে তার বাস্তবভিত্তি সম্পর্কে সন্দেহ নেই। এমনকি তৎকালীন যুগে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সভা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল আলোচ্য প্রহসনে তার হাস্যকর ভণ্ডামির দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে হয়। অবশ্য সমস্ত সভাই যে এমন ছিল তা বলা যাবে না। প্রহসনটির সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা চলে যে, ইয়ংবেঙ্গল সমাজের তরুণ সম্প্রদায়ের সমাজসংস্কারের ভড়ং, মদ্যপান, লাম্পট্য ও গণিকালয়ে গমনের যে প্রবণতা বহুল পরিমাণে দেখা দিয়েছিল মধুসূদন তাকেই আলোচ্য গ্রহসনে রূপায়িত করেছেন বলে প্রহসনটির ভিত্তি হল মধুসূদনের অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদান।