‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র নামকরণগত সার্থকতা আলোচনা করো।

যে-কোনো সৃষ্টিশীল রচনা সম্পূর্ণতা লাভ করে তার নামকরণের মাধ্যমে। নামকরণ ঘটনাকেন্দ্রিক, স্থানকেন্দ্রিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বিষয়কেন্দ্রিক, ভাবাদর্শকেন্দ্রিক ইত্যাদি নানা বিষয়ক হতে পারে। নামকরণের মূলত তিনটি অভিমুখ ঘটনাকেন্দ্রিকতা, চরিত্রাভিমুখিনতা ও ব্যঞ্জনাধর্মিতা। মধুসূদন নামকরণের ব্যাপারে ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর পদ্মাবতী, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী নাটকের নামকরণ এই বক্তব্যের পক্ষে রায় দেয়। তবে ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ নামকরণটি ব্যক্তি, ঘটনা বা চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ নয়; একে বিবেকী কণ্ঠস্বরজাত নামকরণ বলা যেতে পারে।


‘একেই কি বলে সভ্যতা?' প্রহসনটি একটি বিশেষ সময়ের রচনা। উনিশ শতকের ইতিহাসের নানা বিচিত্র ঘটনাসমাবেশের মধ্য থেকে মধুসূদন ইতিহাসের একটি বিশেষ উপাদানকে বেছে নিয়ে আলোচ্য প্রহসনটি রচনা করেছেন। ইংরেজি-শিক্ষিত তরুণ যুবসম্প্রদায়কে এখানে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। তারা স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতার ধ্বজাধারী, পানভোজনে উৎসাহী, বারাঙ্গনা-বিলাসী ও নীতিনৈতিকতাহীন ছিল। তারা মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে বিদেশি ভাষাকে বরণ করেছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে দীক্ষিত হওয়াই তাদের একান্ত কামনা ছিল। তারা ইংরাজি কেতায় অভ্যস্ত ছিল এবং ইংরেজি আদব-কায়দাকেই সভ্যতার মানদণ্ড বলে মনে করতো। স্ত্রীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, বিধবাবিবাহ, জাতিভেদপ্রথার দূরীকরণ ইত্যাদি তাদের ঘোষণামাত্র ছিল, বাস্তবে তারা একাজ করতো না, তাদেরই ঘরের অন্তঃপুরচারিণীরা অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। তারা অদৃষ্টে বিশ্বাসী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সভ্যতার আলোক বঞ্চিত ছিল। ইয়ংবেঙ্গলের দল, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাবুরা ঘরে স্ত্রী থাকলেও বারবনিতাবিলাসী ছিল এবং তাদের স্ত্রীরা অবহেলিতা ছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। স্বার্থপরতা, লালসা, দুর্নীতি, ভোগাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি সামাজিক বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দিয়েছিল। নব্যবাবুরা কলেজীয় শিক্ষা সমাপ্ত করে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে নানা অনৈতিক কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখনকার জীবনাদর্শ এতই ঘৃণ্য হয়ে পড়েছিল যে তাকে উপস্থাপনার জন্য মধুসূদন প্রহসন রচনার প্রেরণা অনুভব করেন এবং উনিশ শতকীয় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের চিত্রাঙ্কন করেন আলোচ্য 'একেই কি বলে সভ্যতা?' প্রহসনে।


