'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের মেহের আলি যেন বাস্তবের ঘণ্টা ধ্বনি-সমালোচকের এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আলোচনা করো।

'ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের মধ্যে একটা ভয় বিহ্বল পরিবেশ বা আবহ রচনার চেষ্টা যে করা হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাতের অন্ধকারে পরিত্যক্ত পাষাণপ্রাসাদে বিগত দিনের অতৃপ্ত আত্মাদের চলাফেরা, হাসি কান্না, গান বাজনার মধ্যে দিয়ে গল্পকার এক অতিপ্রাকৃত রসের আবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। এই আবেশের মধ্যে থেকে পাঠক যখন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই শুনতে পায় মেহের আলি চিৎকার করে উঠছে, 'তফাৎ যাও’, ‘সব ঝুট্ হ্যায়'। গল্পের সূত্র ধরে পাঠক পরে জানতে পারে এই মেহের আলি, এই প্রাসাদের মধ্যে দীর্ঘ দিন বাস করার পর পাগল হয়ে গেছে। সে আর কোনো কথা বলে না, কেবল নিজেকে সতর্ক করার জন্যে ‘অজগরের কবলের চতুর্দিকে ঘূর্ণমান মোহাবিষ্ট পক্ষীর ন্যায়’ চিৎকার করতে থাকে ‘সব ঝুট হ্যায়', ‘তফাৎ যাও।'


‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের মধ্যে পাঠক যখন নায়কের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যবনিকার পার থেকে রোমান্টিকতার আঁচ করতে শুরু করে তখনই সে শুনতে পায় পাগলা মেহের আলি চিৎকার করে উঠছে ‘তফাৎ যাও’, ‘তফাৎ যাও’, ‘সব ঝুটি হ্যায়'। স্বপ্ন বিহ্বলতার মধ্যে থেকে নায়ক জেগে ওঠে মেহের আলির চিৎকারে। সম্বিত ফিরে পায় পাঠকও। মেহের আলির এই চিৎকার গল্পের মধ্যে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে। হঠাৎ তার চিৎকার শুনে পাঠক চিত্তও চমকে ওঠে। আবার পাশাপাশি সেই চিৎকারই পাঠককে সচেতন করায় বাস্তব সম্বন্ধে। তাই সমালোচকের মন্তব্য অনুযায়ী মেহের আলিকে বাস্তবের ঘণ্টাধ্বনি বলে অভিহিত করা যায়।


মেহের আলি তার কথার মধ্যে দিয়েও পাঠকদের জানিয়ে দেয় যে এই চলমান জগতে কিছুরই স্থায়িত্ব নেই। রাতের অন্ধকারের মতোই অন্ধ মোহে মানুষ ঘুরে চলেছে দিবারাত্র অলীক আকাঙ্ক্ষার পিছনে। মেহের আলি বারে বারে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে অস্পষ্ট আলোকোদ্ভাসের মধ্যে চিৎকার করে উঠেছে ‘তফাৎ যাও'। তফাতে না থাকলে মোহান্ধকারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে। সোনার হরিণের মোহে সীতাকে হারানোর মতোই আমরা আমাদের অস্তিত্বকে হারিয়ে যাতে না ফেলি, মেহের আলি তাই সতর্ক করে বলে ওঠে—‘সব ঝুট হ্যায়'।


মেহের আলিকে অন্য কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায় না। তার আবির্ভাব ঘটে যখন পাঠক রোমান্টিকতায় আপ্লুত হয়ে ইরাণী তরুণীর প্রতি উৎসুক হয়ে ওঠে সেই সময়। কিম্বা ভয় বিহ্বল নিদ্রা থেকে নায়কের সঙ্গে পাঠকও যখন সদ্য জেগে ওঠে সেই সময়। তখনই দিনের আলোর আভাস আসে। কেন না, মোহের অন্ধকার দূর করানোর জন্যেই মেহের আলি চিৎকার করে সেই আলো এনে দেয় পাঠকের চিত্তে।


এই সতর্কীকরণ শুধু যে গল্পের ভয়বিহ্বল আবেশ রচনা করেই ক্ষান্ত হয় এমন ভাবনা ভাবা সঙ্গত নয়। বস্তুত, গল্পকার নিজেই যেন গল্পকথকের গালগল্পের মধ্যে নিজেকে মেহের আলি হিসেবে উপস্থিত করিয়ে জানিয়ে দেয়, ‘লোকটা আমাদের বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল; গল্পটা আগাগোড়া বানানো।' অর্থাৎ নিজেকে সতর্ক করার জন্যেই গল্পের মধ্যে এই সতর্ক বাণী ধ্বনিত করেছেন গল্পকার। তাঁর এই উদ্দেশ্য থেকেও আমরা মেহের আলিকে বাস্তবের ঘণ্টাধ্বনি বলে সমালোচকের সঙ্গে সমকণ্ঠে অভিহিত করতে পারি।