'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসটিতে সমসাময়িক দেশ ও কালের স্পন্দন ধরা পড়েছে"— আলোচনা করো।

অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের কালপর্ব এদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য পর্ব। গ্রন্থটির কাল ১৯৭৭। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আকাশ তার কিছুদিন পূর্ব থেকেই আচ্ছন্ন। ভারতের শাসকশক্তি তথা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে পুঞ্জিত অসন্তোষ সাধারণ মানুষের দ্বারা ধ্বনিত হয়ে ওঠে। ১৯৭৪-এর ৮ই মে সারা ভারতে রেলধর্মঘট চলতে থাকে। এই ধর্মঘট স্থায়ী হয় কুড়ি দিন পর্যন্ত। এই ধর্মঘট ভারতবর্ষের প্রতিবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২৮শে মে এই ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু এই ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে জনমানসের বিদ্রোহাত্মক দিকটি ঐতিহাসিক মূল্য লাভ করে। রাষ্ট্রবিরোধী গণবিক্ষোভকে দমন করতে ‘মিসা’ আইন প্রয়োগ করা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে ২৪শে সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন অটলবিহারী বাজপেয়ী। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে তখন গণ-আন্দোলন দিকে দিকে মাথা তুলছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দীন আলি আহমেদ ৩৫৯ ধারা প্রয়োগ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন ভারতের মাটিতে জরুরী অবস্থা জারী হয়। এই ভয়ংকর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কালে মহাশ্বেতা দেবী 'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসটি লেখেন।


‘অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসের বিষয়বস্তু বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন। সমকালীন দেশ ও কালে যে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই উপন্যাসের মুণ্ডা বিদ্রোহকে প্রণিধান করা যায়। লেখিকা যে কালের বুকে এই উপন্যাসটি লেখেন, সেই কালটি আসলে বিদ্রোহ-বিপ্লবের অগ্নিগর্ভ সম্ভাবনায় পূর্ণ। এই কাল শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কাল। সাহিত্যিক দায়বদ্ধ মানুষ। ইতিহাসের প্রতি মানুষের প্রতি, দেশ ও কালের প্রতি প্রতিটি সাহিত্যিকই দায়বদ্ধ।


মহাশ্বেতা দেবী ভূমিকায় লিখেছেন— “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরসা মুণ্ডার নাম ও বিদ্রোহ সকল অর্থেই স্মরণীয় ও তাৎপর্যময়। এ দেশের যে সামাজিক ও অর্থনীতির পটভূমিকায় তাঁর জন্ম ও অভ্যুত্থান তা কেবলমাত্র এক বিদেশী সরকার ও তার শোষণের বিরুদ্ধে নয়, একই সঙ্গে এ বিদ্রোহ সমকালীন ফিউডাল ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। এ সমুদয় ইতিহাসের বিবেচনা ভিন্ন বীরসা মুণ্ডা ও তাঁর অভ্যুত্থানের বিবেচনা অসম্ভব।

লেখক হিসেবে, সমকালীন সামাজিক মানুষ হিসাবে, একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায়দায়িত্ব বহনে আমরা সর্বদাই অঙ্গীকারবদ্ধ। দায়িত্ব অস্বীকারের অপরাধ সমাজ কখনোই ক্ষমা করে না। আমার বীরসা কেন্দ্রিক উপন্যাস সে অঙ্গীকারেরই ফলশ্রুতি।”


এই উক্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে 'সামাজিক মানুষ' হিসেবে, 'একজন বস্তুবাদী ঐতিহাসিকের সমস্ত দায়দায়িত্ব’ গ্রহণ করে লেখিকা এই উপন্যাসের আলেখ্য রচনা করেছেন। এই কারণে সমসাময়িক দেশ ও কাল তাঁর উপন্যাসে যে প্রেরণা সৃষ্টি করবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।


