উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার' নাটকটি উনিশ শতকের নাট্যসংস্কৃতির ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও নাটকটিতে আসলে প্রতিফলিত হয়েছে সে যুগের সার্বিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আবহটি—আলোচনা করো।

উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার' নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের জন্য কুখ্যাত ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটটিকে অর্থাৎ 'টিনের তলোয়ার' নাটকের প্রেক্ষাপটটি শুধুমাত্র বাংলার সাংস্কৃতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকটি রচিত ও অভিনীত হয়েছিল বাংলার জাতীয় সাধারণ নাট্যশালার শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে। নাটকের ভূমিকায় নাট্যকার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকের সেই নাট্যকর্মীদের, যাঁরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলার নাট্যসংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনাকে প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন—“বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষগুলিকে— যাঁহারা কুন্ঠগ্রস্ত সমাজের কোনো নিয়ম মানেন নাই, সমাজ যাঁহাদের দিয়াছিল অপমান ও লাঞ্ছনা, যাঁহারা মুৎসুদ্দিদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীর মুখোস টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই, যাঁহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয়-বেদনাকে দিয়েছিলেন বিদ্রোহ মূর্তি।”


মনে রাখতে হবে, বাংলার সাধারণ জাতীয় নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। এর পূর্বে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে নবীন বসুর শ্যামবাজার থিয়েটার, ১৮৫৭-তে শরৎচন্দ্র ঘোষ ও চারুচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে স্থাপিত সাতুবাবুর থিয়েটার বা ১৮৫৮-তে প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়া থিয়েটার ইত্যাদি নাট্যশালাগুলি মূলত ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ছত্রছায়ায় লালিত ও পোষিত। এই নাট্যপ্রেমী ধনী ও অভিজাতরা আবার ছিলেন ব্যবসায় ও জমিদারি সংক্রান্ত কারণে ইংরাজ-আশ্রিত। ফলে তাঁদের নাট্যশালাগুলিতে ইংরাজবিরোধী তীব্র জাতীয় চেতনামূলক নাটক অভিনয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করলেও সে নাটক কোনো ধনীগৃহের রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়নি। অথচ ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার ক্রমাগত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো ভূমিরাজস্বনীতির নির্মম প্রয়োগে এবং দমন-পীড়নমূলক প্রশাসনিক কঠোরতায় সমগ্র দেশকে যে চূড়ান্ত দারিদ্র্য ও অপমানে লাঞ্ছিত করছিল, তার বিরুদ্ধে দেশের ভিতরে ভিতরে জনমনে সঞ্চিত হচ্ছিল বিদ্রোহের আগুন। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একাংশ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন যে, ইংরেজ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সভ্যতার এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা, যুক্তি-বুদ্ধি, ন্যায়বিচার ও নবজাগরণের সঞ্চার করলেও কার্যত সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক শোষণই সেই শাসনের প্রধানতম উদ্দেশ্য। দেশের সম্পদ শোষণ করে গ্রেট ব্রিটেনের সমৃদ্ধিই ইংরেজ শাসনের লক্ষ্য। ভারতবর্ষের কাঁচামাল, খনি ও কৃষিজাত পণ্য, বিশেষত দেশের খাদ্যশস্য ইংলন্ডে পাচার করে ভারতবর্ষকে সার্বিকভাবে নিঃস্ব করে তুলছে ইংরেজরা। ফলে ভারতীয় কৃষি ও কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন, দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ, সারা দেশে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া—ইত্যাদির পশ্চাতে যে ঔপনিবেশিক ইংরেজের শোষণমূলক শাসনই দায়ী, একথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল সচেতন শিক্ষিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় দীক্ষিত ভারতীয়দের কাছে।


এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার বিদ্রোহমূর্তিকে নানা দমনপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কণ্ঠরোধ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকার। সরকারের এই দমনমূলক নীতিরই অন্যতম দৃষ্টান্ত ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন। বিদ্রোহের আশঙ্কায় সদাশঙ্কিত ইংরেজ সরকার বাংলার রঙ্গমঞ্চের কৃত্রিম টিনের তলোয়ারের বিদ্রোহাত্মক আস্ফালনেও সন্ত্রস্ত হয়ে জাতীয়চেতনামূলক নাটকের কণ্ঠরোধ করতে চেয়েছিল ১৮৭৬-এর নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মাধ্যমে।


ইংরেজ সরকারের পুঁজিবাদী শাসনকাঠামো এবং বেনিয়াবৃত্তি অনিবার্যভাবেই ভারতীয়দের মধ্যে একটি স্বার্থলোভী আত্মমর্যাদাহীন বশংবদ শ্রেণি তৈরি করেছিল। ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দৌলতে ক্রমশ বিপুল অর্থবান হয়ে ওঠা এইসব জমিদার বাবুশ্রেণির মধ্যে স্বভাবতই রুচিহীনতা, নীতিহীনতা, কুশিক্ষা, মদ্যবিলাস, ব্যভিচার, লাম্পট্য প্রবল হয়ে উঠছিল। ব্যভিচারী বিলাসের মোহে আকণ্ঠ নিমগ্ন এই বাবু-মুৎসুদ্দিশ্রেণি ইংরেজ রাজপুরুষদের পদলেহন করে, তাঁদের ব্যবসার উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হাস্যকর নকলনবিশী করে, ইংরেজপ্রদত্ত 'রায়বাহাদুর’ ‘রাজাবাহাদুর' ইত্যাদি খেতাবে কৃতার্থ হয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদার দাবিদার হয়ে উঠছিলেন। আর সমাজের অভিজাত স্তরে সম্মান অর্জনের মোহেই তাঁরা মুর্খ ও রুচিবোধহীন হয়েও সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রসর হয়েছিলেন। উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার' নাটকে তৎকালীন এই সার্বিক প্রেক্ষাপটটিই উঠে এসেছে।


নাটকের প্রারম্ভে ‘দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’ ও তার নট-নির্দেশক কাপ্তেনবাবুর যে পরিচয়টি ফুটে ওঠে, সেখানেই সে যুগের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবকে বিস্মৃত হয়ে বেণীমাধব চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষিত সংস্কৃতিকর্মীর নাট্যবিলাসের অন্তঃসারশূন্যতাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিক্ষিত বাবুশ্রেণির জীবনবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতিচর্চার এই মূল্যহীনতাকে নাটকের প্রথমেই স্পষ্ট করে দেয় মেথর মথুর। বেণীমাধবের প্রশ্নের উত্তরে মেথর মথুর জানিয়ে দেয় যে, সে পড়তে পারে না এবং মহাকবি মধুসূদনের সে নামও শোনেনি। মথুর থিয়েটার দেখে না, কারণ—‘বেল পাকলে কাকের কি?? বাবুরা মদ খেয়ে মেয়েমানুষ নিয়ে ‘ময়ূরবাহন'-এর মত যে সব নাটক করেন, তার ভাষা মথুরের মতো গরিব মানুষেরা বোঝে না। তাই তার কাছে—“বাইজীর খ্যামটা ভাল।....বস্তির রামলীলা ভাল।”


অর্থাৎ নাটকের সূচনাতেই সাধারণ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরাধীন উপনিবেশের বাবুশ্রেণির শিক্ষা-সংস্কৃতির সংযোগহীনতাটিকে স্পষ্ট করে তোলেন নাট্যকার। বেণীমাধবের মতো নাট্যকর্মীরা যে বাস্তব জীবনের পরিবর্তে আসলে এক অলীক জীবনের মায়া রচনা করতে চায়, সে কথাও উন্মোচিত হয় মথুরের সংলাপে—“চকচকে পোশাক পরে চৌগোঁপ্পা দাড়ি এঁটে রবক-সবক কিছু কবিতা বলে ধাপ্পা মারো। কই যুবরাজ ছেড়ে আমাকে লিয়ে ফাঁদতে পারবে?”


সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির, নবজাগরণ পর্বের আলোকপ্রাপ্ত সমাজের এই জীবনবোধ ও সংস্কৃতিচর্চা আবার সমালোচিত হয় বাচস্পতির মতো সমাজের রক্ষণশীল অংশের দ্বারা। রক্ষণশীল সংবাদপত্রগুলিও অশ্লীলতা ও যৌন লাম্পট্যের অভিযোগ তোলে বেণীমাধবের মতো নাট্যদলের বিরুদ্ধে। তারা গ্রেট বেঙ্গল অপেরার মহলাগৃহ আক্রমণ করে দলবল জুটিয়ে এনে।


বেণীমাধব ও তার নাট্যদলের বিরুদ্ধে তৃতীয় সমালোচনা উত্থাপন করে ইয়ং বেঙ্গল প্রতিনিধি প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ যেন মেথর মধুরেরই শোভন ও মার্জিত সংস্করণ। মথুরের মতোই তারও বক্তব্য, দেশ যখন ঔপনিবেশিক শোষণে ও শাসনে নিঃস্ব, জাতির মর্যাদা যখন ভূলুণ্ঠিত, তখন সেই বাস্তবকে অস্বীকার করে কাশ্মীরের রাজা ময়ূরবাহনের অলীক প্রেমের গল্পে মশগুল হয়ে থাকাটাই এক ধরনের অপরাধ।


কিন্তু প্রিয়নাথের এই স্বদেশপ্রীতি, আত্মমর্যাদাবোধ বা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিও আসলে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কেননা তৎকালীন শিক্ষিত বাবুশ্রেণির এক বড়ো অংশ সে-সময় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে দেশহিতৈষণাকেও সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি বাহ্য উপকরণ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। যে হৃদয়স্পর্শশূন্য সহানুভূতিহীন দেশব্রত ছিল আসলে সেই বাবুশ্রেণির বৌদ্ধিক চর্চার বিষয়, একান্তই উত্তেজনার আগুন পোহানো। রবীন্দ্রনাথও এই ছদ্ম দেশব্রতীদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে ধিক্কার ও ব্যঙ্গ উচ্চারণ করেছেন বারবার। বেণীমাধবের উচ্চারণে ফোটে সেই সন্দেহ —“সব শালা বারফটকা বাবুর দল মদ খেয়ে রিফরমেশন করতে আসে।.....মাথায় টাসেল দেওয়া চুপি, পাইনাপেলের চাপকান, পেটি, সিল্কের রুমাল, গলায় চুলের গার্ডচেন, বাপের বিরাট ব্যবসা, মাসির বাড়ি অন্ন লুটেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি শোন, আর সেনেদের বাড়ি বসবার আড্ডা। এদের হাড়ে হাড়ে চিনি। পকেটভর্তি টাকা, অথচ গরীবের জন্য প্রাণ কাঁদে। ব্রাহ্মসভায় গিয়ে মদ খান, আর বক্তিমে করেন। ক'টা গরীবকে চেন বাবু?” টিনের তলোয়ার’ নাটকে যদুগোপাল এই ছদ্ম রিফর্মেশনের বাবুদের ব্যঙ্গ করে গান গায়। এমনকি ‘গুপ্তকন্যার গুপ্তকথা' বিক্রয়কারী জনৈক যুবকও এই দেশহিতৈষী বাবুদের ব্যঙ্গ করে—“দেশহিতৈষী বাবুরা সব মাথায় থাক। তাদের রীতিনীতি চুলোয় যাক।”


কিন্তু প্রিয়নাথ এই শিক্ষিত বাবুশ্রেণির কৃত্রিম স্বদেশচর্চার হীনতাকে অতিক্রম করে প্রকৃত বোধের ও আন্তরিক মুক্তিবাসনার পরিচয় দিতে পেরেছেন। তিনি প্রথমে ত্যাগ করে এসেছেন পারিবারিক আভিজাত্য ও বিত্তের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তথাকথিত এই শিক্ষিত আত্মসর্বস্ব বাবুদের তিনি ঘৃণা করেন—“আই হেট দেম। তোমার ওই বাবুদের আমি ঘৃণা করি। সব বাবুদের। আমার বাপকেও...।” বেণীমাধবদের মতো সংস্কৃতিকর্মীদের তিনি প্রকৃত স্বদেশবোধে দীক্ষিত করতে চেয়েছেন। 'সধবার একাদশী', '‘রামাভিষেক’, ‘শর্মিষ্ঠা', ‘ময়ূরবাহন' ইত্যাদি নাটকের পরিবর্তে সে নিয়ে আসে পরাধীন ভারতের বেদনার নাট্যবিবরণ—‘পলাশীর যুদ্ধ'।