প্রহসনটির ঘটনাবস্তুতে দেখা যায়, নবকুমার আলোচ্য প্রহসনের নায়ক; সে পানভোজনে দক্ষ, বারবিলাসিনীতে আসক্ত, টাকা ওড়ানোতে নিপুণ; আবার ইংরেজি লেখাপড়ায় ও কেতায় অভ্যস্ত। সে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার চেয়ারম্যান। বাড়িতে তার পিতা-মাতা, স্ত্রী হরকামিনী, ভগ্নীদ্বয় প্রসন্নময়ী ও নৃত্যকালী থাকে। তার পিতা মূলত বৃন্দাবনে থাকলেও মাঝে মাঝে কলকাতায় আসেন। নবকুমারের বন্ধু কালীনাথও মদ্যপানে আসক্ত; নবকুমারের মত অন্যান্য গুণাবলীও তার আছে। সে মিথ্যা কথায় পটু; নবকুমারের পিতার নিষেধ অগ্রাহ্য করে তাকে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় নিয়ে যাবার জন্য নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। অবশেষে নবকুমারের পিতা নবকুমারকে সভায় গমনের অনুমতি প্রদান করলে তার খোঁজখবর সংগ্রহের জন্য তিনি তার একজন বৈষ্ণবসঙ্গীকে সিকদারপাড়া স্ট্রিটে প্রেরণ করেন। বৈষ্ণব বাবাজী জানতে পারে যে, নবকুমার ও তার সঙ্গীদের প্রতিষ্ঠিত সভা আসলে নানা কুকর্মের আশ্রয়; এবং সেখান থেকে নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাবাজী প্রত্যাবর্তন করেন। এর পরে দেখা যায় নবকুমার পানোন্মত্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করলে কর্তামশায় অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে পরের দিনই সকলকে নিয়ে বৃন্দাবনে ফিরে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন। নবকুমার পিতার প্রস্তাব, সমর্থন করে বলে, ‘আই সেকেণ্ড দি রেজোলুশন'। আলোচ্য সংলাপে প্রহসনের সামগ্রিক বক্তব্য প্রকাশিত হয়।


মধুসূদন তৎকালীন ইয়ংবেঙ্গলের আচার-আচরণে, নীতিতে, জীবনাদর্শে বিচলিত হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?' এ প্রশ্ন শুধু মধুসূদনের একার প্রশ্ন নয়, এ প্রশ্ন যুগের প্রশ্ন, ইতিহাসের প্রশ্ন। মধুসূদনের আলোচ্য প্রহসন রচনার উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক সংকট, পানদোষ, অনাচার ও অবক্ষয়ের অবসান ঘটিয়ে সমাজজীবনে সুস্থতা ও সৃজনশীলতা ফিরিয়ে আনা। সেইজন্য তাঁর প্রশ্ন ছিল- পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যযুবকেরা যা করছে তা সভ্যতা কি না? নবকুমারের পরিবারের বেদনাদায়ক কাহিনী এ গ্রহসনের বিষয়বস্তু। 'একেই কি বলে সভ্যতা?” যে সমাজচিত্রের উপস্থাপন ঘটিয়েছে মাইকেল ছিলেন সেই সমাজেরই একজন। সুতরাং সেই সমাজের ত্রুটি, স্খলন-পতনের সবটুকু ছিল মধুসূদনের জানা। নাট্যকার এই গোষ্ঠীর সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশে বুঝেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার বুজরুকিতে ইয়ংবেঙ্গল সমাজের অন্তঃসারশূন্য বাক্যবিন্যাসকে। যে বাক্যের সঙ্গে কাজের কখনও যুগলমিলন ঘটে না। [বাংলা গ্রহসনের ইতিহাস/অশোককুমার মিশ্র।] মদ্যপান, গণিকাসঙ্গ, কুসংস্কার বিরোধী বক্তৃতা করাকেই এই শ্রেণীর মানুষেরা সভ্যতার পরিচয়রূপে মনে করত। কিন্তু এই নব্যযুবকরা পরিবার পরিজনদের প্রতি তাদের যথোচিত কর্তব্য পালন করতো না। হরকামিনীর উক্তিতেই প্রহসনটির মূল বক্তব্য প্রকাশিত—“তা বই আর কি, ভাই? আজকাল কলকেতায় যাঁরা লেখাপড়া শেখেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই কেবল এই জ্ঞানটি ভাল জন্মে। তা ভাই দেখ দেখি, এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলিই বা কি। ঠাকুরঝি, তোকে বলতে কি ভাই এই সব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। ছি ছি ছি! বেহায়ারা আবার বলে কি, যে আমরা সায়েবদের মতো সভ্য হয়েছি। হা আমার পোড়া কপাল। মদ-মাস্ খ্যেয়ে ঢলাঢলি কল্পেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?” হরকামিনীর আলোচ্য উক্তিতে মধুসূদন সমগ্র বাংলাদেশের যে নির্লজ্জ, ভোগবাদী স্বার্থপরতার নির্মম উদাহরণ প্রদর্শন করলেন সেই কারণেই প্রহসনটির নাম দিলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?'— যা যথেষ্ট সার্থকনামা।