বিছিন্ন ভাবে অবস্থান করলেও স্বল্প অবস্থানিক জনতার চরিত্রটি মুক্তধারা নাটকে সবিশেষ ভূমিকা সম্পাদন করেছে—সমালোচকের এই মন্তব্যের সাপেক্ষে আলোচনা করো।

‘মুক্তধারা' নাটকে জনতার ভূমিকা অপরিসীম'- আলোচনা করো।

রবীন্দ্রসাহিত্যে বিশেষত নাট্য সাহিত্যে একটা বিশেষ অংশ অধিকার করে আছে জনতার দল। তবে তাদের আবির্ভাব কেবলমাত্র নির্জনতার অভাব মোচনের জন্যে নয়। এমনকি অবাঞ্ছিতও নয়। প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছে। রবীন্দ্রনাট্যসাহিত্যের প্রধান অপ্রধান সব চরিত্র সম্বন্ধেই এই কথা বলা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কেবলমাত্র নাটকে বাস্তবতা প্রতিপাদনের জন্যেই বুঝি অপ্রধান চরিত্র এবং জনতার ঢল নেমেছে। কিন্তু গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যায়, কোনো চরিত্রই অনাবশ্যক আবির্ভূত হয়নি, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ভূমিকা বর্তমান।


রবীন্দ্রনাট্য সাহিত্য নিষ্ঠা সহ নিরীক্ষণ করলে প্রথম দিকে জনতা চরিত্রে কোনো বিশেষত্ব নজরে না পড়লেও পর পর নাটকগুলি পড়ে দেখলে তাদের মধ্যে একটা অচ্ছেদ্য মেলবন্ধন ধরা পড়ে। এবং ক্রমশ জনতার স্তরটি একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে বসে। আপাত দৃষ্টিতে তাদের অবহেলিত মনে হলেও তারা মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। ‘ওরা কাজ করে’ কবিতায় কবি অনুভব করেছেন এই মানবসম্পদের চিরন্তনী স্থায়িত্ব। ‘রথের রশি’ নাটকের মধ্যে দেখা যায় এই অবহেলিত মানবসম্পদই প্রধান সঞ্চালকে পরিণত হওয়ায় সেখানে মুখরিত হয়েছে গণতন্ত্রের জয়গান। তিনি বলতে চেয়েছেন— কোনো হর্তা-কর্তা নয় নিতান্ত শূদ্রতুল্য খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষরাই সমাজের রথকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ‘রক্তকরবী’ নাটকের মধ্যেও দেখি, মজুরের দলের ওপর অত্যাচার যেমন চলেছে, তেমনি তারাই জালের বন্ধন-মুক্ত রাজার নবজাগরণের আন্দোলনে সামিল হয়ে, তার আন্দোলনকে সার্থক রূপদানের অঙ্গীকার বহন করেছে। ‘রাজা' নাটকের মধ্যে তাদের এক নতুন পরিচয় এই যে, তারা আর কিছু না জানুক, না পারুক, তারা মরতে পারে। তারপর তাদের সেই ‘মরা’-ই পরে প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে হস্তারককে দষ্টে ফেরে। এই সাধারণ জনতার দল যেমন নাটকে বাস্তবতাকে রক্ষা করেছে, তেমনি তারা নানাভাবে কাহিনির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেও সাহায্য করেছে। এই নীরব শ্রেণির সাধারণ সমাজসেবী মানুষকে রবীন্দ্রনাথ আজীবন শ্রদ্ধা করেছেন, তাদের পৃথিবীর অবিনাশী সম্পদ রূপে চিত্রিত করেছেন তাঁর কাব্যে সাহিত্যে।