‘অরণ্যের অধিকার’ ১৮৯৫-১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ শাসক শক্তির বিরুদ্ধে, ‘দিকু’দের বিরুদ্ধে, ‘মিশনারী’দের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনী। মুণ্ডা-শবর-হো-কোল প্রভৃতি প্রান্তিক জাতিবৃত্তের দমন-পীড়ন যে কী নির্মমভাবে সংঘটিত হত, তা লেখিকাকে জ্বলন্তভাষায় প্রতিবাদী করতে সাহায্য করেছে। সমসাময়িক কালে ভারত সরকারের রাষ্ট্রশক্তির ‘মিসা’ আইনপ্রয়োগ বা 'emergency'-র প্রয়োগের ফলে সারা ভারতে যে কালা যুগ নেমে এসেছিল, এই উপন্যাসে তারই সমান্তরাল রূপ প্রতিফলিত হয়েছে। 'অরণ্যের অধিকার'-এর বিষয়বস্তুর সঙ্গে 'মিসা' প্রবর্তিত ভারতের সামাজিক জীবনে যে অবর্ণনীয় দমন নিপীড়নের চিত্র পাওয়া যায়, তার প্রতিতুলনা খুঁজে পাওয়া যায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত, পুলিশ লক-আপে রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যু। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের এমন অধ্যায় কেবল ছোটনাগপুরের মাটিতেই একদা দেখা দিয়েছিল। "স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুণ্ডা বীরসাইতদের বিরুদ্ধে ইংরেজ প্রশাসনের সামরিক অভিযান, সরলপ্রাণ মুণ্ডাদের সারল্যের সুযোগ নিয়ে মুণ্ডা জনপদগুলিতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা সত্তর দশকের ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের চিত্রের সঙ্গে সমতুল্য।”


'অরণ্যের অধিকার' উপন্যাসটি সমাজবাদী ভাবনা সমৃদ্ধ উপন্যাস। সমানাধিকারের ভিত্তিতে যে গ্রামসমাজ রচিত হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসন একে সেই গণতন্ত্রীকরণের মূলে কুঠারাঘাত করল। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে লিখেছেন “ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই তারা শোষণ উৎপীড়নের শিকারে পরিণত হয়। এই অমানুষিক শোষক-শ্রেণির অবসান ঘটাবার জন্য মুণ্ডারা ব্রিটিশ শাসনকালে একাধিকবার বিদ্রোহ করেছে। তীর-ধনুক, টাঙ্গি-বল্লম নিয়ে হিন্দু, মুসলমান, জমিদার ও মহাজন গোষ্ঠীকে বিচূর্ণ করতে চেয়েছে। তাদের খেতখামার, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে শোষণ অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছে......। মুণ্ডা অধিবাসীদের সবচেয়ে স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম হয় বীরসা মুণ্ডার আবির্ভাবে। বিদেশী ইংরেজ শাসন, শোষণ, জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিনি জীবন উৎসর্গ করে গেছেন।” ঐতিহাসিক ধীরেন্দ্রনাথের এই বর্ণনাকে দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেখলে উপন্যাসটির তাৎপর্য আরো গভীরভাবে প্রণিধান করা যাবে। তৎকালীন বলতে 'এমার্জেন্সীর' আন্দোলন, ‘মিসা’-র বিরুদ্ধে জাতীয় বুর্জোয়ার রাজনৈতিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের গণবিক্ষোভ।


‘অরণ্যের অধিকার' আসলে ‘দিকু' অধিকৃত অরণ্যমায়ের পুনর্বাসনের ইতিহাস। অরণ্যমাটির কান্না বীরসা শুনতে পেয়েছেন। তাই তিনি সমগ্র বিদ্রোহের আয়োজন করে এই 'উলগুলান' কে গড়ে তুলেছিল। বীরসা মুণ্ডা হয়ে উঠল নিপীড়িত মানুষের ত্রাণকর্তা। তাই সে শোষিত মানুষের কাছে হয়ে এল 'ধরতি-আবা”। “মহাশ্বেতার সব লেখাই এক ধরনের প্রতিবাদ" ― (ভারতী মুখোপাধ্যায়)। এই প্রতিবাদী বহ্নিশিখা সেকালের দেশ ও কালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নায়কবৃন্দের কর্মকাণ্ডেই প্রতিফলিত। দেশ ও কালের স্পন্দন স্পন্দিত হয়েছে বলে উপন্যাসটি এতখানি বাস্তবধর্মী।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “কিছু রচনা ইতিহাস-ভিত্তিক, কিছু কিছু গল্প-উপন্যাস সমসাময়িক বাস্তবতার তীব্র রূপ।” ‘হাজার চুরাশির মা' এই সমসাময়িক বাস্তবতার আলেখ্য, 'অরণ্যের অধিকার' মুণ্ডা জাগরণের পটভূমিতে লেখা এক বাস্তবধর্মী কাহিনী যেখানে সমসাময়িক দেশ ও কাল স্পন্দিত হয়েছে। একজন পণ্ডিত সমালোচনা লিখেছেন— “মহাশ্বেতা দেবী বাংলা কথাসাহিত্যে যুদ্ধোত্তর কালের সমাজভাবনার অন্যতম প্রতিভূ। সমাজচিস্তায় যে পরিবর্তনের অঙ্গীকার আজ দিকে দিকে প্রজ্বলন, মহাশ্বেতা দেবী সেই চিন্তাভাবনাকে তাঁর উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন" (ড. গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়)। যুদ্ধোত্তর স্বদেশী ও বিদেশী উপন্যাসে প্রতিবাদ ও গণতন্ত্রমুখীনতাই প্রাধান্য পেয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী সেই বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকারী বলে দেশ ও কালকে তাঁর উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়।