গ্রাম থেকে ছিন্নমূল হয়ে শহরের তরকারিওয়ালি হয়ে ওঠা ময়না যখন দক্ষ অভিনেত্রী হয়ে উদ্বাস্তু দরিদ্র ভিক্ষুক মানুষগুলিকে ঘৃণা করতে শেখে, তখন সেই ময়নাকে প্রিয়নাথ বোঝায় দুর্ভিক্ষের যথার্থ কারণ—“কেন এই দুর্ভিক্ষ? দে আর এক্সপোটিং ফুড। আমাদের খাদ্য—চাল, গম, চিনি সব রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে। রেশমশিল্প ধ্বংস করেছে, তাঁতীদের উচ্ছন্নে দিয়েছে, কারিগরদের রুধিরে হস্তপ্রক্ষালন করেছে। এইবার খাদ্য—অন্ন কেড়ে নিয়ে চালান করে দিচ্ছে বিদেশে—তাই দুর্ভিক্ষ।” আর স্বদেশের এই দুঃসময়ে বাবুরা ও বেণীমাধবের মতো নাট্যকর্মীরা দেশের বাস্তব প্রেক্ষিতকে তুলে না ধরে বুলবুলির লড়াই, বাইনাচ, রক্ষিতা, মদ্যপান কিংবা ময়ূরবাহন নাটকের রোমান্সে মগ্ন হয়ে আছেন বলে তীব্র ধিক্কার দেয় প্রিয়নাথ—“ব্রিটিশ জলদস্যুর অত্যাচারে যখন দেশ গোরস্থানে পরিণত, তখন বাবুগণ হিন্দুয়ানি, মদ, পতিতা, বুলবুলি ও ময়ূরবাহন নাটক লইয়া কালাতিপাত করিতেছেন।” লক্ষণীয়, প্রিয়নাথের আক্রমণে নাটকের বাচস্পতি (হিন্দুয়ানির ধ্বজাধারী), বীরকৃয় দাঁ (ধনী মুৎসুদ্দি, মদ ও পতিতাবিলাসী বাবু), বেণীমাধব (অভিনেতা ও নাট্যকর্মী, যিনি বীরকৃষ্ণের পৃষ্ঠপোষকতায় নাট্যচর্চাকে ও নাট্যদলকে বাঁচিয়ে রাখতে উদগ্রীব) — সকলেই একসারিতে এসে দাঁড়ায়।


কিন্তু পুঁজিতন্ত্রের দাপটে যখন সাহিত্য-সংস্কৃতি-নাট্যচর্চা ইত্যাদি সবই বেনিয়ার অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয়, সে যুগে মুক্তবুদ্ধির প্রেরণায় স্বদেশমুক্তির নাট্যাভিনয় কেমন করে সম্ভব। গ্রেট বেঙ্গল অপেরার স্বত্বাধিকারী বীরকৃয় দাঁ একদিকে বাবুশ্রেণি ও লম্পট ধনীর মুখোশ খুলে দেওয়া 'সধবার একাদশী’ নাটক মঞ্চস্থ করতে বাধা দেয় অশ্লীলতার অভিযোগে, অন্যদিকে ব্রিটিশের পদলেহী হিসাবে ব্রিটিশবিরোধী ‘তিতুমীর’ নাটকেও তার ঘোরতর আপত্তি। ফলে বেনিয়া মুৎসুদ্দি বীরকৃষ্ণের বিদ্যাবুদ্ধিও রুচির স্থূলতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও বেণীমাধব প্রিয়নাথের প্রস্তাব অনুযায়ী গ্রেট ন্যাশনালের মতো ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ বা ‘হনুমান চরিত্র’ বা ‘সুরেন্দ্র-বিনোদিনী'-র মতো স্বদেশপ্রেমমূলক নাটক করতে পারে না। তাকে নাট্যদলের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে বীরকৃষ্ণের মন ও মুনাফা জুগিয়ে চলতে হয়।