আলোচ্য নাটকে অজস্র জনতার মধ্যে কোনো কোনো চরিত্রের নাম আছে যেমন, উত্তরকূট ও শিবতরাই অঞ্চলের সাধারণ প্রজা, বটু, অম্বা, কংকর, বিদেশী শিক্ষালয়ের গুরুমশাই, ছাত্রদল, যাত্রাদলের গায়ক, ভৈরবের মন্দিরের ঘণ্টাবাদক প্রভৃতি। আবার কোনো কোনো চরিত্র নামহীন। কেন না, তারা সমাজের এবং সামাজিকের চোখে এতই নগণ্য যে তাদের কোনো নেই। যেন তারা যে অবস্থান করে সেই তাদের অনেক— এ ছাড়া অন্য কোনো বাড়তি মূল্য তাদের নেই। তারা এতই সাধারণ যে তাদের কোনো নাম দিয়ে সনাক্ত করার প্রয়োজনও পড়ে না। এই সাধারণ নামহীন জনতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচক প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকেই একাধিক জনতা আছে। কিন্তু মুক্তধারার জনতা অনেক— ইহার প্রায় অর্ধাংশই জনতার কথোপকথন। নাটকটি পথের কাহিনী, স্বভাবতই ইহার যোগ্য পাত্রপাত্রী পথিক, মুক্তধারার জনতা পথিক জনতা। নাটকের চরম সংকটের মুহূর্তে শিবতরাই ও উত্তরকূটের হাজার হাজার পথিক পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এই পথিক অধিকাংশই নাম পরিচয় ও ব্যক্তিত্বহীন। পথিকের আবার পরিচয় কি? জনতার আবার ব্যক্তিত্ব কি? মানুষ যখন এক তখন তাহার ব্যক্তিত্ব থাকে, কিন্তু যখন সে জনতার মধ্যে আত্মনিমজ্জন করিয়া দেশের এক হইয়া যায় তখন তাহার ব্যক্তিত্ব ঘুচিয়া যায়; সমষ্টির পরিচয়েই তখন তাহার একমাত্র পরিচয়। কাজেই মুক্তধারার জনতার ব্যক্তিপরিচয় নাই, কিন্তু চমৎকার সমষ্টি আছে।” বস্তুত, তারা পৃথিবীতে আসে অপরিচয়ের সংজ্ঞায় জীবন নির্বাহ করতে। এদের নিজস্ব কোনো মত নেই, বুদ্ধি নেই। যে যেমন ভাবে বোঝায়, এরা তেমন ভাবে বোঝে। এই সাধারণ প্রজার দল, রাজা রণজিৎ যুবরাজকে বন্দী করলে, বন্দীশালা ভেঙে নিজেদের হাতে যুবরাজকে শাস্তি দেবে বলে দল বেঁধে দর্পভরে যায়। কিন্তু মন্ত্রী যখন নিজের হাতে আইন তুলে নিলে শাস্তি পেতে হবে বলে তাদের বোঝান, তখন নিজেদের পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে, 'আচ্ছা, তবে গারদ থাক্, রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মহারাজের জয়ধ্বনি করে আসি-গে” বলে অন্যত্র গমন করে। এই বুদ্ধিহীন বক্তব্যহীন অসংগঠিত আন্দোলনকারী জনতার কোনো পরিচয় নেই বলেই এদের নামও দেননি নাট্যকার। অথচ এদের কাছেই পাওয়া যায় পরিবেশ পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন ঘটনার আগামসংবাদ ও আভাস। যেমন, নাট্যারম্ভে বিদেশী ও উত্তরকূটের নাগরিকদের সংলাপ থেকে জানতে পারা যায় মুক্তধারা ঝর্নাকে যন্ত্ররাজ বিভূতি রাজাদেশে বাঁধ দিয়ে বেঁধেছে, শিবতরাই অঞ্চলের বিদ্রোহী প্রজাদের জব্দ করার জন্যে। সেই বাঁধ নিয়ে বিভূতির দেবতার সঙ্গে রেশারেশি। অম্বার সংলাপ থেকে জানা যায়— ভৈরবের মন্দিরে তারা যে পূজো পাঠায়, সে পূজো দেবতার কাছে পৌঁছয় না, মাঝপথ থেকে কারা যেন তা হরণ করে নেয়। হরণকারী যে কারা— ইঙ্গিতে অম্বা জানিয়েছে- তারাই নাকি কেড়ে নিয়েছে তার ছেলে সুমনকে।


সাধারণ মানুষের সংলাপ থেকেই জানতে পারা যায়, উত্তরকূটের রাজা রণজিৎ শিবতরাই অঞ্চলের প্রজাদের ওপর কী ভাবে শোষণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। সে প্রক্রিয়া যন্ত্ররাজ বিভূতির সহায়তায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে ক্রমে উন্নত, মার্জিত ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। রাজনীতি স্বৈরাতন্ত্রে পরিণত হতে চলেছে। শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি সমস্তই রাজপ্রশাসন দ্বারা আক্রান্ত। সেখানকার গুরুমশাই নিজের পাতের ঘিয়ের লোভে ছাত্রদের রাজস্বার্থে বাঁধাবুলি শেখাচ্ছে। মনুষ্যত্বের লেশ আর অবশিষ্ট নেই কারো মধ্যে। শোষিত শিবতরাইয়ের প্রজারা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছে—'সমুদ্রমন্থনের পর দেবতার ভাঁড় থেকে অমৃত গড়িয়ে যে মাটিতে পড়েছিল আমাদের শিবতরাইয়ের পূর্বপুরুষ সেই মাটি দিয়ে গড়া’। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে এরা ছিল ভদ্র সম্মানীত বংশোদ্ভূত। কিন্তু শোষণের চাপে এরা পরিণত হয়েছে, হতদরিদ্র লাঞ্ছিত প্রজাবর্গে। তাই নিতান্ত দুঃখে তারা সাধারণ প্রজাদের মতো। উত্তরকূটের প্রজাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে শিবতরাইয়ের প্রজারা বলেছে, উত্তরকূটের মানুষগুলোকে যেন একতাল মাংস নিয়ে বিধাতা গড়তে শুরু করেছিলেন, শেষ করে উঠতে ফুরসত পান নি।......ওরা মজুরি করবার জন্যেই জন্ম নিয়েছে ..... ওদের অন্তর দিয়ে মারে প্রাণটাকে, আর শাস্তর দিয়ে মারে মনটাকে। ... দৈত্যরা যখন দেবতার উচ্ছিষ্ট ভাঁড় চেটে চেটে নর্দমায় ফেলে দিলে তখন সেই ভাঁড় ভাঙা পোড়া মাটি দিয়ে উত্তরকূটের মানুষকে গড়া হয়। তাই ওরা শক্ত, কিন্তু থুঃ – অপবিত্র।' অন্যদিকে ফুলওয়ালী মহাত্মা বিবেচনা করে ফুল দিতে এসেছিল বিভূতির চলার পথে। কিন্তু যখন শুনলো বিভূতি যন্ত্র দিয়ে দেবতার অকৃপণ দান বন্ধ করার চক্রান্ত করেছে, তখনই বিভূতির বদলে সে অভিজিতের জন্যে অমূল্য শ্বেতপদ্মটি বিনামূল্যে সঞ্জয়ের হাতে দিয়ে গেছে। এই দৃষ্টান্ত তার সত্যনিষ্ঠা ও সরলতার কথাই জ্ঞাপন করায়।