উপন্যাসে ‘দিকু’দের অত্যাচারের চিত্র নানাভাবে রেখাঙ্কিত। “দিকুতে দিকুতে দেশ ছেয়ে গেল। খুঁজলে একটা মুণ্ডা মিলে না, যার ঘরে দশটা টাকা আছে। সব ভিখিরি হয়ে গেলাম।" করুমি, ওর মা বলত, “সংসারটা হয়ে গেল ছেঁড়া কানির মত, এদিকে সিয়াই ওদিকে ছেঁড়ে”। দারিদ্র্যের এমন নিখুঁত বর্ণনা দুর্লভ। দারিদ্র্য পীড়িত মুণ্ডারা দিক্‌-মহাজন-মিশনারি শোষিত ও অত্যাচারিত। বেঠবেগারী, করভাবে প্রপীড়িতদের সামনে “নতুন দিন এনে দেবে বীরসা" ধানী তার স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে তুলে এনেছে 'দিকু’দের অবর্ণনীয় অত্যাচারের চিত্র “দিকু ঘোড়া চায়, মুণ্ডা পয়সা দিবে। দিকু পালকি চায়, মুণ্ডা দাম দিবে, কাঁধে বইবে। দিকু যা চায়, সব দিবে মুণ্ডা। 'দিকু'র ঠিকাদারকে সাহেবের আদালতে জরিমানা করলে টাকা যোগাবে মুভারা।” মুণ্ডারা এইভাবে ‘দিকু'-দের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে চলেছে। এই অত্যাচার, এই মাটি থেকে উচ্ছেদ সত্তর দশকের ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সমসূত্রিত। তাই এই উপন্যাসে দেশ ও কালের স্পন্দন অনুভব করা যায়। এ উপন্যাসে সময়ের ভূমিকা মুখ্য। কেন না সময় বড় বিস্ফোরক, অস্থির, ব্যঘ্র। সময়ের হাতে তীর, হৃদয়ে জ্বালা, চোখে একাগ্র লক্ষ্য।" বীরসার রত্নে কাদে এক নগ্নিকা জননী অরণ্যকা। 'অরণ্যের অধিকার' সমাজ মুক্তির কাহিনী, 'উলগুলানের কাহিনী'। 'সে বোলোপে-বোলোপে গান গাও হে। রাত দেখ না, তোমার আমার গানের পারা কালো, তারাগুলো গান শুনবে বলে নামুতে এসে দেখতেছে। জঙ্গলে বাতাসে বহে যায়। জগল জেগে উঠেছে। ঝিমাঝিমা পাতার শব্দ শুনে।" এই উপন্যাসের ধ্রুপদ—“উলগুলানের শেষ নাই। ভগবানের মরণ নাই।" বীরসার অভ্যুত্থান যে ঐতিহাসিক, অর্থনীতিক পটভূমিতে, তা আসলে ভারতবর্ষের দেশ ও কালের চিত্র। “আমি বিশ্বাস করি ইতিহাসচেতনা এমন হওয়া বাঞ্ছনীয় যা বর্তমান সময়কে বুঝতে সাহায্য করবে” – (শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের কথা)। এইভাবে বীরসা মুণ্ডার অভ্যুত্থান ও জাতিবৃত্তের ইতিহাসের মধ্যে সমসাময়িক দেশ ও কাল ধরা পড়েছে।