অন্যদিকে স্বদেশপ্রেমমূলক নাটকের উপর নেমে আসে ইংরেজ সরকারের ১৮৭৬-এর নিয়ন্ত্রণ আইন। গ্রেট ন্যাশনালের অভিনেতারা নাটকের মাধ্যমে রাজদ্রোহে প্ররোচনাদানের অপরাধে গ্রেপ্তার হন। ময়নাকে বীরকৃয়র কাছে বিক্রি করে দিয়ে বেনিয়া মুৎসুদ্দির খবরদারি থেকে নাটক ও নাট্যমঞ্জকে মুক্ত করতে চাইলেও ইংরেজ সরকারের রক্তচক্ষু থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। শক্তিশালী ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নাটক বা সংস্কৃতির টিনের তলোয়ার নিয়ে লড়াই করা যায় না বলে বেণীমাধব নিরাপদ নিরীহ সামাজিক নাটক ‘সধবার একাদশী'-ই অভিনয়ের জন্য বেছে নেন। কিন্তু প্রিয়নাথ নাট্যদল ছেড়ে ঘোড়ার আস্তাবলে কাজ করতে গেলেও বেণীমাধবের দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ মনের অভ্যন্তরে তার বিদ্রোহচেতনা ক্রিয়াশীল হয়। ফলে শেষপর্যন্ত বেণীমাধব বীরকৃয় এবং ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ল্যামবার্ট ও অন্যান্য রাজপুরুষদের সম্মুখেই ‘সধবার একাদশী'-র নিমচাদের সংলাপ বলতে বলতে একদিকে সরাসরি আক্রমণ করেন এই ব্রিটিশের পদলেহী বাবু-মুৎসুদ্দি শ্রেণিকে, অন্যদিকে আকস্মিকভাবে প্রিয়নাথের লেখা ‘তিতুমীর’ নাটকের দেশপ্রেমের জ্বালাময়ী সংলাপে বিদ্ধ করেন ইংরেজ রাজপুরুষদের। বসুন্ধরা এবং ময়নাসহ অন্যান্য অভিনেতারাও যাবতীয় দ্বিধা ও ভয় অপসারিত করে শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে, ক্লীবতার বিরুদ্ধে, দাসত্বের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে।


অর্থাৎ 'টিনের তলোয়ার' নাটকে শুধু ঊনবিংশ শতাব্দীর নাট্যমঞ ও নাট্যকর্মীদের প্রতিকূলতার মধ্যে সংগ্রামের প্রেক্ষাপটটিই প্রতিফলিত হয় না, সেই সঙ্গে সমকালীন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, দেশীয় অর্থনীতির ভাঙন এবং সম্পদ ও খাদ্যশস্যের অপচয়, মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ, হঠাৎ-নবাব বাবুশ্রেণির লাম্পট্য ও ব্যভিচার, সংস্কৃতিক্ষেত্রে তাদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ, পাশ্চাত্য সভ্যতার সদর্থক আলোয় জাগ্রত নবচেতনার সঙ্গে রক্ষণশীল ও স্বার্থভোগী সমাজের সংঘাত, জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্রমবিকাশ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভয় ও দ্বিধা ইত্যাদি সার্বিক প্রেক্ষাপটটিই বহুস্তরীয় বিন্যাসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ক্রমপ্রকাশমান জাতীয়চেতনা ও মুক্তিকামনা যে শেষপর্যন্ত দেশীয় জমিদার-বাবু-মুৎসুদ্দি শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ এবং ইংরেজ সরকারের দমনমূলক আইনের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই বিদ্রোহের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল, সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার’ নাটকে।