বিভূতির কীর্তিটি যে শুভকর নয়, সেটি যে সমগ্র উত্তরকূট ও শিবতরাই-এর পক্ষে বিভীষিকা স্বরূপ তার প্রকাশও জনতাদের সংলাপের মধ্যে ফুটে উঠেছে। সাধারণ নাগরিক কুন্দন বলেছে, 'বিভূতি তার কীর্তিটাকে এমন করে গড়ল কেন ভাই? উত্তরকূটের যে দিকেই ফিরি ওর দিকে না তাকিয়ে থাকবার জো নেই, ও একটা বিকট চীৎকারের মতো।' আরো বলেছে, ‘দিনের বেলায় ও সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসেছে, অন্ধকারে ও রাত্রিবেলাকার কালোর সঙ্গে টক্কর দিতে লেগেছে। ওকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে।' — এই সংলাপ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে যন্ত্ররাজ বিভূতির যন্ত্র গ্রাস করেছে সমগ্র উত্তরকূটকে।


বাউল আগেই গানে গানে শুনিয়ে দেয় আসন্ন সংকটের কথা। যুবরাজ সঞ্জয় প্রতীক্ষায় থাকলেও অভিজিৎ আর তার কাছে ফিরবে না, সঞ্জয়ের পথ আর তার পথে এসে মিলবে না, বাহুর বাঁধনে আর ঘিরবে না। বৈরাগী ধনঞ্জয় হল সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাট্যে এই অসাধারণ ব্যক্তি নানারূপে প্রকাশমান। শারদোৎসব নাটকের দাদাঠাকুর হিসেবে তাঁর আবির্ভাব, এরপর প্রায় প্রতিটি নাটকের মধ্যে নানা রূপ ধরে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন নাট্যমঞ্চে। 'অচলায়তনে’ তিনি গুরু, ‘ডাকঘরে’ ঠাকুরদাদা, ‘রক্তকরবী’তে তাঁর প্রকাশ বিশু রূপে। দাদাঠাকুর, ঠাকুরদাদা, ধনঞ্জয়ের সঙ্গে বিশুর আপাতদৃষ্টিতে কিছু বৈসাদৃশ্য থাকলেও এরা প্রত্যেকেই মূলত একই । এরা প্রত্যেকেই উদার উন্মুক্ত মন নিয়ে মানবকল্যাণে ব্রতী। আলোচ্য নাটকের বৈরাগী ধনঞ্জয়ও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখেন সমস্ত পরিস্থিতি এবং শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে নির্ধারণ করেন যথাকর্তব্য উপায়। তিনি জানেন চীৎকার চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র যেখানে চলছে সেখানে গানে গানে অহিংস নীতিতে আন্দোলন চালানোই সমীচীন। তিনিই জানেন অভিজিতের কখনো মৃত্যু নেই, তাঁকে চোখের সামনে থেকে হারানো মানে সবের মধ্যে ফিরে পাওয়া। তিনি জানেন 'নয়ন ছেড়ে গেলে চলে এলে সকল মাঝে’র তত্ত্ব। তাই মুক্তধারার তীব্র স্রোতে অভিজিতের ভেসে যাওয়ার সংবাদে সবাই যখন বিমর্ষ তিনি তখন বলে ওঠেন, 'চিরদিনের মতো পেয়ে গেলি রে'।